তারেক মাহমুদ:
ছুটির দিন তাই রাজধানীর ব্যস্ততম শাপলা চত্বরে রোজকার মতো ব্যস্ততা নেই। ফুট ওভারব্রিজ দিয়ে রাস্তা পার হতে গিয়ে চোখে পড়লো ওভারব্রিজের এক কোণায় গুটিসুটি মেরে বসে থাকা মধ্যবয়সী এক লোকের দিকে। মুখে মাক্স, সামনে একটি ওজন মাপার মেশিন, কিছু মেডিকেল নথিপত্র, পাশের রেলিং এ ঝুলে আছে এক্স-রে, এমআরআই ফিল্ম! রাজধানীর অলিগলিতে বিচিত্র জিনিস দেখা খুব স্বাভাবিক। তবে কেন জানি লোকটাকে দেখে কৌতুহল নিবৃত্ত করতে এগিয়ে গেলাম। উদ্দেশ্য অনেকটা ‘একসাথে রথ দেখা এবং কলা বেচা’র মতো। ৫টাকা দিয়ে নিজের ওজনটাও দেখা হলো আর সেই সুযোগে মনের কৌতুহলও খানিকটা নিবৃত্ত করা ।
ওজন মাপার পর লোকটার কাছে কথায় কথায় জানতে চাইলে তিনি বললেন, ১৫ বছর আগে প্রমত্তা পদ্মার ভাঙ্গনে সর্বস্ব হারিয়ে স্বপরিবারে ঢাকায় এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে এক সময় সিএনজি চালিত অটোরিকসা চালানোর কাজকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। এভাবে ভালই দিন কাটছিল তিন সন্তানের পিতা জমির উদ্দিনের। কিন্ত দু’বছর আগে একটি ভয়ানক এক সড়ক দুর্ঘটনায় বিপর্যয় নেমে আসে তার জীবনে। এ দুর্ঘটনায় তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও ভেঙ্গে গেছে তার মেরুদন্ড! ভাঙ্গা মেরুদন্ড নিয়ে তিনি এখন দাঁড়াতে পারেন না। জমির উদ্দিনকে আবার দাঁড়াতে হলে করতে হবে ১০লাখ টাকা ব্যয়ে অপারেশন। তাই রাস্তার মোড়ে বসে ভিক্ষার পরিবর্তে মেশিনের সাহায্য মানুষের ওজন মাপেন!
দু’বছর ধরে ভাঙ্গা মেরুদন্ডের চিকিৎসার পেছনে ঘুরে ভেঙ্গে গেছে জমির উদ্দিনের পরিবারের অর্থনৈতিক মেরুদন্ডও। তার কাঁদে এখন পরিবারের ভরণ পোষণ, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া এবং নিজের চিকিৎসা ভার…!
ভাঙ্গা মেরুদন্ডের উপর এতো দায়িত্বের ভার নিয়ে কতদূর এগুতে পারবেন তিনি? এই উত্তর আমার জানা নেই। ওজন মাপার টাকাটা পরিশোধ করতে গিয়ে নিজের মধ্যে এক অবর্ণনীয় দুঃখের অনুভূতি সৃষ্টি হলো। রাজধানীর জনারণ্যে কিংবা নাগরিক চাকচিক্যের ভিড়ে এভাবে কত দীর্ঘশ্বাস গোমরে কাঁদে। শুনার কেউ নেই। কান থাকতেও যেন সবাই বধির হয়ে আছে…