মৌলভীবাজার থেকে নোয়াখালীর কোম্পানিগঞ্জ। ১৯৭৬ সালে সেটা ছিল অনেক দূর। একটি মরদেহ নিয়ে যাওয়া ছিল যথেষ্ট কষ্টের। তার চেয়েও বড় কথা যাতায়াত ব্যবস্থা বেশ সময় সাপেক্ষ ছিল। তাই মোহাম্মদ আবুল ফররাহ সাহেবের মরদেহ আর গ্রামে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়নি। মসজিদের ঈমাম সাহেবের কথায় পরিবারকে জানানোর আগেই মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলা থেকে নোখায়াখালী নিয়ে যাওয়ার পথে মৌলভীবাজার সদরে মরদেহ দাফন করা হলো।
সেসময় ডা. জাহাঙ্গীর আলম শিপনের বয়স মাত্র ৪ বছর। ৭ ভাই বোনের মধ্যে জাহাঙ্গীর ষষ্ঠ, সব ছোট বোন নাজনীন রোজী তখন ৭ মাসের গর্ভে।
বাবার স্মৃতি খুব একটা মনে নেই ছেলে ডা. জাহাঙ্গীর আলম শিপনের। তবুও ৪২ বছর ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছেন বাবার কবর। তবে মা ও প্রতিবেশীসহ অন্যদের কাছে শুনেছেন বাবা ছিলেন ছয় ফুট উচ্চতার একজন সুদর্শন মানুষ। রঙ ছিল ফর্সা। ছিলেন খুব জ্ঞানী এবং সৎ কর্মকর্তা।
নোয়াখালীর কোম্পানিগঞ্জের রামপুর ইউনিয়নের রংমালা গ্রামের ডা. জাহাঙ্গীর আলম শিপন পেশায় একজন চিকিৎসক। চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে কর্মকর্ত আছেন তিনি। বার বার মৌলভীবাজার ছুটে এসেছেন বাবার কবর খুঁজতে। বিচরণ করেন সম্ভাব্য সব জায়গায়। কিত্নু আজ পর্যন্ত বাবার কবরের সন্ধান কেউ দিতে পারেনি।
জাহাঙ্গীর আলম জানান, তিনি বড় হয়ে পরিবারের কাছে শুনেছেন বাবা মারা যাওয়ার পর এত দূর নিয়ে গেলে লাশ পচে যাবে তাই এলাকার ধার্মিক মানুষ এবং বাবার সহকর্মীরা মিলে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার কোনো এক স্থানে কবর দেন।
পরিবারের কাউকে না জানিয়ে এভাবে কবর দিতে সহকর্মীরা আপত্তি জানান। তবে মসজিদের ঈমাম সাহেব দায়িত্ব নেন। তিনি বলেন, ‘এমন ধার্মিক মানুষের লাশ পচতে দেয়া যাবেনা। এত ভালো মানুষের পরিবার মামলা দেবে না সেটা আমার বিশ্বাস।’ ঈমাম সাহেবের কথার ওপর বিশ্বাস রেখেই বাবাকে কবর দেয়া হয়।
বাবার মৃত্যুর ৩ দিন পর অফিসের একজন পিওন মোহাম্মদ আবুল ফররাহ সাহেবের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর কোম্পানিগঞ্জের রামপুর ইউনিয়নের রংমালা গ্রামে গিয়ে মৃত্য সংবাদ দেন। এই সংবাদ শুনে যখন বাবার বন্ধু খালেদ মমিন এবং খালাত ভাই মৌলভীবাজারে আসেন তখন ঈমাম সাহেব এই ঘটনা বলেন।
ডা. জাহাঙ্গীর আলম শিপনের বাবা মোহাম্মদ আবুল ফররাহ চাকরি করতে পাকিস্তানের করাচিতে। তাই ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় কর্মরত অবস্থায় পাকিস্তানে বন্দি হন। পরে আন্তর্জাতিক রেডক্রসের মাধ্যমে আফগানিস্তান হয়ে ১৯৭২ সালে দেশে আসেন। তখন ডা. জাহাঙ্গীর আলম শিপন ছিলেন মায়ের গর্ভে।
দেশে এসে মোহাম্মদ আবুল ফররাহ প্রথমে ঢাকায় এক্সপোর্ট ইমপোর্ট অফিসে চাকরি নেন। সেখান থেকে পদোন্নতি পেয়ে পরে সিলেট কাস্টমস অফিসে বদলি হন। পোস্টিং হয় তৎকালীন মৌলভীবাজার মহকুমার বর্তমান জুড়ী উপজেলায় শিলুয়া চা বাগান সন্নিকটে কাস্টম অফিসে।
শিলুয়া স্থলবন্দরে চাকরি করেন কাস্টমস ইন্সপেক্টর মোহাম্মদ আবুল ফররাহ। সেখানে কর্মরত থাকা অবস্থায় ১৯৭৬ সনের এপ্রিল মাসের ৪ তারিখ রাতে তিনি মারা যান। পরদিন মরদেহ দেশের বাড়িতে (নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ) নিয়ে যাওয়ার জন্য আনা হয় মৌলভীবাজার সার্কিট হাউসে।
এতদূর মরদেহ নিতে গেলে পচন ধরে যাবে। তাই সিদ্ধান্ত হয় মৌলভীবাজারেই দাফন করার। পরে সরকারি ব্যবস্থায় সার্কিট হাউস সংলগ্ন একটা কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।
কেবল এতটুকু তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছেন ছেলে ডা. জাহাঙ্গীর আলম। মৌলভীবাজার এসে বহুবার বাবার কবর খোঁজেছেন। কখনো এসেছেন বোনকে নিয়ে আবার কখনো ভাইকে নিয়ে। এসেছেন নিজে ছেলে মেয়ে নিয়েও। তবে নির্দিষ্ট করে কেউ শনাক্ত করতে পারেননি কোথায় বাবার কবর। শোকার্ত পরিবারটি দীর্ঘ চার দশকেরও বেশি সময় ধরে বেদনা বয়ে বেড়াচ্ছেন।
ডা. জাহাঙ্গীর আলম শিপন বলেন, এই জীবনে সব পেয়েছি কিন্তু বাবার সমাধীস্থল না পেলে সব কিছুই যেনো অপূর্ণ। বাবার কবরের সন্ধান চাই। আমার সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে বাবার কবর জিয়ারত করতে চাই। একবার বাবার কবরে হাত রাখতে চাই। যদি কেউ আমার বাবার কবরের খবর জেনে থাকেন দয়া করে একটু জানাবেন।