শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫ খ্রীষ্টাব্দ | ২ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ



                    চাইলে বিজ্ঞাপন দিতে পারেন

‘গরিবের ডাক্তারনি’ জুড়ীর লিপা খানম



বিজ্ঞাপন

তপন কুমার দাস:
মায়ের আবেগ আর মমতার টানে দিন-রাতের পার্থক্য ভুলে নিরাপদ প্রসবের কাজ করছেন একজন লিপা খানম। এই কাজের জন্য কোনো আর্থিক প্রাপ্তি নেই, নেই প্রত্যাশাও। গর্ভবতী মায়েদের আস্থায় এরইমধ্যে ‘গরিবের ডাক্তারনি’ নামেই তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে, আবার কারো কাছে শুধুই ‘লিপা আপা’।

লিপা যেভাবে গরিবের ডাক্তার
লিপা খানম মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার ভোগতেরা কমিউনিটি ক্লিনিকের একজন বেসরকারি সিএসবি (কমিউনিটি স্কিল বার্থ অ্যাটেনডেন্ট)। এই প্রতিষ্ঠান থেকেও তিনি কোনো পারিশ্রমিক নেন না। ২০০০ সালে মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার জায়ফরনগর ইউনিয়নের ভোগতেরা গ্রামে ক্লিনিকটির কার্যক্রম শুরু হয়। তবে ২০১২ সাল থেকে এ ক্লিনিকে স্বাভাবিক প্রসব পদ্ধতি চালু হয়। এখানে যেসব গর্ভবতী নারী আসেন তাদের ৯০ ভাগই দরিদ্র। এই কার্যক্রম শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত এখানে মা কিংবা কোনো নবজাতকের মৃত্যু হয়নি। ক্লিনিকটি শুধু জুড়ী নয়, সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জেলা-উপজেলার গর্ভবতী মায়েদের দুশ্চিন্তা অনেকখানি লাঘব করেছে। আর আস্থার জায়গা হয়ে ওঠেছেন লিপা খানম। ক্লিনিকটিও পরিচিতি পেয়েছে ‘গরিবের হাসপাতাল’ নামে।

গত ৪ সেপ্টেম্বর লিপা খানমের হাতেই ওই ক্লিনিকে ৫০১তম শিশুর স্বাভাবিক জন্ম হয়। এরমধ্যে ২৪৯টি শিশুর জন্ম হয়েছে তার হাতে। এর আগে সিএসবিএ জুলেখা বেগম এখানে কাজ করতেন। তিনি অন্যত্র চলে যাওয়ায় দায়িত্ব পড়ে লিপা খানমের ওপর। বিনা পারিশ্রমিকের কাজেও খুশি লিপা খানম। অন্তত সঙ্কটে মানুষের পাশে থাকতে পারছেন। যতদিন বেঁচে আছেন অসহায় মানুষের পাশেই থাকতে চান লিপা।

স্বপ্ন যেখানে শুরু
লিপা খানম জানান, তার প্রথম বাচ্চার জন্ম নেওয়ার পর এই কাজে আগ্রহ সৃষ্টি হয়। ২০০৮ সালের কথা। প্রথম বাচ্চা জন্ম নেবে। সম্পূর্ণ একা ঘরে মেয়ের জন্ম হয়েছে তার। যার বয়স এখন ৯ বছর। সেদিন বাড়িতে একা ছিলেন। একজন গ্রাম্য ধাত্রীর মাধ্যমে প্রসব হয়েছে। পরিবারের নারী সদস্যরা অন্যত্র ছিলেন। প্রসবের সময় যে সুতো, কাঞ্চি লাগবে এসব জানতেন না। স্বামীরও জানা ছিল না। ওই ধাত্রীও বলেনি। রাত ২টার দিকে মেয়ে জন্ম নেয়। তখন শাড়ির ডোরা দিয়ে নাড়ি বাঁধতে হয়। এতে মেয়েটির অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। অনেক রক্তক্ষরণ হয়। মেয়েটির ৬দিন খাওয়া বন্ধ ছিল। বাচ্চা চোখ মেলে তাকায় না, কাঁদেও না। চিন্তায় পড়েন তিনি। মেয়ের ওজনও কম ছিল। নির্দিষ্ট সময়ের দেড় মাস আগে মেয়ের জন্ম হয় বাচ্চার। মেয়েটির রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। যা এখনো আছে। এরপর এক দেবরের মাধ্যমে কুলাউড়ার মিশন হাসপাতালে মেয়েকে ভর্তি করেন। ৭দিন ইনকিউবিটরে রাখার পর সে সুস্থ হয়। স্বামী বেকার ছিলেন, স্বামীর বাড়িতে কোনো গুরুত্ব ছিল না তার। তবে ২০১২ সালে ছেলের জন্ম ভোগতেরা ক্লিনিকে সিএসবিএ জুলেখা বেগমের হাতেই হয়েছে। স্বাভাবিক প্রসব। সেই থেকেই জুলেখা বেগমের মতো গরিব গর্ভবতী মহিলাদের পাশে দাঁড়ানোর স্বপ্ন তার।

লিপা খানম ২০১৪ সালে সিএসবিএর ৬ মাসের প্রশিক্ষণ নেন হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালে। প্রশিক্ষণ শেষে ময়মনসিংহে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন। ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ভোগতেরা কমিউনিটি ক্লিনিকে গর্ভবতী নারীদের সাধারণ প্রসব কাজ শুরু করেন।

লিপার ৫০০
গত ৩ সেপ্টেম্বর ৫০০তম শিশুর জন্ম হয়েছে এই ক্লিনিকে। ৫০০তম ওই শিশুর মা ৩ সেপ্টেম্বর প্রথমে বড়লেখা হাসপাতালে ভর্তি হন। পরে ছুটে এসেছিলেন এখানে। লিপা খানম বলেন, ‘খুব ভালো লাগছে আমার। এই ভালোলাগা ও আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। আমাদের এখানে বিভিন্ন জায়গা থেকে রোগী আসেন। সকল রোগীকে সফলভাবে ডেলিভারি করাতে পেরেছি, এটাই সব থেকে আনন্দের। এর চেয়ে আনন্দের বিষয় হচ্ছে এখন পর্যন্ত কোনো মা ও নবজাতকের মৃত্যু হয়নি।’

ঝামেলার ঝুঁকিও কম না!
মাঝেমাঝে বেশ ঝামেলায়ও পড়তে হয় লিপাকে। বছরখানেক আগের কথা। এক গর্ভবতী নারীর বাড়ি পাশের গ্রামে। অদক্ষ এক ধাত্রীর পরামর্শে বড় ধরনের বিপদে পড়ছিলেন ওই নারী। প্রসবের ৭দিন আগে স্যালাইন লাগিয়ে প্রসবের চেষ্টা করানো হয়, প্রসব হয়নি। ৭দিন পর তারা ক্লিনিকে এসেছিল। যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে। বেশ টেনশন হচ্ছিল। কিন্তু বুঝতে দেননি কাউকে। শেষ পর্যন্ত সফল হন। নিরাপদে স্বাভাবিক প্রসব হয়। এরপরই ওই মায়ের রক্তপাত হতে থাকে। জড়ায়ুতে একটু সমস্যা হয়েছিল। পরে চিকিত্সকদের পরামর্শে দ্রুত বাচ্চা ও মাকে সিলেটে পাঠিয়ে দেন।

লিপা খানম বলেন, ‘এখানে যখন আমি কাজ শুরু করি তখন সরকারের কাছ থেকে ওষুধ পেতাম। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা স্যারের মাধ্যমে আসতো। এখন পাই না। অনেক সময় রোগীরা নিজের টাকা দিয়ে ওষুধ আনেন। রাতে দেরি হলে আমার স্বামীকে সিএনজি দিয়ে ওষুধ আনতে পাঠাই। আমার এ কাজে সহায়তার জন্য আমার স্বামীর অনেক আগ্রহ আছে। স্বামীর উত্সাহের কারণে রাত-বিরাতে আমি ডেলিভারির জন্য ছুটে যাই। বাড়ি বাড়ি গিয়ে গর্ভবতী মহিলাদের খোঁজখবর নিই। নেশা হয়ে গেছে। ভালো লাগে নিজের কাছে। দরিদ্র পরিবারের নারীদের অনেকেই তো গর্ভাবস্থায় সচেতন থাকেন না। এখন আমি সবাইকে সচেতন করার জন্য কাউন্সিলিং করি।’

লিপার এই কাজে পরিবারের সবাই খুশি। পরিবারের সমর্থন থাকায় কাজ করা সম্ভব হচ্ছে। তবে এ কাজে সরকারি কোনো টাকা পান না। সম্পূর্ণ বিনা পয়সার কাজ। তবে এতে তার কোনো কষ্ট নেই।

লিপা গরিব গর্ভবতী মহিলার আর্শিবাদ
ক্লিনিকে আসা আছিয়া বেগম (৩০), রাছনা বেগম (২৭), তানজিনা আক্তার (২৫), জুবেদা বেগমের (১৮) সাথে কথা হয়। তারা বলেন, গরিবের ডাক্তারনি লিপা আপা গর্ভবতীদের ডেলিভারি করানোর ফলে আমাদের অনেক উপকার হইছে।

কমিউনিটি গ্রুপের সভাপতি ফয়জুল ইসলাম বলেন, ‘লিপা হইলো গরিব গর্ভবতী মহিলার আর্শিবাদ। রাত নাই, দিন নাই যেকোনো সময় লিপা ক্লিনিকে আইয়া ডেলিভারি করায়। আমরাও লিপারে সহযোগিতা করি।’

জুড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘লিপা বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করেন। এটা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। আমরাও বিভিন্ন সময় তাকে পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করি। আমাদের হাসপাতাল নতুন উদ্বোধন হয়েছে। ওষুধেরও বরাদ্দ নেই। ওষুধ বরাদ্দ হলে আরো সহযোগিতা করা সম্ভব হবে।’