মুনজের আহমদ চৌধুরী :: আমাদের মৌলভীবাজার জেলা শহরের একমাত্র লাইব্রেরিটা বন্ধ হয়ে গেছে। নতুন ভবনে পুরনো লাইব্রেরিটা মামা যাচ্ছে চোখের সামনে। মৌলভীবাজার পাবলিক লাইব্রেরি। ষাট বছরের বেশি সময় ধরে এ লাইব্রেরি মৌলভীবাজারের মুক্তবুদ্ধি ও সাংস্কৃতিক চর্চার কেন্দ্রস্থল ছিল। ষাট থেকে শুণ্য দশক পর্যন্ত মৌলভীবাজারের প্রজন্ম বিনির্মাণে এ লাইব্রেরির কাছে আমাদের অনেক ঋণ। আমার শহরের আজকের প্রজন্মের অনেকে এসব কথার উত্তরে জানি বলবেন, পৃথিবী তো ডিভাইসে চলে যাচ্ছে, ই-বুকের বাজারে ছাপা বইয়ের পাঠক কম।
তাদের কী করে বলি, বুঝাই, পুরনো লাল ইটের লাইব্রেরির আগের ভবনটা, লাইব্রেরির পুকুর পার আমার, আমাদের উত্তর প্রজন্মের মৌলভীবাজারের হাজার হাজার মানুষের শৈশবের, তারুণ্যের অংশ। ২০০৫ বা ২০০৬ সালে পড়বার জন্যই লাইব্রেরির সাধারণ সদস্য হয়েছিলাম।
২০০৮ সালে যৌথ বাহিনীর ক্ষমতার আমলে এ লাইব্রেরির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সরাসরি ভোটে পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তখন কাজ করতাম অধুনালুপ্ত দৈনিক সিলেট প্রতিদিনে মৌলভীবাজার প্রতিনিধি হিসেবে।
সে নির্বাচনে আমি বয়সে সর্বকনিষ্ঠ প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সর্বচ্চো ভোটে নির্বাচিত হই। পাবলিক লাইব্রেরির আজীবন সদস্য জেলা ও শহরের পড়ুয়া, বর্ষীয়ান গুরুজন আর জনপ্রতিনিধিরা ছিলেন সে নির্বাচনের ভোটার। সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী মরহুম সৈয়দ মহসীন আলী ছিলেন আমার নমিনেশন ফরমে প্রস্তাবকারী।
আর এখন কর্কট ব্যাধি ক্যান্সারে সাথে লড়াই করা সিলকো পাইপ ইন্ডাস্ট্রির মালিক তারেক আহমেদ চাচা ছিলেন সমর্থনকারী। সে নির্বাচনের আগে একজন মানুষকেও আমি ভোটের আশায় সদস্য করা তো দুরে থাক, সেসবের পথও মাড়াইনি।
তখনও লাইব্রেরির পদাধিকার বলে সভাপতি ছিলেন জেলা প্রশাসক। প্রতিটি সভায় কর্মচারীদের বেতন নিয়ে, লাইব্রেরির সংকট, সমস্যা নিয়ে কথা বলতাম। পরিচালনা পর্ষদে মানুষ যে হতাশাজনক বাস্তবতায় আমাকে সবচেয়ে বেশি ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছিলেন, আমি আমার ঈমান ও বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থেকে চেষ্টা করেছি লাইব্রেরির কাজ করতে। কর্মচারীদের বেতন বন্ধ হলেই লাইব্রেরিয়ান সজল দা আজীবন সদস্যের কয়েকটা ফরম তুলে দিয়ে বলতেন টাকার ব্যবস্থা করো। এখলাছ ভাই, আকবর চাচা, খালিক চাচাসহ কত মানুষকে যে লাইব্রেরির আজীবন সদস্যের ফরম পুরণ করিয়েছি। ব্যক্তিগত উদ্যোগে বহু বই সংগ্রহ বা বেতন না পাওয়া স্টাফদের অসহায় চাহনির জবাবে কি করতে পেরেছি, কী পারিনি সে ব্যক্তিগত হিসেব অনুল্লেখ থাকাই সমীচিন।
আমাদের নির্বাচিত আমলে সাধারন সম্পাদক নজরুল ইসলাম মুহিবের নেতৃত্বে কোটি টাকা ব্যায়ে লাইব্রেরীর আজকের সুবিশাল ও সুপরিসর ভবনটি নির্মিত হয়।
জীবনের ফেরে আম সহ সে পরিষদের অগ্রজ কন্ঠশিল্পী মাহবুবুর রহমান শিবলু, কাবেরী রায়, খন্দকার খালিকুর রহমানসহ অনেকেই প্রবাসী হন।
অত্যান্ত দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, ২০০৮ সালে আমরা নির্বাচিত হবার পর গত ১১ বছরে লাইব্রেরির পরিচালনা পর্ষদে আর কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। পরিষদের মেয়াদ উত্তীর্ণ হবার পর শুধুমাত্র লাইব্রেরির সেক্রেটারি হবার জন্য পরিষদেরই একজন খোঁড়া অজুহাতে আদালতে মামলা দায়ের করেন। পরে অবশ্য সে মামলা আদালতে খারিজ হয়। সে সময়কালে লাইব্রেরি পরিচালনায় একটি এডহক কমিটি গঠিত হয়।
মৌলভীবাজারের তৎকালীন জেলা প্রশাসক কামরুল হাসান অচলাবস্থা নিরসনে চেষ্টা করলেও সদ্য বিদায়ী জেলা প্রশাসক তোফায়েল ইসলাম তার প্রায় তিন বছর মৌলভীবাজারে দায়িত্ব পালনকালে এ ব্যাপারে ছিলেন সম্পুর্ণ নীরব। লাইব্রেরীর সভা ডাকার জন্য এডহক কমিটি বহু অনুরোধ করা তিনি সাড়া দেননি। একবারও মিটিং ডাকেননি। জেলা পরিষদকে বার বার অনুরোধ করা হলেও জেলা পরিষদও লাইব্রেরির চাবি বুঝে নেবার আগে তারাও কোনো সাহায্য করতে রাজি হয়নি।
শুধু লাইব্রেরির সম্পাদক পদটি নিয়ে সুবিধাভোগী চক্রগুলির ইতরামি সৃষ্ট এ অচলাবস্থার কারণে পত্রিকার বিল, কর্মচারী বেতন দেয়া বন্ধ হবার প্রেক্ষিতে লাইব্রেরি আজ পুরোপুরি বন্ধ হবার পথে।
এ কথা স্বীকার করতেই হবে, সরকারী কলেজের সাবেক ভিপি নাট্যকার আবদুল মতিন আমাদের বহু মানুষকে সম্পৃক্ত করে লাইব্রেরির ২০০৮ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠান ও লাইব্রেরিতে গণতন্ত্রায়নে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু সরকারি চাকরিরত থাকায় আইন ও গঠনতন্ত্র অনুসারে তিনি সেসময় পরিষদের নির্বাচিত সদস্যদের সমর্থন থাকা সত্ত্বেও লাইব্রেরির সম্পাদক হতে পারেননি।
মাস তিনেক আগে মার্চে এক শুক্রবারে ম্যানেজার স্টলের উল্টোদিকে গাড়ি পার্ক করে রাস্তা পেরুবো, এমন সময় পেছন থেকে ডাক দিলেন মতিন ভাই। আমাদের শহরের বাগ্মী বক্তা, ভিপি মতিন ভাই। সাধনার বেঞ্চিতে বসে কথা হলো খানিকক্ষণ। মতিন ভাইয়ের সঙ্গে সেদিন আমাদের শহরের পুর্নকালীন কবি পুলক কান্তি ধরও ছিলেন।
মতিন ভাই আমাকে বললেন, তিনি উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করবেন। সহযোগিতা চাইলেন। আমি তাকে বললাম, আপনাকে ভাইস চেয়ারম্যান পদে আমি সমর্থন করি না, আর সেটা আপনার জায়গাও নয়। আপনার জায়গা তো লাইব্রেরি অথবা শিল্পকলা।
সেদিন তার সাথে কথা যা হয়েছিল, প্রায় সবটাই লাইব্রেরি নিয়েই। তিনি লাইব্রেরি নিয়ে সৃষ্ট বিভিন্ন সংকটের কথা বললেন। এক পর্যায়ে আমি তাকে বললাম, বর্তমান এমপির সাথে আমার দেখা যোগাযোগ দুটোই কম। তারপরও চলুন আমি নিজে আপনাকে বর্তমান এমপি নেছার আহমেদের কাছে নিয়ে যাব… লাইব্রেরিটা বন্ধ হয়ে যাবে মতিন ভাই। মতিন ভাই বললেন জানাবেন, আর জানাননি।
দুই. দেশে স্থায়ীভাবে না থাকবার বাস্তবতায় লাইব্রেরির আজকের এ অচলাবস্থায় কোন কোন পক্ষগুলির দায় কতটুকু, সে হিসেবটা পুরোপুরি আমার জানা নেই। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমাদের লাইব্রেরিটি বন্ধ হয়ে গেছে। আমাদের বহু প্রজন্মের শ্রমে, ঘামে আর ভালবাসার ঠিকানায় এখন ঝুলছে অচলাবস্থার তালা। এর কারন শুধু পদবি দখল আর টিকিয়ে রাখবার লড়াই।
শুধু পাবলিক লাইব্রেরি নয়, জেলা শিল্পকলা একাডেমী, রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি কোথাও দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচিত নেতৃত্ব নেই। এ শহরে একদিন মঞ্চনাটক, গান কবিতায় সন্ধ্যাগুলি জেগে থাকত। শহরের পাবলিক লাইব্রেরি, শিল্পকলা, ম্যানেজার-রাধিকা স্টল, আজকের ওয়েস্টান লাগোয়া ষ্টুডিওপাড়ায় বহু বিকেল কাটত পড়ুয়া পাঠকের আড্ডায়। আজ সেসব কেবলই স্মৃতি।
তিন. আমাদের সদরের এমপি নেছার আহমেদকে চলতি অধিবেশনেও মৌলভীবাজারের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে সংসদে কথা বলতে দেখেছি। কথা আমাদের এমপিরা বলেছিলেন গত সংসদেও। কুলাউড়ার সাবেক এমপি আব্দুল মতিনের ব্যক্তিগত সম্পদ একবার এমপি হয়ে যতগুণ বেড়েছে, তার শতকরা দশভাগ কাজও কি কুলাউড়ায় সদ্য সাবেক আমলে হয়েছে?
মৌলভীবাজারের পাশের দুই জেলা হবিগঞ্জের দিকে তাকান। সুনামগঞ্জে বিআরটিসির বাস চলছে, হবিগঞ্জে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল কলেজ সব আছে। আর আমাদের জেলা সদরের একমাত্র হাসপাতালটিতে ডাক্তার নেই, চিকিৎসার প্রযুক্তির সুবিধা নেই। বিদ্যুতের, রাস্তাঘাটের কী বেহাল অবস্থা। জেলায় পাসপোর্ট অফিস থেকে বিঅারটিএ সবখানে দালাল চক্রের চেহারা পাল্টায়। এমপি মেয়র নতুন করে কিছু মানুষ ক্ষমতাবান হন, ক্ষমতা-হারান। এটুকুই।
শ্রদ্ধেয় এম সাইফুর রহমান, সৈয়দ মহসীন আলীর মতো মানুষরা মন্ত্রী এলাকায় থাকাবস্থায় কোনো অনুষ্ঠানে খেতে বসলে দেখতেন সাংবাদিকরা খেতে বসেছেন কি না। আমাদের বড়লেখার মন্ত্রী সজ্জন ভালো মানুষ। কিন্তু তাঁর এলাকাতেই সাংবাদিকতায় আত্মনিবেদিত ছেলে, মুক্তিযোদ্ধা পিতার নীতিবান শিক্ষিত ছেলেগুলির যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও একটা চাকরি পায় না।
কুলাউড়ার বরমচালে এত বড় রেল দুর্ঘটনা ঘটল! কিন্তু স্থানীয় যিনি এমপি তাকে এবার কুলাউড়ার হাজার হাজার মানুষ জেল খেটে এমপি বানিয়েছে। মস্ত বড় জাতীয় নেতা তিনি। কিন্তু এত বড় নজীরবিহীন দুর্ঘটনার পরও এখন পর্যন্ত এলাকায় আসার সময় হয় নি সাংসদ সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদের। অন্তত মিথ্যে করে হলেও রাষ্ট্রীয় বাহনে দুর্ঘটনায় খুন হওয়া মানুষগুলির পরিবারকে সান্তনার বাণীটুকু শোনাতে আসবার সময়ও হয়নি তাঁর। আফফোস হয়। খুব আফসোস হয়। আমাদের নেতারা ফেসবুকে আছেন, সংসদে আছেন। পাঞ্জেগানা মসজিদ উদ্বোধনে আছেন।
চার. ঘুষ ছাড়া গত দশ বছরে মৌলভীবাজার জেলার কতজন নাগরিক সরকারী চাকরি পেয়েছেন? কত মানুষ চাকুরী তো দুরে থাক, ঘুষের টাকাও ফেরৎ পাননি। জেলাজুড়ে পলিটিক্যাল ক্যাডারদের উপদ্রুপ। কিন্তু বিসিএস ক্যাডারে অামাদের সন্তানরা নেই বললেই চলে। জেলা কোটা পুরণ করার মতো প্রার্থীই নেই।
তবু গত ক’বছরের যে মৌলভীবাজারের তারুণ্য- তাদের উপরই এখন আশা করে থাকি। আমাদের ছোট ভাইবোনগুলো যখন বড় হবে, তখন হয়তো এ চিত্র পাল্টাবে। সেই আশাতে প্রতিমাসে বিদেশ থেকে ভর্তুকি দিয়ে শহরে এখনো একটা বিসিএসের কোচিং সেন্টার চালাই।
লেখক: সাংবাদিক, লন্ডন।
আরও পড়ুন:
গোটা ইউরোপে তীব্র দাবদাহ, স্পেনে দাবানল
‘০০৭’ গ্রুপের ভয়ঙ্কর অপারেশন
সিলেটে পারভিন হত্যায় স্বামী রুবেলের স্বীকারোক্তি, ‘গলা টিপে হত্যার পর লাশ ঝুলিয়ে রাখি’
বড়লেখা সদর ইউপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান লুৎফুর
বড়লেখায় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ডের ঈদ পুনর্মিলনী
বড়লেখার কুখ্যাত ডাকাত ফুলু সিলেটে গ্রেপ্তার
সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জে ইঁদুরের বিষ খেয়ে স্বামী-স্ত্রীর আত্মহত্যা
আইএস-এ যোগ দেওয়া সিলেটের সেই লন্ডনী পরিবারের ১২ সদস্যের সবাই মারা গেছেন
মিথ্যা বলছেন মিন্নি, নয়নের সঙ্গেও বিয়ে হয়েছিল তাঁর
শ্রীমঙ্গলে নাম ধরে ডাকায় শিক্ষার্থীকে কুপিয়ে জখম!
অবশেষে বরমচাল স্টেশন থেকে ছেড়ে গেল পাহাড়িকা এক্সপ্রেস
ব্রিজ আতঙ্কে কুলাউড়ার বরমচালে আটকা পড়েছে পাহাড়িকা এক্সপ্রেস
রিফাত হত্যা: আসামিদের ধরতে পুলিশের রেড এলার্ট
ওসমানীতে নামতে না পেরে ফের ঢাকায় ফিরে গেল বিমান
কুলাউড়ায় ট্রেন দুর্ঘটনা: আতঙ্ক কাটছে না যাত্রীদের
সুনামগঞ্জে পাহাড়ি ঢলে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত