মৌলভীবাজারের বড়লেখায় সদ্য জাতীয়করণকৃত একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিনজন শিক্ষককে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়ার স্থানীয়ভাবে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব শিক্ষকের চাকুরী জাতীয়করণের সুবিধার আওতায় আনতে নিয়োগের তারিখ ও ঠিকানা কাগজপত্রে বদলে ফেলা হয়েছে। উপজেলার রহমানিয়া চা বাগান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়ম-নীতির লংঘন করে এসব শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এসব নিয়োগের মুখ্য ভূমিকা পালনকারী ব্যক্তিরা স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি অনেকেই মুখ খুলতে রাজি হননি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে প্রাপ্ত নথিপত্র বিশ্লেষণ করে জানা যায়, গত বছর তৃতীয় ধাপে জাতীয়করণ হওয়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর সাথে ২০০৪ সালে কার্যক্রম শুরু হওয়া বড়লেখা উপজেলার বেসরকারি রহমানিয়া চা বাগান প্রাথমিক বিদ্যালয়টিও জাতীয়করণ হয়। বিদ্যালয় জাতীয়করণের লক্ষ্যে ২০১৫ সালে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো তথ্যে ওই প্রতিষ্ঠানে ৪ জন শিক্ষক কর্মরত থাকার কথা জানানো হয়। কিন্তু যেসব শিক্ষকের চাকরি জাতীয়করণের জন্য মন্ত্রণালয়ে তথ্য পাঠানো হয়েছে তাদের মধ্যে ৩জন শিক্ষকের নিয়োগের ক্ষেত্রে তারিখ ও ঠিকানায় জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হয়। অনিময়ের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া ওই তিন শিক্ষক হচ্ছেন রোমেনা আক্তার, রত্না দেবনাথ ও রুজিনা আক্তার।
নথিপত্র ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, রোমেনা আক্তার ও রত্না দেবনাথকে স্কুলে নিয়োগ দেখানো হয়েছে ২০০৪ সালে। আর রুজিনা আক্তারকে দেখানো হয়েছে ২০১১ সালে। কিন্তু এদের কেউই ২০১১ সালের আগে এ এলাকায় অবস্থান করতে না। তিনজনই অন্য উপজেলার স্থায়ী বাসিন্দা। এরমধ্যে রুজিনা আক্তার চট্টগ্রাম বিভাগের স্থায়ী বাসিন্দা। প্রকৃত তথ্য গোপন করে এদের নিয়োগ দেখানো হয়। শুধুমাত্র ফারহানা আক্তার নামের স্থানীয় বাসিন্দা একজন শিক্ষকই স্কুলটির প্রতিষ্ঠাকাল থেকে কর্মরত ছিলেন। তাকে এই প্রতিষ্ঠানে ২০১১ সালে নিয়োগ দেওয়া হয়।
অনুসন্ধানকালে জানা যায়, ২০০৪ সালে বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেখানো রোমেনা আক্তার রহমানিয়া চা বাগানের ব্যবস্থাপক নজরুল ইসলামের স্ত্রী। তাদের স্থায়ী ঠিকানা কুলাউড়া উপজেলায়। নজরুল ইসলাম ওই বিদ্যালয়ের সভাপতি হিসেবে তাকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন। কিন্তু নজরুল ইসলাম ২০০৪ সালে এই বাগানে কর্মরত ছিলেন না। তিনি এ বাগানে যোগদান করেন ২০১১ সালে। একইভাবে নজরুল ইসলামের স্বাক্ষরিত নিয়োগপত্রে ২০০৪ সালে নিয়োগ দেখানো হয় রত্না দেবনাথকে। রত্না দেবনাথ ওই বাগানে মিডওয়াইফ (ধাত্রী) পদে চাকুরিতে যোগদান করেন ২০০৯ সালে। বর্তমানেও তিনি বাগানের মিডওয়াইফ পদেই চাকুরিতে আছেন। তাঁর স্বামীর বাড়ি শ্রীমঙ্গল উপজেলায়।
অন্যদিকে রুজিনা আক্তার নামে আরেকজন শিক্ষককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাঁর ঠিকানা দেখানো হয়েছে বড়লেখা উপজেলার তালিমপুর ইউনিয়নের মুর্শিবাদকুরা গ্রামে। এটা তাঁর স্বামী মো. নুরুল আমিন শাহিনের বাড়ি। কিন্তু রোজিনা আক্তার কিংবা তাঁর স্বামী এই এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা নন। বিষয়টি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা নিশ্চিত করেছেন। প্রকৃতপক্ষে রোজিনার বাবার বাড়ি হচ্ছে নোয়াখালি জেলার ব্রহ্মমপুর গ্রামে। তাঁর বিয়ে হয় ওই জেলার মান্দারতলী গ্রামের মো. নুরুল আমিন শাহিনের সাথে।
অনুসন্ধানকালে আরো জানা যায়, ২০১৫ সালে বিদ্যালয় জাতীয়করণ তদন্ত কমিটির আহবায়ক নিগার সুলতানা বড়লেখার কয়েকটি বেসরকারি বিদ্যালয় পরিদর্শন করেন। মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের ওই টিমের পরিদর্শনের পরই মূলত একটি চক্র পুরাতন তারিখে নিয়োগের কাগজপত্র তৈরি করে। সর্বশেষ ৪র্থ পর্যায়ের বিদ্যালয় জাতীয়করণের লক্ষ্যে পাঠানো স্কুলের তালিকা ও শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও জালিয়াতির তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। চক্রটি বড় অংকের টাকার বিনিময়ে এসব অনিয়ম করে যাচ্ছে। ফলে এসব স্কুলে চাকরি পাওয়ার যোগ্য ব্যক্তিরা বঞ্চিত হচ্ছে।
চক্রের অন্যতম হোতা হিসেবে পৌর শহরের এমএইচএস সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক মাকসুদুর রহমানের নাম উঠে এসেছে। মাকসুদুর রহমান ১ম ধাপে জাতীয়করণকৃত এমএইচএস সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগ লাভ করেন। উল্লেখ্য, স্থায়ী ঠিকানা গোপন রেখে রহমানিয়া চা বাগানে নিয়োগ দেখানো রুজিনা আক্তার মাকসুদুর রহমানের ছোট বোন।
বাগানের মিডওয়াইফ (ধাত্রী) ও বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া রত্না বেগম বলেন, ‘আমি বাগানে ২০০৯ সালে এসেছি, এটা সত্য। ২০০৪ সালের তারিখে নিয়োগ দেখিয়ে চাকরি স্থায়ী করণের এসব কাজ মাকসুদ স্যার করেছেন। আমাদের বলেছেন চাকরি স্থায়ী করতে এইগুলো করতে হয়।’
এ বিষয়ে বিদ্যালয়ের সভাপতি ও চা বাগানের ব্যবস্থাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘১১ সালে আমি বাগানে যোগদান করি। স্কুলটি আমার মিসেস দেখতেন। ১৫ সালে এমএইচ স্কুলের মাকসুদ স্যার জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা পঞ্চানন বালা ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা নিগার সুলতানকে নিয়ে আসেন। তখন মাকসুদ স্যার স্কুল দেখিয়ে তাঁদের বলেন যে, ওই স্কুলটি জন্য কাগজপত্র রেডি করি। তাঁরা সম্মতি দেন। এরপর মাকসুদ স্যার সব কাগজপত্র রেডি করে আমার স্বাক্ষর নেন। উনার বোনকে চাকরি দেওয়ার জন্যই এসব প্রসেসিং করেন। আমার স্বাক্ষর আমি তো অস্বীকার করতে পারি না। পরে বুঝতে পারি এখানে তথ্য জালিয়াতি করেছেন মাকসুদ স্যার।’
জালিয়াতির অভিযোগের বিষয়ে এমএইচএস সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক মাকসুদুর রহমান বলেন, ‘কাগজ আমি প্রসেসিং করেছি ঠিক আছে। ম্যানেজারের স্ত্রীর চাকরি জন্য এটা করেছি। এছাড়া আমার বোনের বিষয়ে যে অভিযোগ করা হয়েছে তা সঠিক নয়। সভাপতি আমার বোনকে ২ বার নিয়োগপত্র দিয়েছেন। আমি মুক্তিযোদ্ধার নাতি। আমার বোনও এ কোটায় পড়ে। মুক্তিযোদ্ধার নাতিন হিসেবে দেশের যে কোনো জায়গায় আবেদন করে চাকরি করা যায়। এটা সরকার স্বীকৃত।’
বড়লেখা উপজেলা প্রধান শিক্ষক সমিতির আহবায়ক বদর উদ্দিন ও প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি অঞ্জনা রানী দে বলেন, ‘জাতীয়করণকৃত বিদ্যালয়গুলোতে কাগজপত্র জালিয়াতি করে বাইরের উপজেলার লোকজন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পায়। এতে স্থানীয় শিক্ষিত বেকাররা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এইগুলো সুষ্ঠু তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য শিক্ষক সমাজের পক্ষ থেকে আমরা দাবি জানাচ্ছি।’
এ ব্যাপারে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. রফিজ মিয়া বলেন, ‘এ নিয়োগের ব্যাপারে আমি জানি না। আগের কর্মকর্তারা তথ্য পাঠিয়েছেন। ম্যানেজার যদি বাগানে ১১ সালে এসে ৪ সালে নিয়োগ দেখান। অবশ্যই এটা বিতর্কিত। এছাড়া রুজিনা সম্পর্কে জেনেছি। তিনি ওই উপজেলার বাসিন্দা নন। এই নামে কোন বাসিন্দার তথ্যও নেই। শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতে অবশ্যই উপজেলার স্থায়ী বাসিন্দা হতে হবে। রুজিনা মাকসুদু নামের এক শিক্ষকের বোন। বিভিন্নভাবে খবর পেয়েছি মাকসুদ বিভিন্ন জায়গা থেকে টাকা নিয়ে স্কুল ও শিক্ষক জাতীয়করণের কাগজপত্র তৈরি কর দেন। অনেকেই টাকা দিয়েছেন বলে শুনেছি। কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে কেউই অভিযোগ দিচ্ছেন না। অভিযোগ পেলে ওই শিক্ষককের বিরুদ্ধে অসদাচরণ ও প্রতারণামূলক কাজের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’