বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ খ্রীষ্টাব্দ | ৪ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ



                    চাইলে বিজ্ঞাপন দিতে পারেন

মৌলভীবাজারে গুজবেই ভয়ভীতি তোলপাড়



বিজ্ঞাপন

লাতু ডেস্ক:: নানা গুজব আর অপপ্রচারেই বিভ্রান্তি। প্রকৃত দৃশ্যপট ভিন্ন। গত ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের অনেক নেতাদের প্রতি ক্ষমতার অপপ্রয়োগের কারণে ক্ষোভ প্রকাশ করে তাদের বাসাবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও লুট হলেও হয়নি কোনো সংখ্যালঘুর বাসাবাড়ি বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর কিংবা লুট। ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি কোনো মন্দির বা ধর্মীয় উপাসনালয়। কিন্তু ঘটনা ভিন্ন খাতে নিয়ে সাম্প্রদায়িক হামলা বলে একটি চক্র ফায়দা নিতে মরিয়া। এতে চরমভাবে মর্মাহত হচ্ছেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় কাজ করা নানা শ্রেণি ও পেশার লোকজন।

স্থানীয়রা জানান, দলীয় পদবি, আগেকার ক্ষমতার দাপট ও নিজেদের নানা অপকর্মের দায় আড়াল করে তা সাম্প্রদায়িক হামলা বলে চালিয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আবেগ পুঁজি করে প্রতিশোধপরায়ণ হতে চাইছেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী আওয়ামী লীগের পদবিধারী গুটিকয়েক নেতা। দেশের সাম্প্রতিক চলমান অবস্থায় ধর্মীয় সম্প্রীতির বন্ধনের ঐতিহ্য বিন্দুমাত্র বিনষ্ট হয়নি প্রবাসী ও পর্যটন অধ্যুষিত মৌলভীবাজারে। সম্প্রীতির এই বন্ধন অটুট রাখতে নানা পেশার মুসলিম সম্প্রদায় ও মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংখ্যালঘুদের বাসাবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও উপাসনালয় পাহারা দিচ্ছেন। শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পর দেশের চলমান পরিস্থিতিতে মৌলভীবাজার জেলার ৭টি উপজেলায় কোথাও কোনো সাম্প্রদায়িক হামলা হয়নি। ৫ই আগস্ট বিকাল থেকে পরদিন রাত পর্যন্ত জেলা শহরসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় যে সকল অনাকাঙ্ক্ষিত হামলা ও ভাঙচুরের বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে তা কেবল আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের পদধারী নেতাদের বাসাবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে।

জেলা পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের নেতৃবৃন্দ জানান, কমলগঞ্জ উপজেলা ছাড়া অন্যান্য উপজেলায় হিন্দু ধর্মাবলম্বী অনেকেই হামলা ও ভাঙচুরের শিকার হয়েছেন।

তাদের দেয়া তালিকানুযায়ী জেলার সবক’টি স্থানীয় বাসিন্দা, রাজনীতিবিদ, সমাজকর্মী ও গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে তথ্য নিয়েছেন। তাদের দেয়া তথ্যমতে ও সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়- মৌলভীবাজার শহরে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অজয় সেনের (মুদি দোকান) ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, জেলা যুবলীগের সহ-সভাপতি সমরেশ দাশ যিশুর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ম্যানেজার স্টল, জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের রাজনৈতিক আড্ডাস্থল পারুল মেডিকেল ফার্মেসি, কামালপুর ইউনিয়নের সক্রিয় আওয়ামী লীগ নেতা অনুকুল দেবের কামালপুর বাজারস্থ ফার্মেসিতে হামলা ও ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা। হিন্দু ধর্মাবলম্বী এমন চিন্তায় কোনো হামলা হয়নি। তারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন প্রতিরোধে দলীয় পরিচয়ে সর্বত্রই সক্রিয় ভূমিকা রাখেন বলেই তাদের আচরণের উপর বঞ্চিত ও শোষিত মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বলে সবাই তথ্য দেন।

জুড়ীতে উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মনি কিশোর রায় চৌধুরী, উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রিংকু রঞ্জন দাস, পশ্চিম জুড়ী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক চেয়ারম্যান শ্রীকান্ত দাস, গোয়ালবাড়ি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি রাজ কুমার বাড়ৈ, উপজেলা যুবলীগের সদস্য নির্মল কান্দি দাস নিলু, গোয়ালবাড়ি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সদস্য অলোক রঞ্জন দাস। দলীয় পরিচয়ে অতিমাত্রায় দাপটের কারণে তাদের অনেকেরই বাড়ি, মোটরসাইকেল ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বিক্ষুব্ধ জনতা ও দুর্বৃত্তরা হামলা ও ভাঙচুর চালায়। এ ছাড়া ওই উপজেলায় মণি-মুক্তা হোটেল ভাঙচুর হয়। কারণ হিসেবে তথ্য মিলে ওই হোটেলের ম্যানেজার তাপস ৩রা আগস্ট অস্ত্র নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

বড়লেখায় রতুলীবাজারের ফল ব্যবসায়ী দীপক দাস পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করতেন। তিনি আওয়ামী লীগের একজন সক্রিয়কর্মী। দীপক বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের দমন-নিপীড়নের ঘটনায় ফেসবুকে লাইভ করে উল্লাস করতেন। তার এমন আচরণে ভাই নিপেশও হামলা ও ভাঙচুরের শিকার হন। তবে স্থানীয় অনেকেই তাদেরকে আর্থিক সহায়তা করেছেন ও করছেন। দক্ষিণভাগ বাজারের ফল ব্যবসায়ী সাধন পাল ওই ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। তারা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়।

কুলাউড়ায় উপজেলা যুবলীগের সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক ও ব্রাহ্মণবাজার ইউপি যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইন্দ্রজিৎ ভট্টাচার্য্য, ব্রাহ্মণবাজার ইউপি আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি সুদর্শন চৌধুরী, ইউপি আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক শান্ত শেখর ভট্টাচার্য্য, সমু দাসের পুত্র বিপ্লব দাস, সাবেক সদস্য উপজেলা ছাত্রলীগ ও বর্তমানে ইউপি যুবলীগের সভাপতি পদপ্রার্থী ছিলেন। আর গাজিপুর চা বাগানের বাবুল গোয়ালা ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পঞ্চায়েত সভাপতি। তারা সকলে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী দমন- নিপীড়নে সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন।

রাজনগরে পাঁচগাঁও এলাকায় ভাঙচুরকৃত লোকনাথ স্টোরের মালিক মহেশ দাস আওয়ামী লীগের একজন সক্রিয় কর্মী। এ ঘটনায় অনেক মুসলমান প্রতিবাদ জানান। এমনকি ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যানও গুলিতে নিহত হন। হীরা সেন উপজেলা বিএনপি’র সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তার গৃহপালিত গরু লুট হয়নি। চুরি হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন। তবে নেপাল দত্তের গরু পূর্ব বিরোধের কারণে এই সময়ে জোর করে নিয়ে যাওয়া হয়।

জেলা পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মহিম দে মধু জানান, পরিস্থিতি এখন শান্ত। তার দেয়া উপরোক্ত তালিকা যাচাই বাছাই করে এই প্রতিবেদনটি তৈরি করে। জেলা পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের সভাপতি আশু রঞ্জন দাস জেলা আইনশৃঙ্খলা সভায় বলেন, বিচ্ছিন্ন কয়েকটি ঘটনা ছাড়া জেলায় বড় ধরনের কিছু হয়নি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় সকলের ভূমিকায় তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। আগামীতেও শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে তিনি সকলের সার্বিক সহযোগিতা চান।

এ বিষয়ে জেলা জামায়াতের আমীর ইঞ্জিনিয়ার মো. শাহেদ আলী ও সেক্রেটারি প্রিন্সিপাল মো. ইয়ামীর আলী বলেন, আমরা জেলায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় নানা উদ্যোগ নিয়ে মাঠে কাজ করছি। হিন্দু ধর্মাবলম্বী ভাইবোনেরা যাতে কোনো ধরনের ভয়ভীতির মধ্যে না থাকেন এবিষয়ে তাদের কমিউনিটির নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মতবিনিময় অব্যাহত রয়েছে। কেউ গুজব ছড়িয়ে যাতে আমাদের মূল্যবান সম্প্রীতির ঐতিহ্য নষ্ট না করে সেদিকেও সকলের সতর্ক দৃষ্টি ও উদার আন্তরিকতার আহ্বান জানান।

জেলা বিএনপি’র সভাপতি এম নাসের রহমান বলেন, দুর্বৃত্তরা কোনো ধরনের অঘটন ঘটিয়ে ঘোলাপানিতে যাতে মাছ শিকার করতে না পারে সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে দলের নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ও সহযোগিতা দিতে দলীয় নেতাকর্মীরা মাঠে সক্রিয় রয়েছেন। আমরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্য রক্ষায় সচেষ্ট রয়েছি। খবর-মানবজমিন