রিপন দে :: বাড়িতে প্রায় একশ মানুষ। সবাই জেলার কোনো না কোনো গ্রাম থেকে এসেছে। এখানে কেউ আওয়ামী লীগ করে কেউ বিএনপি। তবে সবচেয়ে বেশি সাধারণ মানুষ। সবার অপেক্ষা সৈয়দ মহসিন আলী ঘুম থেকে উঠলে দেখা করবেন। এখানে যারা আছেন সবারই কোনো না কোনো সমস্যা আছে যার সমাধান একমাত্র মহসিন আলীই দিতে পারেন।
মহসিন আলী ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় এলেন। একে একে সবাই বলতে থাকলেন নিজের সমস্যার কথা। কেউ নিজে অসুস্থ, কারো মা অসুস্থ, কারো আবার সন্তান অসুস্থ। সবার প্রয়োজন টাকা। টাকার জন্য চিকিৎসা করাতে পারছেন না
মহসিন আলী একে একে সবার কথা শুনলেন কাউকে ৫০০ কাউকে ১০০ কাউকে ২০০ টাকা দিলেন। যাদের সমস্যা বড় তাদেরকে একটা নির্দিষ্ট টাইম বলে দিলেন আসার জন্য।
এখানে আরো কিছু মানুষ আছে যারা কোনো অন্যায় করে ফেলেছেন। যখন বুঝতে পেরেছেন ভুল করেছেন তখন এসেছে মহসিন আলীর কাছে যেন তিনি বিষয়টা মিটমাট করে দেন।
মহসিন আলী সবার কথা শুনলেন মাঝে মাঝে উচ্চস্বরে চিৎকার দিয়ে ধমক দিলেন ‘আমি পারবনা আমি কে? তোমার জন্য তদবির করব বা অন্যায় করার আগে মনে ছিল না। মাঝে মাঝে এক দুইটা গালিও দিলেন।’ উত্তেজিত হয়ে বারান্দা থেকে ঘরে চলে গেলেন তিনি পারবেন না বলে। কিন্তু বারান্দায় বসে থাকা একটি মানুষও ফিরে যাচ্ছেন না। কারণ তারা জানেন মহসিন আলী ঠিকই তাদের সাহায্য করবেন। একটু পরে সবার জন্য চা এলো। মহসিন আলীও আবার বেরিয়ে এলেন।
একে একে ডেকে নিলেন। কাউকে ধমক দিলেন। কাউকে বোঝালেন। সবার সব কাজ সমাধান করে দিলেন। যাদের তদবির দরকার ফোনেই বলে দিলেন সামনে বসে।
এমনটাই ছিল প্রয়াত সমাজ কল্যাণ মন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলীর বাড়ির প্রতিদিনের পরিবেশ। দলীয় যেকোনো ব্যাপারে সৈয়দ মহসিন আলী যেমন ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রকৃত আদর্শাবন মানুষ তেমনি অসুস্থ বা অসহায় মানুষের কাছে তিনি ছিলেন দল-মতের ঊর্ধ্বে। তাই তার প্রয়ানে হাহাকার ছড়িয়েছে বিরোধী শিবিরেও।
১৪ সেপ্টেম্বর এই মহান মানুষটার ৩য় মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি সংসদ নির্বাচন করার আগে যে ৩ বার পৌর মেয়র হয়েছিলেন তার সিংহভাগ ভোট এসেছে বিরোধী শিবির থেকেই। রাজনীতি করতে গিয়ে তিনি প্রায় ২৫ কোটি টাকার পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করেছেন। তিনি মারা যাওয়ার পর তার পরিবার জানতে পারে তিনি আরো ৫ কোটি টাকা ঋণ করে গেছেন।
সৈয়দ মহসিন আলী ১৯৪৮ সালের ১২ ডিসেম্বর মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল সড়কের দর্জিমহলে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ২৩ বছর বয়সে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা, নিরাহঙ্কারী, সর্বোপরি এক উদার হৃদয়ের মানুষ ছিলেন প্রয়াত সমাজকল্যাণ মন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী। ছাত্রলীগের একজন সদস্য হিসেবে মহসিন আলী ছাত্রজীবনেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। তৃণমূল থেকে উঠে আসা কর্মপ্রিয়, সদাহাস্যোজ্জ্বল ও বন্ধুবৎসল সৈয়দ মহসিন আলী সাধারণ মানুষের হৃদয়ে তাই দ্রুত স্থান করে নিয়েছিলেন এক প্রকৃত নেতা হিসেবে।
ব্যক্তি জীবনে তার ৩ মেয়ে থাকলেও এলাকায় ছিল তার শত শত ছেলে মেয়ে। শত শত মানুষ তাকে বাবা বলে ডাকতেন। তাদেরই একজন রমজান মিয়া।
প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বললেন, মহসিন আলীকে আমি যেমন বাবা বলে ডাকতাম তেমনি তিনি আমাকে ছেলের মতো দেখতেন। সব সময় সাহায্য করতেন। ঈদে কাপড়ও কিনে দিতেন।
মহসিন আলীর বাড়িতে খাবার ছিল উন্মুক্ত। ঢাকা থেকে তখন যত বড় বড় সাংবাদিক, কবি, সাহিত্যিকরা মৌলভীবাজারে আসতেন তাদের সবার জায়গা হতো মহসিন আলীর বাড়িতে। যেটা তার মৃত্যুর পর মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান এবং কলামিস্ট পীর হাবিব তাদের লেখায় উল্লেখ করেছিলেন।
মহসিন আলীর বাড়িতে কখনো কোনো গেটও ছিল না। যার যখন ইচ্ছা যেতে পারতেন। এখনো সেরকমটাই আছে।
কিছু দিন আগে পুরান ঢাকা থেকে মানিক সাহা নামের এক পর্যটক আসেন। দেখা হয় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। তিনি ইচ্ছে পোষণ করেন মহসিন আলীর বাড়ি দেখবেন। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে তিনি মহসিনের বাড়িতে ঢুকলেন। ঘরেও গেলেন একেবারে বেডরুম পর্যন্ত। তিনি অবাক হলেন বেডরুমে যাওয়ার পরও কেউ জানতে চাইলনা কেনো এসেছেন? কী চায়? সবচেয়ে বেশি অবাক হলেন বাড়িতে কোনো গেট নেই। পুকুরে যে যার মতো গোসল করছে। আবার কিছু ছিন্নমূল শিশু উঠানে খেলা করছে।
এটাই মহসিন আলীর সৃষ্টি করা পরিবেশ যা এখনো আছে। মন্ত্রীর এ বাড়িটি সবার জন্য দিন-রাত উন্মুক্ত। বাড়িতে ঢোকার জন্য কারও অনুমতি নিতে হয় না। ছিন্নমূল মানুষরা যেকোনো সময় বাসায় ঢুকে নিজের হাতে ফলমূল খেতে পারে। পুকুর থেকে মাছ ধরে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু কেউ তাতে বাধা দেবে না। বাড়িতে ভিক্ষুকরা ভিক্ষার জন্য গেলে খালিহাতে ফিরিয়ে দেননি কোনোদিন। মাঝে মাঝে বড় বড় গরু জবাই করে শিরনি খাওয়াতেন মানুষকে।
মৌলভীবাজার পৌরসভা মেয়র হিসেবে তিনবার নির্বাচিত হন তিনি। পরে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় থেকে শ্রেষ্ঠ পৌরসভা মেয়র নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে মৌলভীবাজার সদর আসনে সাবেক অর্থমন্ত্রী মরহুম এম সাইফুর রহমানকে হারিয়ে তিনি বিজয়ী হন।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পুনঃনির্বাচিত হওয়ার পর ওই বছরের ১২ জানুয়ারি মন্ত্রী হিসেবে শপথগ্রহণ করেন তিনি।
পরে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। মন্ত্রী হওয়ার আগে অসুস্থ হয়ে বেশ কিছুদিন আইসিইউতে থাকেন মহসিন আলী। অসুস্থতার পর কিছুটা খিটখিটে মেজাজের হয়ে গেলেও বদলাননি সাধারণ মানুষের কাছে। মন্ত্রীর মিন্টো রোডের বাড়িতে ঋণ করে ৬০ লাখ টাকা খরচ করেছিলেন। দু’খানি ঘর বানিয়েছিলেন। প্রত্যন্ত এলাকা থেকে আসা অসুস্থ মানুষের থাকার জন্য ব্যবস্থা করেছিলেন।
থাকা-খাওয়ার এলাহী আয়োজন ছিল মিন্টো রোডের সেই বাড়িতে। এলাকার যেকোনো অসুস্থ মানুষ শুধু যাওয়ার ভাড়া নিয়ে পৌঁছে যেত মহসিন আলীর কাছে। বাকিটা মহসিন আলী দেখতেন। থাকা খাওয়া সব মিন্টো রোডের বাড়িতেই হতো।
তখনকার সময়ে তার ব্যক্তিগত ফটোগ্রাফার ছিলেন রঞ্জিত জনি। তিনি জানান, মিন্টু রোডের বাড়িতে যত রোগী নিয়মিত থাকত তত রোগী অনেক হাসপাতেও ছিল না।
মহসিন আলী আসক্তি ছিল দুটো জিনিসের প্রতি। একটি গান অপরটি সিগারেট। তার প্রায় ৪ হাজার গান মুখস্থ ছিল। যেকোনো অনুষ্ঠানে বক্তৃতার মধ্যেই তিনি গান ধরতেন।
মহসিন আলী এত যে টাকা খরচ করতেন তার উৎস নিয়ে প্রশ্ন ওঠে যখন তিনি মহা ধুমধামে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু স্থানীয়রা জানতেন তিনি রাজনীতি করতে গিয়ে প্রায় ২৫ কোটি টাকার পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করেছিলেন। এমনকি যে মেয়ের বিয়ে নিয়ে বিতর্ক উঠেছিল তিনি সেই মেয়ের বিয়ের জন্যই মন্ত্রী থাকা অবস্থায় ২ কোটি টাকার পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করেছিলেন।
এসব বিষয়ে মহসিন আলীর সহধর্মিনী মৌলভীবাজার সদর আসনের এমপি সৈয়দা সায়রা মহসিন বলেন, নিজের সম্পদ মানুষের মাঝে বিলিয়ে দিতে পারলেই মহসিন আলী সম্পদ উপার্জনের আনন্দ পেতেন। তিনি প্রায় ২৫ থেকে ৩০ কোটি টাকার সম্পদ বিক্রি করেছিলেন রাজনীতিতে এসে। এমনকি মারা যাওয়ার পর জানা যায় ৫ কোটি টাকা দেনা আছে।
তিনি আরো বলেন, কত রাত যে ঘুম থেকে উঠে তার মেহমানদের জন্য রান্না করতে হয়েছে সে হিসেব নেই। বলতে পারেন সারা জীবনই এমন গেছে। যদিও পরে আমি অভ্যস্থ হয়ে গেছি। এখনো নেতাকর্মীরা এলে আমি নিজেই রান্না করে খাওয়াই।
মহসিন আলী জনপ্রিয় ছিলেন বিরোধী শিবিরেও। সবাই তাকে শ্রদ্ধা করত।
মহসিন আলী সম্পর্কে মৌলভীবাজার জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলার চেয়ারম্যান ভিপি মিজানুর রহমান বলেন, ওনার মতো নেতা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আমি যখন প্রথম ভিপি নির্বাচিত হই উনি ছিলেন তখন পৌর মেয়র। ওনার সঙ্গে দেখা করতে যাই, উনি আমাকে বুকে টেনে নিয়ে সাধারণ ছাত্রের জন্য কাজ করার উপদেশ দেন। উনি বিরোধীদলের হলেও রাজনীতিতে আমাদের আজন্ম অভিবাবক ছিলেন।