খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা এলাকার ফরিদা বেগম (৪২)। ১১ মাস আগে ঋণের টাকায় যান সৌদি আরব। সেখানে নির্মম নির্যাতন সইতে না পেরে ছোট্ট একটি পলিথিনের পুটলি নিয়ে দেশে ফিরেছেন।
‘১১ মাস পর আজ প্লেনে বসে ভালো খাবার মুখে দিলাম। আল্লার কাছে শোকরিয়া, জান নিয়ে দেশে ফিরতে পেরেছি।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিলেন, সৌদি আরব ফেরতর ফরিদা বেগম। বৃহস্পতিবার রাতে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তার সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের।
বর্বর অভিজ্ঞতা নিয়ে ফরিদার সঙ্গে এদিন ফেরেন আরও ৬৪ নারী। সবার চোখেমুখে হতাশার ছাপ। গৃহকর্মীর কাজের কথা বলে নেয়া হলেও তাদের দিয়ে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করানো হয়। চেষ্টা চলতো অসামাজিক কাজ করানোরও।
‘ঈদের দিনেও আমাদের কপালে জোটেনি ভালো খাবার। সামান্য রুটি আর হালুয়া খেয়ে ঈদের দিন পার করেছি।’ এ কথা বলতে বলতে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে থাকেন আরেক সৌদিফেরত খাদিজা বেগম। ৯ মাস কাজ করে কোনো বেতন পাননি তিনি।
খাদিজা জানান, বাংলাদেশ দূতাবাসে আশ্রয় নিয়েও নানা রকমের হয়রানির শিকার হন তিনি। ‘এখানেও ( দূতাবাস) খাবার-দাবার নাই। গাদাগাদি অবস্থা।’
বৃহস্পতিবার ফিরে আসা আরও কয়েকজন হলেন- নিলুফা বেগম, রুবিনা আক্তার, স্বপ্না, পিয়া, হাসি আক্তার, রোজিনা, শামিমা পারজানা, সাবিনা, লুবনা প্রমুখ।
কাপাসিয়ার সাবিনা জানান, চার মাস ১৩ দিন আগে পারভেজ নামে এক দালালের মাধ্যমে সৌদি আরব যান তিনি। ফলের ফ্যাক্টরিতে কাজের কথা বলে তাকে নিয়ে রিয়াদে এক বাড়িতে কাজ দেয় ওই দালাল। সেখানে নির্যাতন চালানো হয় তার উপর। এক মাস ২৫ দিন পর তিনি বাধ্য হইয়া পালিয়ে আসেন সফর জেলে (ইমিগ্রেশন ক্যাম্প)।’
শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন দেখিয়ে সাবিনা বলেন, ‘খাবার চাইলে মারধর করত। পানির লাইন বন্ধ করে আমারে দুই দিন বাথরুমে আটকাইয়া রাখছিল।’
ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, গত দুই মাসে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারীকর্মী সৌদি আরব থেকে তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে দেশে ফিরেছেন। তাদের অধিকাংশই সম্বল বলতে শুধু পরনের কাপড় নিয়ে এসেছেন।
উল্লেখ্য, জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য মতে, ২০১৭ সালে অভিবাসী নারীর সংখ্যা ছিল ১২ লাখ ১৯ হাজার ৯২৫ জন, যা মোট অভিবাসন সংখ্যার ১৩ শতাংশ। ১৯৯১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত অভিবাসন প্রত্যাশী নারী শ্রমিকদের একা বিদেশে যেতে বাধা দেয়া হলেও পরবর্তীতে ২০০৩ এবং ২০০৬ সালে কিছুটা শিথিল করা হয়। ২০০৪ সালের পর থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত নারী শ্রমিকের অভিবাসন হার ক্রমাগত বাড়তে থাকে। ২০১৫ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় মোট অভিবাসনের ১৯ শতাংশে।
এখন নির্যাতনের শিকার হয়ে সৌদি থেকে গত দুই মাসে শতশত নারী ফিরে এসেছেন। সৌদি আরবের বিভিন্ন এলাকায় কর্মরত নারী গৃহকর্মীরা মালিকদের অমানবিক নির্যাতন সইতে না পেরে ইমিগ্রেশন ক্যাম্পে (সফর জেল) আশ্রয় নেয়। রিয়াদে বাংলাদেশ দূতাবাস এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ অার্নার্স কল্যাণ বোর্ডের আর্থিক সহায়তায় তাদের দেশে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে।