বুধবার, ৯ অক্টোবর ২০২৪ খ্রীষ্টাব্দ | ২৪ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ



                    চাইলে বিজ্ঞাপন দিতে পারেন

এ বাধা শুধু তহুরার নয়, তা নারী প্রগতির অন্তরায়



বিজ্ঞাপন

মাহমুদ এইচ খান:
‘আমি তাবলিগে গিয়েছিলাম, তখন এলাকার অনেক হুজুর বলতেন, আপনি চিল্লা করেছেন আর মেয়ে ফুটবল খেলছে। ফুটবল খেলা নাজায়েজ। আমিও তাদের মতো ভাবতাম একসময়। কিন্তু এখন তা আর ভাবিনা। আমার মেয়েকে নিয়ে এখন আমি গর্ব করি।

কথাগুলো ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার কৃষক ফিরোজ মিয়ার। যার জীবন বদলে দিলেন তার ফুটবল খেলোয়াড় মেয়ে তহুরা খাতুন। দেশের নারী ফুটবলের অন্যতম বড় নাম এখন তহুরা। এ কিশোরীর পা দুটো এখন যেন মাঠে সোনা ফলায়। সে এখন এ দেশের সম্পদ। আমাদের গর্ব।

তহুরার বাবা একটি সংবাদ মাধ্যমকে জানান, আমি একদিন তহুরাকে বললাম, মারে ফুটবলটা তোমার জন্য ভালো হচ্ছে না। তুমি ফুটবল ছেড়ে দাও। মানুষ আমাকে বাজে কথা বলে। কারণ এসব পাপ। মেয়েদের ফুটবল খেলতে নেই।
কিন্তু তহুরা বলতো- আমি শুরু করলাম ফুটবল, এখন তুমি যদি বলো আমি খেলা চালিয়ে যেতে পারবো না তাহলে কেমনে হয়? তবে তুমি হুজুরদের বিশ্বাস করো না। সব মানুষ তো ভালো বলছে। তার খারাপ বলবেই আমি জানি। এভাবেই তহুরা খেলা চালিয়ে যেতো।’

যেই ফিরোজ মিয়াকে ধর্মের বাণী শুনিয়ে একটি আলোকে নিভিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিলো কাটমোল্লারা সেই তহুরা এখন ফিরোজ মিয়ার গর্বের সবচেয়ে বড় জায়গা। তহুরা কেবল বাবা ফিরোজ মিয়ার গর্বই নন, পুরো দেশের গর্ব। প্রতিপক্ষের ডিফেন্স চুরমার করে ম্যাচের পর ম্যাচ গোল করে যান তহুরা। হয়তো সেদিনে নাজায়েজ কাজ না করলে আজ সে দেশের সম্পদ হতে পারতো না। বাংলাদের নারীদের কৃতিত্ব বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে পারতেন না।

এই তহুরাদের দমাতে এদেশে মিছিলও করেছিলো ধর্ম ব্যবসায়ীরা। তারা বলেছিলো বাংলার মাটিতে নারীদের ফুটবলের মাঠে নামিয়ে তাদের অপমান করা হচ্ছে। নারীদের বেপর্দা করে পাপাচার করা হচ্ছে। সেদিন হয়তো এই তহুরা মনে মনে প্রশ্ন তুলেছিলো, ঘরবন্দি করে নারীকে পনণ্য বানানো কি খুব সম্মানের ছিলো? হাদিস কালাম রটিয়ে নারীকে পুরুষের দাসী বানানোতে তাদের খুব মর্যাদা দেয়া হয়েছিলো? দেশবাসী আজ বিচার করুক তবে আজকের জহুরা প্রকৃত সম্মান পেয়েছে কি-না!

সেদিন যদি তহুরা থেমে যেত তাহলে আজ রক্তচোষা হায়নাস্বরূপ ধর্মীয় পুরুষতন্ত্রের জয় বহাল থাকতো। আজ কিন্তু পুরুষের পরাজয় হয়নি। সহাবস্থান আর মর্যাদাবোধ সমানে সমান হয়েছে। নারীরা চাইলেই পারে এগিয়ে দিতে একটি দেশ, একটি সমাজ ও একটি জনপদকে তার সাক্ষ্য রেখেছে সে। এদেশের মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেক নারীকে সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা মানে অনেক তহুরাকে হারানো। নির্মম পরাজয় তাদের চোখে মুখে ঢেলে দেয়া। নারী চোখে স্বপ্ন সাজানোর বিপরীতে পুরুষচোখে তাদের শো-পিস বানিয়ে রাখা হচ্ছে। আর এক্ষেত্রে ধর্মীয় আগ্রাসনই বাধা। নারী প্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করতে ধর্মই কারণ হলে একদিন এদেশের নারীরা তারও বিহিত করে দেখাবে, এট আমার বিশ্বাস।

তহুরার বাবা বলছিলেন মেয়েরা চাইলে সব পারে যার প্রমাণ তার মেয়ে। দেশের শীর্ষ এক সংবাদ মাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘আমার এ মেয়েটা (তহুরা) অনেক লাজুক। বাড়িতে গেলে ঘরেই থাকে। কোথাও যায় না। তাই বলে কাজে কিন্তু পটু। জানেন? তহুরা ট্র্যাক্টর চালানো ও ধান রোপণসহ সব ধরণের কৃষি কাজ পারে। আমাকে কাজ করতে দেখে মাঝেমধ্যে বলতো– বাবা তুমি এত পরিশ্রম করো কেন? তাহলে তো তুমি বেশি দিন বাঁচবা না। আমি বলতাম, তোদের লালন-পালন করতে আমাকে তো কষ্ট করতেই হবে। তহুরা আমাকে বলতো, আমিও পরিশ্রম করে তোমার কষ্ট কমিয়ে দেবো’

আজ তহুরার বাবাকে হয়তো আর কষ্ট করতে হবেনা। আর করলেও তা পূর্ণতার হাসিতে তার পেশাকে ধরে রাখতে আবার মাঠে যাবেন। কৃষিকাজ করবেন। একজন কৃষকের মেয়ে একটি দেশকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে পারে তা জানান দিবেন। লড়াকু তহুরা তোমায় সালাম।

ধর্ম তহুরাদের দমাতে পারে কিন্তু তাদের সম্মান রক্ষার্থে ধার্মিকদের নিয়ন্ত্রণ করতে বরাবর ব্যর্থ হয়েছে। সুতরাং তাদের দিকে এখন বৃদ্ধাঙ্গুলি দিতে দেরি করছেনা নারীরা। বাংলাদেশের এখন সব খেলায় নারী দল রয়েছে। এবং তারা দারুণ খেলা উপহার দিচ্ছে বিশ্বকে। এই অগ্রগতি বহমান থাক অনন্ত। আর যাই হোক আমাদের মেয়েরা যাতে ধর্ম আর খেলাকে গুলিয়ে ফেলে না।

সেদিন দেখলাম পাকিস্তানের এক খেলোয়াড় হিজাব পরে হাটুর উপর শর্ট পরে বলে লাত্থি দিচ্ছে। তাও বাঙালি মেয়েকে ফাউল করে। এরা খেলা ও ধর্মের কোনটাই বুঝেনা আমার মতে। আমাদের মেয়েরা তা অন্তত ভালো বুঝেছে। নারী প্রগতি ধর্মের ডালে দমবেনা আর। আরও এগিয়ে যাক আমাদের নারীরা। সমানে সমান হোক নারী-পুরুষের মানবিক সহাবস্থান। এমন দৃঢ়তায় খেলাধুলা ছাড়া অন্যান্য সবক্ষেত্রে এগিয়ে যাবে আমাদের মেয়েরা। তোমাদের আগামী প্রসারিত হচ্ছে।

লেখক: সাংবাদিক ও সমাজকর্মী
mahmud.press@gmail.com


মতামত বিভাগে প্রকাশিত লেখা লেখকের একান্ত নিজস্ব। লেখার বিষয়বস্তুর যথার্থতা নিয়ে শাহবাজপুর.কম আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।