ঢাকা-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কের পাহাড়ি উঁচু-নিচু আঁকা-বাঁকা হাফ কিলোমিটার সড়কে ডাকাতদের রাম রাজত্ব চলছে! অহরহ এই রোড ডাকাতির ঘটনায় পরিবহন শ্রমিক ও যাত্রী সাধারণের মধ্যে ডাকাত আতঙ্ক বিরাজ করছে।
এই পাহাড়ি এলাকায় সন্ধ্যার পর থেকে ভোর রাত পর্যন্ত কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশ বিরাজ করায় সড়কে ডাকাত আতঙ্ক আরো বেড়ে গেছে।
অথচ কামাইছড়া পাহাড়ি বাঁক থেকে রাবার বাগান পর্যন্ত হাফ কিলোমিটার সড়ক এলাকার ৩ কিলোমিটার দূরে স্থায়ীভাবে কামাইছড়া পুলিশের ক্যাম্প রয়েছে। তার পরও একই জায়গায় বার বার ডাকাতি হচ্ছে। ধরা পড়ছে না কোনও ডাকাত। এছাড়াও মহাসড়কের নিরাপত্তায় নিয়োজিত আছে সাতগাঁও হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ি।
এতো কিছুর পরেও হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলা অংশের কামাইছড়া থেকে শ্রীমঙ্গল উপজেলার প্রবেশদ্বার মুছাই নামক এলাকায় এ আঞ্চলিক মহাসড়কে ডাকাত চক্রের কবল থেকে রক্ষা পাচ্ছে না পণ্যবাহী গাড়ি থেকে শুরু করে যাত্রীবাহী বাস, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, অটোরিকশার চালক, যাত্রীসহ এমপিরা।
গুরত্বপূর্ণ এ সড়কে স্থানীয় ও পার্শ্ববর্তী চুনারুঘাট উপজেলার ৪০ থেকে ৫০ জনের একটি সংঘবদ্ধ ডাকাত চক্র সক্রিয়। এদের মধ্যে মাত্র ১২/১৩ জন ডাকাতকে শনাক্ত করেছে পুলিশ। কিন্তু কোনো ভাবেই তাদের ধরতে পারছে না।
গাজীপুর রিজিয়নের আওতাধীন সাঁতগাও হাইওয়ে পুলিশের দেয়া তথ্যমতে, গত রমজান মাস থেকে ৭ অক্টোবর পর্যন্ত এই আঞ্চলিক মহাসড়কে রাস্তার দুইপাশের গাছ ফেলে কমপক্ষে ৭টি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। এসব ডাকাতির ঘটনায় সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে মৌলভীবাজার-২ আসনের সংসদ সদস্য আব্দুল মতিন পর্যন্ত রেহাই পাননি।
পণবহনকারী গাড়ি চালক ও সহকারীর যোগসাজশ রয়েছে ডাকাতদের সঙ্গে। স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। এরা সংখ্যায় ৪০-৫০ জন। ১০ থেকে ১৫ জন অংশ নিয়ে ২-৩টি দলে বিভক্ত হয়ে মুখোশ পরে ডাকাতি করে। এ আঞ্চলিক মহাসড়ক দিয়ে প্রতিদিন ১০-১৫ হাজারেরও বেশি যানবাহন চলাচল করে। এই মহাসড়কে পুলিশের অপ্রতুল টহলের সুযোগ নিচ্ছে ডাকাতরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক পুলিশ সদস্য বলেন, পণ্য বহনকারী চালক ও সহকারীর যোগসাজশ আছে সংঘবদ্ধ ডাকাত দলের সাথে। তারা পণ্য নিয়ে রওনা দেয়ার আগেই মোবাইল ফোনে ডাকাতদের তথ্য জানিয়ে দেয়। ডাকাত দলের সদস্যরা নিরাপদে অবস্থান নিয়ে গাছ ফেলে ডাকাতি করে। ডাকাতির পর লুট করা মালের একটি অংশ চলে যায় চালক ও সহকারীর কাছে।
এই আঞ্চলিক মহাসড়কের কামাইছড়া পুলিশ ক্যাম্প থেকে ৫শ’ গজ দূরত্বে ডেঞ্জার জোন রাবার বাগানের পাহাড়ি রাস্তার বাঁকে সর্বশেষ গত ৭ অক্টোবর রাত ৮টা ৫০ মিনিট থেকে ৯টা ২০ মিনিট পর্যন্ত একটানা ৩০ মিনিট ডাকাতি সংঘটিত হয়।
ওইদিন ডাকাতের কবলে পড়েন বাহুবল উপজেলার মিরপুরের চিচিরকুট গ্রামের বাসিন্দা জিতু মিয়া (৩২)। তিনি বলেন, অটোরিকশায় বাড়ি যাবার পথে রাবার বাগানের পাহাড়ি বাঁকে ডাকাতরা রাস্তার পাশের গাছ কেটে ফেলে ডাকাতি শুরু করে। তাদের মুখোশ পরা ছিল। এরা অন্তত ২০-২২ জন ছিল। হাতে লাঠি ও দা’ ছিল।
ডাকাতি করার সময় তারা গাড়ির লাইট নিভিয়ে রাস্তায় লাইন করিয়ে রাখে।
তিনি বলেন, সেদিন ডাকাতির সময় রাস্তার ২ পাশে ৫০ থেকে ৬০টি যানবাহন ছিল।
এ ব্যাপারে কামাইছড়া পুলিশ ক্যাম্পের এসআই মহরম বলেন, ৭ অক্টোবর ডাকাতি হয়নি, ডাকাতির চেষ্টা হয়েছে। পুলিশ দুই রাউন্ড গুলিও বর্ষণ করে। কিন্তু ডাকাতের হাতে দা’ থাকার কারণে তাদের কাছে যেতে পারেনি পুলিশ।
তিনি বলেন, ডাকাত প্রতিরোধে সকাল থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত দুইটি টহল পার্টি দাঁড়িয়ে ডিউটি করে। এছাড়া গোয়েন্দা, ডিবি, সিআইডি, আমরা ক্যাম্প পুলিশ অনেক ভাবে ট্রাই করছি।
তিনি আরো বলেন, এখানে ডাকাতি-প্রবণ এলাকা। ডাকাতি হতেই পারে। আমি অস্বীকার করবো না- ডাকাতি হবে না। আমি এখানে এসেছি ১৪ মাস। আমি আসার আগে ডাকাতরা এক সাব ইন্সপেক্টরকে চিঠি দিয়ে বলছে ‘তোর কাল্লাটা যদি বাঁচাইতে চাস তাহইলে এখান থেকে তো চলে যা’। হে রাইতে রাইতে চলে গেছে।
এসআই মহরম বলেন, ভাই এই নিউজটা কইরেন না। আমি এমনিতেই বিব্রত। আমার বারটা বাজি গেছে। প্রশাসনরে বোঝাইতে আমার অনেক কষ্ট হয়। এই কামাইছড়া লইয়া অনেক সমস্যা হইতেছে।
ডাকাতির ঘটনায় কোনো মামলা হচ্ছে না কেন? এ বিষয়ে তিনি বলেন, এসব ডাকাতির ঘটনায় কেউ মামলা করে না। ভাই আমি দুর্ভাগা! প্রত্যাহারের জন্য মৌখিক আবেদন করছি। মানুষ চায় সম্মানজনক প্রস্থানের। ব্যর্থতা নিয়ে প্রস্থান আমি মেনে নিতে পারি না’।
শ্রীমঙ্গল উপজেলার সাতগাঁও পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই নান্নু মন্ডল বলেন, মহাসড়কের নিরাপত্তা দেয়াই আমাদের দায়িত্ব। এই আঞ্চলিক মহাসড়কের মিরপুর থেকে মৌলভীবাজার পৌরসভা পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটার রাস্তা এই ফাঁড়ির আওতায়। এর মধ্যে মহাসড়কের বিপজ্জনক জোন হিসেবে কামাইছড়া পাহাড়ি বাঁক থেকে রাবার বাগান পর্যন্ত হাফ কিলোমিটার সড়ক এলাকা ডাকাত প্রবণ। গত রমজান মাস থেকে ৭ অক্টোবর পর্যন্ত এই এলাকায় কমপক্ষে ৭ বার একই স্থানে গাছ ফেলে ডাকাতির ঘটনা সংঘটিত হয়েছে।
একই স্থানে কেন বার বার ডাকাতি হয় এ বিষয়ে তিনি বলেন, নিরিবিলি পাহাড়ি বাঁক। এক বাঁক থেকে অন্য বাঁক সহজে দেখা যায় না। রাস্তার দুপাশে গাছ পালায় ঘেরা। রানীগাঁও ও চুনারুঘাট এলাকার লোকজন এসব ডাকাতিতে জড়িত। আশপাশ এলাকার লোকজনসহ চুনারুঘাট বর্ডার এলাকার সন্দেহভাজনদের উপর নজর রাখা হচ্ছে।
মহাসড়কের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মহাসড়কের নিরাপত্তায় সাতগাঁও চা বাগান এলাকা থেকে কামাইছড়া পাহাড়ি বাঁক পর্যন্ত একজন এএসআই এর নেতৃত্বে ৫ সদস্যর টহল পার্টি থাকে। রাত ৮টা থেকে সকাল ৮টা এক পার্টি এবং সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত আরেক পাটি ৫জন করে মহাসড়কে টহল দিয়ে থাকে। এই হাফ কিলোমিটার বিপজ্জনক এলাকায় স্ট্যান্ডবাই পাহারার জন্য হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত জনবল নেই। যদি পর্যাপ্ত জনবল থাকতো তাহলে পাহাড়ি বাঁক এলাকায় পাহারার স্থায়ী ব্যবস্থা করা যেত।
তিনি জানান, সাতগাঁও হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ২২ সদস্যর জনবল থাকার কথা থাকলেও রয়েছে মাত্র ১৩জন। এর মধ্যে সাব ইন্সপেক্টর ১জন, এএসআই ১জন, এটিএসআই একজন ও ৬জন কনস্টেবল পদ বর্তমানে শূন্য রয়েছে।
র্যাব-৯ এর সিপিসি-২ শ্রীমঙ্গল ক্যাম্পের অধিনায়ক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বিমান চন্দ্র কর্মকার বলেন, এ বিষয়টি নিয়ে আমরা অস্থির আছি। ঢাকা-সিলেট আঞ্চলিক এই মহাসড়কে ডাকাতিতে নতুন কয়েকটি চক্র সক্রিয়। আমাদের কাছে তথ্য আছে চুনারুঘাট, বাহুবল ও শ্রীমঙ্গল এই তিন এলাকার লোকজন এসব কাজ করছে। এ বিষয়ে আমরা কাজ করেছি। আশা করছি শিগগিরই তাদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করা যাবে।