দেশে দিনে দিনে জলাশয় কমে যাচ্ছে কিন্তু জলাশয় কমে গেলেও আমাদের প্রচুর নদী ও খাল রয়েছে যেখানে সারা বছর মাছ চাষ করা যায়। আর এসব জলাশয়ে মাছ চাষের সহজ উপায় হচ্ছে খাঁচায় মাছ চাষ করা। এ পদ্ধতিতে মাছ চাষ করে মাছের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার কারণে দেশ-বিদেশে খাঁচায় মাছ চাষ ক্রমাগতভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বিভিন্ন ধরনের জলাশয়ে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ উপযোগী আকারের খাঁচা স্থাপন করে অধিক ঘনত্বে বাণিজ্যিকভাবে মাছ উৎপাদনের প্রযুক্তি হলো খাঁচায় মাছ চাষ। এতে জায়গা কম লাগে এবং অধিক লাভজনক।
খাঁচায় মাছ চাষের সুবিধা, উপযোগী স্থান, খাঁচার ঘনত্বসহ বিস্তারিত তথ্য জানিয়েছেন মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলা মৎস কর্মকর্তা সুলতান মাহমুদ।
খাঁচায় মাছ চাষে সুবিধা
ভাসমান খাঁচায় মাছ চাষ করলে পুকুরের ন্যায় জলাশয়ের প্রয়োজন হয় না।
প্রবাহমান নদীর পানিকে যথাযথ ব্যবহার করে মাছ উৎপাদন বাড়ানো যায়।
মাছের বর্জ্য প্রবাহমান পানির সঙ্গে অপসারিত হয় বিধায় পানিকে দূষিত করতে পারে না।
মাছের উচ্ছিষ্ট খাদ্য খেয়ে নদীর প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজাতির প্রাচুর্য্য বৃদ্ধি পায়।
প্রবাহমান থাকায় প্রতিনিয়ত খাঁচার অভ্যন্তরের পানি পরিবর্তন হতে থাকে ফলে পুকুরের চেয়ে অধিক ঘনত্বে মাছ চাষ করা যায়।
পুকুরে চাষকৃত মাছের চেয়ে খাঁচায় চাষকৃত মাছ বেশি সুস্বাদু।
খাঁচা স্থাপনের উপযোগী স্থান
খাঁচা স্থাপনের জন্য উপযোগী, নদীর এমন অংশ যেখানে একমুখী প্রবাহ কিংবা জোয়ার ভাটার শান্ত প্রবাহ বিদ্যমান। নদীর মূল প্রবাহ যেখানে অত্যাধিক তীব্র স্রোত বিদ্যমান সে অঞ্চলে খাঁচা স্থাপন না করাই ভাল।
মূল খাঁচা পানিতে ঝুলন্ত রাখার জন্য ন্যূনতম ১০ ফুট গভীরতা থাকা প্রয়োজন। যদিও প্রবাহমান পানিতে তলদেশে বর্জ্য জমে গ্যাস দ্বারা খাঁচার মাছের ক্ষতি হওয়ার সম্ভবনা কম। তথাপি খাঁচার তলদেশ নিচের কাদা থেকে ন্যূনতম ৩ ফুট ব্যবধান থাকা আবশ্যক।
স্থানটি লোকালয়ের নিকটে হতে হবে যাতে সহজে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।
খাঁচা স্থাপনের স্থান থেকে যোগাযোগ ব্যবস্থা সুন্দর হতে হবে যাতে সহজে উৎপাদিত মাছ বাজারজাত করা যায়।
খাঁচা স্থাপনের কারণে যাতে কোনোভাবেই নৌ চলাচলে বিঘ্ন না ঘটে এমন স্থান হতে হবে।
সর্বোপরি খাঁচা স্থাপনের জায়গাটি এমন হতে হবে যাতে শিল্প বা কলকারখানার বর্জ্য কিংবা পয়ঃনিষ্কাশন পানি অথবা কৃষিজমি থেকে বন্যা বা বৃষ্টি বিধৌত কীটনাশক প্রভাবিত পানি নদীতে পতিত হয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে খাঁচার মাছ মারা যেতে না পারে।
ভাসমান খাঁচা তৈরির প্রয়োজনীয় উপকরণ
খাঁচা তৈরির মূল পলিইথিলিন জাল (৩-৪ ইঞ্চি থেকে ১ ইঞ্চি মেসের) রাসেল নেট (খাদ্য আটকানোর বেড়া তৈরিতে) নাইলনের দড়ি ও কাছিকভার নেট বা ঢাকনা জাল (পাখির উপদ্রব থেকে রক্ষার জন্য) ১ ইঞ্চি জিআই পাইপ (৭০ ফুট প্রতিটি খাঁচার জন্য) ফ্রেম ভাসমান রাখার জন্য শূন্য ব্যারেল-ড্রাম (২০০ লিটারের পিভিসি ড্রাম, ওজন ৯ কেজির ঊর্ধ্বে) খাঁচা স্থির রাখার জন্য গেরাপি (অ্যাঙ্কর) ফ্রেমের সঙ্গে বাঁধার জন্য মাঝারি আকারের সোজা বাঁশ (প্রয়োজনীয় সংখ্যক)।
খাঁচার আকার
খাঁচা তৈরির জন্য এমন জাল ব্যবহার করতে হবে যেন কাঁকড়া, গুইসাপ, কচ্ছপ ইত্যাদি ক্ষতিকর প্রাণী জালগুলো কাটতে না পারে। সাধারণত দুই আকারের জাল তৈরি করা হয়। যেমন- খাঁচার গভীরতা ৬ ফুট, প্রস্থ ১০ ফুট ও দৈর্ঘ্য ২০ ফুট। খাঁচা তৈরির জন্য জালগুলো মেস ৩-৪ ইঞ্চি থেকে ১১-৪ ইঞ্চির মধ্যে হওয়া ভাল। এতে সহজে নদীর পরিষ্কার পানি প্রতিনিয়ত খাঁচার ভেতরে সঞ্চালিত হতে পারে।
ফ্রেম তৈরি ও স্থাপন
খাঁচাগুলোর ফ্রেম তৈরি করতে প্রথমত ১ ইঞ্চি জিআই পাইপ দ্বারা আয়তকার ২০ ফুটী ১০ ফুট ফ্রেম তৈরি করা হয়। আর মাঝে ১০ ফুট আরেকটি পাইপ বসিয়ে ঝালাই করে ফ্রেম তৈরি করা হয়। এতে একটি ফ্রেমে সরাসরি ২০ ফুট দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ১০ ফুট আকারের খাঁচা বসানো যায় আবার প্রয়োজনবোধে ১০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১০ ফুট প্রস্থ আকারের দুটি খাঁচাও বসানো যায়। প্রতি দুই ফ্রেমের মাঝে ৩টি ড্রাম স্থাপন করে সারিবদ্ধভাবে ফ্রেমগুলো স্থাপন করা হয়। প্রয়োজনীয় সংখ্যক নোঙর দিয়ে খাঁচা নদীর নির্দিষ্ট স্থানে শক্তভাবে বসানো হয়। এরপর প্রতিটি ফ্রেমের সঙ্গে পৃথক জাল সেট করা হয়।
খাঁচায় মাছের মজুদ ঘনত্ব নির্ধারণ
পানির স্রোত, জালের ফাঁসের আকার, পানির গভীরতা, প্রত্যাশিত আকারের মাছ উৎপাদন, খাদ্যের গুণগতমান এবং বিনিয়োগ ক্ষমতা ইত্যাদি বিবেচনা করেই মজুদ ঘনত্ব নির্ধারণ করা হয়। স্থাপিত খাঁচায় মাছের প্রজাতি ভেদে যেমন প্রতি ঘনমিটারে ৩০ থেকে ৪০টি পর্যন্ত মনোসেক্স তেলাপিয়া পোনা মজুত করা যাবে। মজুদকালে পোনার আকার এমন হতে হবে যাতে জালের মেসের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে যেতে না পারে। ন্যূনতম ২৫-৩০ গ্রাম আকারের পোনা মজুত করতে হবে।
খাঁচায় সম্পূরক খাদ্য প্রদান
বাণিজ্যিকভাবে খাঁচায় মাছ চাষ পরিচালনার জন্য প্রবাহমান পানিতে ভাসমান খাদ্যের বিকল্প নেই। বিভিন্ন কোম্পানি পিলেট আকারের পানিতে ভাসমান সম্পূরক খাদ্য তৈরি করে থাকে। মাছ খাঁচায় মজুদের পর হতে বাজারজাত করার আগ পর্যন্ত দৈহিক ওজনের বিবেচনায় খাদ্য প্রয়োগের মাত্রা ৮ শতাংশ হতে ৩ শতাংশ এর মধ্যে সীমিত রাখতে হবে। মজুদ থেকে শুরু করে বাজারজাত পর্যন্ত ৭৫০-১০০০ গ্রাম ওজনের মাছ উৎপাদন করতে সর্বোচ্চ ১.৫ কেজি খাদ্যের প্রয়োজন।