রবিবার, ৮ ডিসেম্বর ২০২৪ খ্রীষ্টাব্দ | ২৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ



                    চাইলে বিজ্ঞাপন দিতে পারেন

কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেললাইনের পুন:স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে



বিজ্ঞাপন

তপন কুমার দাস ও দেলোয়ার হোসাইন:
সব জল্পনা-কল্পনার অবসা ঘটিয়ে অবশেষে কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেললাইন পুন:স্থাপনের কাজ দৃশ্যমান হয়ে ওঠছে। গত ১০ আগস্ট শুক্রবার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে রেলের পুরাতন ব্রিজ ও রেল লাইন উঠানোর কাজ শুরু হয়েছে। উপজেলার সীমান্ত এলাকা কুমারশাইল গ্রামের জলংগা ছড়ার উপর পুরাতন রেল ব্রিজ ভাঙ্গার মাধ্যমে এ পুন:স্থাপনের কাজ শুরু করা হয়। বর্তমানে কাঁকড়ি ছড়ার পুরাতন রেলব্রিজ ভাঙা ও পুরাতন রেল লাইন তুলার কাজ চলছে। এছাড়া চলতি বছরের শুরুতেই বড়লেখা উপজেলার উত্তর শাহবাজপুর ও দক্ষিণভাগ এলাকায় দু’টি ইয়ার্ড তৈরি করাসহ প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ হয়েছে।

এর আগে গত বছরের ১৫ নভেম্বর বুধবার রাজধানীর রেলভবনে বাংলাদেশ রেলওয়ে এবং ভারতের কালিন্দী রেল নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের (টেক্সমাকো রেল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিডেটের একটি বিভাগ) সঙ্গে এই চুক্তি হয়। বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক (পূর্ব) আব্দুল হাই ও ভারতের কালিন্দী রেল নির্মাণের ভাইস প্রেসিডেন্ট শারদ শর্মা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।

গত ১৫ আগস্ট বুধবার সরেজমিনে উত্তর শাহবাজপুর ইউনিয়নের কুমারশাইল গ্রামে দেখা গেছে, এলাকার জলংগা ও কাঁকড়ি ছড়া পুরাতন রেলব্রিজ ভাঙার কাজ চলছে। শ্রমিকদের কেউ রেলব্রিজ ভাঙছেন। কেউ পুরাতন রেল লাইন তুলছেন। আর এসব কাজ তদারকি করছেন রেল লাইন পুন:স্থাপনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ভারতীয় ঠিকাদারী রেল নির্মাণ প্রতিষ্ঠান কালিন্দীর জ্যেষ্ঠ জরিপকারক (সার্ভেয়ার) রিপন শেখ, বৈদ্যুতিক প্রকৌশলী সন্দীপ বিশ্বাস ও রূপসী বাংলা রেল নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক ইমরান হোসেন। স্থানীয় লোকজন এসব কাজ দেখতে ভীড় জমিয়েছেন।

স্থানীয় শ্রমিক কুমারশাইল গ্রামের আতিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা রূপসী বাংলা রেল নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের আওতায় এলাকার ২০ জন শ্রমিক কাজ করছি। কাজ শুরু হওয়ায় এলাকার মানুষ খুশি।’

ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাসুক উদ্দিন বলেন, ‘কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেললাইন পুন:স্থাপনের কাজ শুরু হওয়ায় আমাদের স্বপ্ন পূরণ হতে চলছে।’

কালিন্দীর শ্রমিক রাজু আহমদ বলেন, ‘জানুয়ারি থেকে আমরা এখানে আছি। প্রথমে ঘাস কাটা ও খুটিনাটি কাজ করেছি। মূল কাজটা এ মাসে শুরু করেছি। এখন ব্রিজ ভাঙা ও পুরাতন রেললাইন উঠানোর কাজ করছি। একশ জনের মত শ্রমিক কাজ করছে। ঈদের পরে আরো শ্রমিক আসবে।’

রেলওয়ে ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ১৮৯৬ সালের ৪ ডিসেম্বর আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের অংশ হিসেবে চালু হওয়া লাতুর ট্রেনের ঝিক্ ঝিক‌্ ঝিক‌্ শব্দে মুখর ছিলো কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথের চার উপজেলা। রেলপথ ও ট্রেনকে ঘিরে মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা, জুড়ী, কুলাউড়া ও সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার হাজার হাজার মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত ছিল। কিন্তু ঘন ঘন ট্রেন দুর্ঘটনা, কাঠের স্লিপার, সেতুসহ অন্যান্য যন্ত্রাংশ সংস্কারের অভাব, লোকসান এবং স্টেশন ভবনগুলোও ঝুঁকিপূর্ণ হওয়াসহ নানা কারণ দেখিয়ে ২০০২ সালের ৭ জুলাই লাতুর ট্রেনটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ট্রেনটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েন এ অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ। দীর্ঘ সময় ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকার কারণে নষ্ট হয় রেলওয়ের কোটি কোটি টাকার সম্পদ, দখল হয় বহু সরকারি ভূ-সম্পত্তি। রেলের সম্পদ রক্ষা এবং আবার ট্রেন চালুর দাবিতে রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচিও পালন করেন।

ট্রেন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বারবার চালুর উদ্যোগ নেওয়া হলেও কিছু দূর এগিয়ে যাওয়ার পর আবার ভেস্তে যায়। ২০০৮ সালে মৌলভীবাজার-১ (বড়লেখা-জুড়ী) আসন থেকে নির্বাচিত জাতীয় সংসদের হুইপ আলহাজ মো. শাহাব উদ্দিন এমপি কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথ চালু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ২০১৩ সালের ৯ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বড়লেখা সফরকালে বড়লেখা ডিগ্রি কলেজ মাঠে এক জনসভায় সংসদ সদস্য মো. শাহাব উদ্দিন রেললাইন চালুর দাবি জানালে শেখ হাসিনা রেল লাইন চালুর ঘোষণা দেন।

সে লক্ষ্যে ২০১৫ সালের ২৬ মে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ৬৭৮ কোটি টাকা ব্যয়ে কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথ পুন:স্থাপন প্রকল্প অনুমোদন হয়। এরমধ্যে বাংলাদেশ সরকার দিবে ১২২ কোটি ৫২ লাখ টাকা এবং ভারত সরকার ৫৫৫ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। ওই বছরের ৬ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ মোদি বাংলাদেশ সফরে আসেন। পরদিন ৭ জুন ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যৌথভাবে অন্যান্য প্রকল্পের সঙ্গে এ প্রকল্পেরও আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।

এমন খবরে চার উপজেলার মানুষের মাঝে আনন্দের বন্যা ছড়িয়ে পড়ে। আনন্দ মিছিল ও মিষ্টি বিতরণ করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জাতীয় সংসদের হুইপ আলহাজ্ব মোঃ শাহাব উদ্দিনকে অভিনন্দন জানান দলীয় নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষ। কিন্তু কিছু দিন যেতে না যেতেই তাদের আনন্দ ফিকে হতে থাকে। একনেকে বিল পাস হওয়ার পরও প্রকল্পের কাজ শুরু হয়নি।

প্রায় ১৫ বছর পর কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথের পুন:স্থাপনের কাজ শুরু হওয়ায় অঞ্চলের প্রায় ৮ লক্ষাধিক মানুষের মনে আশার আলো জেগেছে। রেলপথের কাজ শুরু হওয়ায় এলাকার মানুষ দারুন খুশি।

রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে, ৪৪ দশমিক ৭৭ কিলোমিটারের পুরোটাই দ্বৈত গেজ লাইনে পুনর্বাসন করা হবে। এরমধ্যে সাত দশমিক ৭৭ কিলোমিটার লুপ লাইনের কাজ হবে। ট্রেন লাইন পুনর্বাসনের পাশাপাশি ছয়টি স্টেশনের মধ্যে জুড়ী, দক্ষিণভাগ, বড়লেখা ও শাহবাজপুর বি শ্রেণি এবং কাঁঠালতলি ও মুড়াউল স্টেশন ডি শ্রেণিতে পুনসংস্কার করা হবে। এই রেললাইনটি চালু হলে কুলাউড়া থেকে শাহবাজপুর পর্যন্ত প্রতিদিন পাঁচটি ট্রেন চলাচল করবে। লোকাল ট্রেন ছাড়াও আন্তঃনগর ট্রেন চলবে। পরবর্তী সময়ে ভারতীয় ট্রেনও চলবে এ পথ দিয়ে। কাজ শুরুর পর ২৪ মাসের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।

স্থানীয় ইউপি সদস্য রফিক উদ্দিন জানান, ‘আমাদের প্রাণের দাবি ছিলো কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেল লাইনটি চালু করার। অবশেষে রেলপথের পুন:স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটা আমাদের জন্য আনন্দের খবর।’

স্থানীয় উত্তর শাহবাজপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) সেলিম আহমদ খান বলেন, ‘রেলের কাজ শুরু হওয়ায় মানুষের মাঝে আনন্দ বিরাজ করছে। লাইনটি চালু হলে এই অঞ্চলের মানুষ কম খরচে পণ্য পরিবহন ও যাতায়াত করতে পারবে।’

লন্ডন সফররত উত্তর শাহবাজপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আহমদ জুবায়ের লিটন বলেন, ‘কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেললাইন পুন:স্থাপনের কাজ শুরু হওয়ায় আমরা আনন্দিত। তিনি বলেন, রেলপথ চালু হওয়ার পর ব্যবসা-বাণিজ্যের নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে। সেইসাথে বদলে যাবে এ অঞ্চলের চার উপজেলার চেহারা। ২০০২ সালে বন্ধ হওয়া এই রেললাইন চালু করার কাজ শুরু হওয়ায় এলাকাবসীর পক্ষ থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও হুইপ শাহাব উদ্দিনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।’

কালিন্দী রেল নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠ জরিপকারক (সার্ভেয়ার) রিপন শেখ বলেন, ‘আজ (১৬ আগস্ট) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কাজ পরিদর্শন করে গেছেন। ১০ আগস্ট থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে রেলের পুরাতন ব্রিজ ও রেল লাইন উঠানোর কাজ শুরু করেছি। এর আগে জানুয়ারি থেকে রেলের উপর জন্মানো ঝোঁপঝাড় পরিষ্কার করা হয়েছে। ইতিমধ্যে কাজের জন্য যন্ত্রপাতি পৌঁছে গেছে। দক্ষিণভাগ ও শাহবাজপুর এলাকায় মালামাল রাখা হয়েছে। এখন থেকে কাজ চলমান থাকবে।’

বাংলাদেশ রেলওয়ের কুলাউড়া সেকশনের ঊর্ধ্বতন উপ-সহকারী প্রকৌশলী (কার্য) মো. জুয়েল হোসেন বলেন, ‘এতদিন কাজ দৃশ্যমান ছিল না। এখন কাজ দৃশ্যমান হচ্ছে। ব্রিজ ভাঙা ও পুরাতন রেললাইন উঠানোর কাজ চলছে। কাজের জন্য সব যন্ত্রপাতি এখন স্পটে রয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করেছে। কাজ অব্যাহত থাকবে। দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর সামনের মাসে লাইনের কাজের উদ্বোধন করার কথা রয়েছে। তাই দ্রুত কাজ হচ্ছে। রেলাইনের পাশে বনবিভাগের গাছ না কাটা ও সার্ভেসহ কিছু কাজের জন্যই এতদিন বিলম্ব হয়েছিল। ভারতীয় সীমান্ত থেকে-শাহবাজপুর স্টেশনের মধ্যখানে এ কাজ শুরু হয়েছে।’