‘সকালের দাঁড়ি কমা’ কাব্যগ্রন্থের কবি আপন মাহমুদের ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২০১২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভোরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে না-ফেরার দেশে চলে যান শূন্য দশকের উল্লেখযোগ্য এই কবি। মাত্র ৩৬ বছরের জীবনেই বাংলা কবিতায় তিনি তাঁর প্রতিভার ঝলক দেখিয়ে গেছেন।
কবিতার পাশাপাশি কিছু গদ্য, ছোটগল্প, ছড়া ও গান লিখেছেন। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সকালের দাঁড়ি কমা’ প্রকাশ পায় ২০১১ সালে। লিটল ম্যাগাজিন দিয়ে লেখালেখি শুরু করলেও পরে একই সঙ্গে বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক ও সাময়িকীতে ছাপা হয়েছে তাঁর কবিতা।
আপন মাহমুদের জন্ম ১৯৭৬ সালের ১ জানুয়ারি, লক্ষ্মীপুরের মান্দারীবাজার এলাকার কড়ইতলা গ্রামে। বাবা আবদুর রব ও মা আনোয়ারা বেগম। অধুনালুপ্ত দৈনিক আজকের কাগজে তাঁর সাংবাদিকতা জীবন শুরু। এরপর দৈনিক যায়যায়দিন হয়ে ২০১০ সালে যোগ দেন কালের কণ্ঠে, যেখানে জ্যেষ্ঠ সহ সম্পাদক হিসেবে ছিলেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। ঢাকা সাব-এডিটরস কাউন্সিলেরও সদস্য ছিলেন তিনি।
আপন মাহমুদের কবিতা নিয়ে দৈনিক ইত্তেফাকের সৌজন্যে রহমান মতি‘র একটি লেখা পাঠকদের জন্য প্রকাশিত হলো।
আবার শীত এলে আমি মরেও যেতে পারি
ছড়িয়ে ঝরাপাতার উপহাস…
এই শীত আসার আগেই আপন মাহমুদ চলে গেলেন। তিনি জীবনকে দুইভাগে ভাগ করেছেন। কমাতে শুরু করে দাঁড়িতে শেষ করেছেন। তাঁর একটিমাত্র কবিতার বই ‘সকালের দাঁড়ি-কমা’ পড়ে খুব আশাবাদী হয়েছিলাম। বিশ্বাসটাও পোক্ত হয়েছিল, সম্ভাবনা নিয়ে তিনি এগোচ্ছেন। কিন্তু আমি মরেও যেতে পারি—সেই পারা না পারার হিসাব চুকিয়ে সত্যিই চলে গেলেন। যাঁরা ক্ষণজন্মা শিল্পী তাঁদের জন্য আমাদের কষ্ট হয়। মনে হয় তাঁরা কেন আরও লিখবেন না! আপন মাহমুদকে ঘিরেও একই অনুভূতি। আপন মাহমুদ কেন আরও লিখবেন না! কেনই বা একটি সকালের দাঁড়ি-কমা-ই তাঁর অনাগত সম্ভাবনাকে জানান দেওয়ার জন্য যথেষ্ট হবে। আসলে এসব হূদয় নিষ্কাশিত বেদনার উচ্চারণ দিয়ে শুধু কবিতার একাগ্র পাঠকের মন ভরানো যায় না। মন ভরাতে হয় কবির চলে যাবার পর তাঁর সৃষ্টি নিয়ে নানামাত্রার আলোচনা-সমালোচনার মাধ্যমে।
আপন মাহমুদের কবিতা দিনানুদৈনিকের একগুচ্ছ খসড়া। কথা বলেন কিংবা কথা বলতে তিনি পছন্দ করেন। সে কথামালা নিজের জীবনপথকে যেমন বিশ্লেষণ করে, পাশাপাশি অন্য সত্তার সঙ্গে নিজের সমপর্ক, সীমা, যোজন-বিয়োজনকে তুলে ধরে। সকালের দাঁড়ি-কমা-র ৯-১৮ পৃষ্ঠা জুড়ে ‘মা’ সিরিজের কবিতা। টানা দশটি কবিতা মাকে নিয়ে। সন্তানের চেতনার বহুমাত্রিক বেষ্টনী কবিতাগুলোকে নিজস্বতা দিয়েছে। ধ্রুপদী অনুভূতি আছে যা মনের মধ্যে অনায়াসে দাগ কাটে। কোথা থেকে কোন কাব্যলক্ষ্মী আপন মাহমুদকে দিয়ে লিখিয়ে নিচ্ছেন—’মায়ের উদ্দেশে বাবা যে চুমুটা ছুড়ে দিয়েছিলেন বাতাসে/ শুনেছি, সেই হাওয়াই চুমুটা থেকেই জন্ম নিয়েছিলো/ পৃথিবীর প্রথম প্রজাপতি’ (মা প্রজাপতি ও অন্যান্য ছায়া)। পৃথিবীতে প্রজাপতি জন্মের পেছনে এমন প্রেমাসপদজনিত ঘটনাপ্রবাহের কাল্পনিক অনুভব কবিতা পাঠের অভ্যাসকে আরও একধাপ এগিয়ে দেবে। কল্পনাশক্তিই মহত্কবির বড় সমপদ। পরের স্তবকে ‘মা, পৃথিবীর যেকোনো নারী থেকে যাকে কখনোই আলাদা করা যায় না’—এ লাইনটির ক্ষেত্রেও কল্পনার এবং ধ্রুব সত্য কথার গাঁথুনি আছে। যে মাকে নিয়ে কবির এত আবেগ সেই মায়ের বেদনাকে নিজের করে দেখাতেই শেষ স্তবকে বলেন—’মাকে বাবা খুঁজে পেয়েছেন সেই কবে!/ অথচ, তার মুখের দিকে তাকিয়ে কখনোই মনে হয়নি/ জীবনে একটাও প্রজাপতি তার খোঁপায় বসেছে’। এ বেদনা জমাট বাঁধে। বহুদিন ধরে মাকে দেখার পরই কেবল এভাবে বলা যায়। সমপর্কের বীজ শুধু মানুষ থেকে মানুষেই থাকে, তা নয়। প্রকৃতির সঙ্গে তার যোগসাজশে প্রকৃত চিত্র ফুটে ওঠে। মায়ের সমপর্ক যেখানে গোলাপ বা চন্দ্রমল্লিকার মতো ফুলের সঙ্গেই ভালো হবার কথা সেখানে ঘাসফুলের সঙ্গে হয়েছে। কারণ মা জানান, জীবনের যত কফ… থুতু আর হারাবার বেদনা এমনকি প্রসববেদনাও ঘাসফুলের কাছে জমা করেছেন। কবিরও সেই থেকে নীল ঘাসফুলই প্রিয় হয়েছে। তার কোনো বাজারমূল্য থাক বা না থাক, সেই ফুলই মাকে প্রতিনিধিত্ব করে। স্মৃতির উপাদান বা সংবেদনায় অন্য উপাদানে মাকে খোঁজা নতুন কিছু নয়, অথচ আপন মাহমুদ যেভাবে ওই পরিবেশকে জীবন্ত করেন, সেটাই নতুন। মায়ের সঙ্গহীন পৃথিবীতে কবি নিঃসঙ্গ। তার চাপে কখনো নিজেকেই দোষারোপ করেন। তাঁর মনে হয়—’মা, তোমার বেজার মুখের প্রতিবেশী আমি এক চুপচাপ বালক’। এই বালক প্রসববেদনার সময় থেকে যে যাত্রা শুরু করেছিল তারপর তার কোনো বিশ্রাম জোটেনি। বন্ধুর মতো ছায়া বা বটের ছায়াও পায়নি। গৌণসত্তার মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে তিনি বিচার করেন নৈঃসঙ্গ। এভাবে চলতে চলতে হয়তো আড়ষ্ট হয়ে যাবেন নিজেও। তাই জিজ্ঞাসা—’আড়ষ্টতার হাত ধরে কতদূর যাবে মায়ের বোবা ছেলেগুলো’। কিন্তু আশাও হারাননি। অতঃপর দাঁড়াতে চান এবং বিশ্বাস করেন— ‘দাঁড়াতে জানলে সকল দূরই একদিন নিকটে চলে আসে’। পারসপরিক সমপর্কের এমন ভেদ-অভেদ করে কবি জানান দেন তাঁর কাব্যের শক্তি। এ শক্তিকে জানা যাবে তাঁর গল্প বলার গতিময়তা দেখে। কবিতা চলছে কবিতার মতোই এবং তার সঙ্গে চলছে প্রবহমান গল্প। যেমন তিনি মাকে অন্যান্য মায়েদের সঙ্গে তুলনামূলকভাবে দেখাচ্ছেন। মায়ের পানখাওয়া ঠোঁটে যে ভ্রমরের কাতরতা ছিল, বাবা তা উপেক্ষা করেছিল। মায়ের ঠোঁট যে ভালোবাসার জন্য কাঙাল ছিল তা বাবা বুঝতে চাননি অথবা বোঝেননি। কিন্তু যে বন্ধুরা মায়ের কাছে থাকে, মায়ের থেকে দূরে হোস্টেলে থাকে, আত্মহত্যা পর্যন্ত আসা-যাওয়া করে, তারা সবাই ভালোবাসার জন্য অধীর ছিল। এতসব দেখেও কোনো কোনো বাবা মায়েদের লাল ঠোঁট উপেক্ষা করে। এখানে লাল ঠোঁট ভালোবাসার ঔজ্জ্বল্যের প্রতীক। কিন্তু বাবা এখানে বাইনারি বৈশিষ্ট্যের ধারক। এই বাইনারিকে কবি পরেই ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর অনুভূতিতে রাধার ব্যাকুলতা বা মানুষের নগ্ন হবার সহজ প্রবণতার প্রসঙ্গে আসে—’কৃষ্ণ ও তার বাঁশির মধ্যে কে বেশি প্রভাবক’। অসাধারণ এই উপলব্ধি। গল্পের ধরনে যে কবিতাটি এগিয়ে যাচ্ছিল তার গন্তব্য এটাই। বঞ্চিত হবার মতো দিক থেকে মাকে যে বাবা বঞ্চিত করেছে তা সেই বাঁশির সুরের মতোই হন্তারক। মায়ের ছবি নিয়ে কবির পিপাসা ‘মেঘদূত’ করে দেয় তাঁকে। মায়ের ছবির একটাই বৈশিষ্ট্য—কেবল তাকিয়ে থাকা। চিত্রকল্প এখানে চমত্কার—’তাকিয়ে থাকা মানে বয়ে যাওয়া নদী।’
আগেই বলেছি আপন মাহমুদ বড় কবি হবার পথে ছিলেন। যিনি বলতে পারেন—’এক-একটি নদী পেরোনোর চে এক-একটি নারী পেরোনো অনেক ভয়ের/কেননা এক-একটি আহত পাখি এক-একটি মৃত পাখির চেয়ে বেশি বেদনা বহন করে’ (সাঁতার)। বিপরীত জোড় আছে নদী এবং নারী আবার আহত পাখি ও মৃত পাখির ধারণায়। উভয়ের দূরত্বকে নির্দেশ করে সকাতর প্রণয়কে তুলে ধরেন। শেষ লাইনে—’সাঁতার জানলেই সব নদী পেরোনো যায় না’। এটি ধ্রুব অনুভূতি। যেমন—এই অনুভূতিটিও ‘মনখারাপের পৃষ্ঠা উল্টাই। ভাবি—আহা! সতিনের শাড়িটা আজো সবচে/বেশি সুন্দর—তার ছেলেটাই আজো ভাত বেশি খায়!’ (সতিনের ছেলে)। সামাজিক সহজ স্বাভাবিক সত্য। কবিতা তো এমনই হওয়া উচিত।
প্রতীকের ছায়ায় আপন মাহমুদ পারঙ্গমতা দেখান তাঁর অনুভূতি প্রকাশের ক্ষেত্রে। ‘নদী হত্যা করে কারা যেন রেলগাড়ি ছেয়ে দিয়েছে পৃথিবীতে’ (রেলগাড়ি)। নদীর এঁকেবেঁকে বয়ে যাওয়াতে যে দীর্ঘ ভৌগোলিক ব্যাপার আছে, রেলগাড়ির পথও সেরকম দীর্ঘ ও সমান্তরাল। এই দীর্ঘতা আরও ভরাটভাবে প্রতীকী এই কবিতারই দ্বিতীয়াংশে—’রেললাইন দীর্ঘ হয় কেন, বেদনা বোঝাতে? নাকি দূর দীর্ঘশ্বাসে ঘুড়ি ওড়াতে’। পড়তে গিয়ে মুগ্ধতার ছোঁয়া থাকবে পাঠকের অনুভূতিতে। ব্যক্তি বা প্রেমবাচক দেবলীনাদের গল্প, অপাদির প্রতি নিবেদনে, রোকেয়া হলের দিকে প্রণয়সন্ধান করার আকুলতা আছে। বিচ্ছেদটাই মৌলিক হয়ে উঠেছে তাঁর প্রণয়ে। যেমন—’তোমাকেই ডাকতে চেয়েছিলাম পেছন থেকে/ অথচ বিলবোর্ড এসে সামনে দাঁড়ালো’ (বিলবোর্ড)। দৈনন্দিনতার আঁচড়ে ছোট-বড় নানা ঘটনাপ্রবাহ কবির কাছে একান্ত বিষয়। সকালের দাঁড়ি-কমা বইটির ফ্ল্যাপে দাদার টিপসই, বাবার প্রশ্ন এসবের মধ্যে অন্ধকারে নিজের ছবি তুলে ফেলার অন্তর্গত অন্বেষণেও মেলে অতীতের দৈনন্দিনতার ছাপ। মা এবং অন্যান্য সঙ্গ, অনুষঙ্গের কবিতাগুলো মোটের ওপর আপন মাহমুদের নিজের জিনিস। কল্পনা ও বাস্তব তাঁর দ্বৈতপরিক্রমণে কাজ করেছে।
বিনয় মজুমদার বলেছিলেন, কবিতা হলো—চিরস্মরণীয় বাক্যসমষ্টি যা হুবহু মুখস্থ করা যায়। আপন মাহমুদের কবিতার কোনো কোনো বাক্য সে চূড়াকে সপর্শ করে। হয়তো এমন চূড়ার দেখা আমরা আরও পেতে পারতাম, কিন্তু সকাল পেরোনোর আগেই তিনি জীবনের সমাপ্তি টেনেছেন। সেই সকাল জীবনে কমারই মতো; দাঁড়িতে তার সমপূর্ণতা হয়েছে। আমরা এত অল্পে দাঁড়ি চাইনি।