শিমুল খালেদ:
ছুটির দিনে সেজো খালার বাড়িতে বেড়াতে এসেছি। দুপুরে খেয়েদেয়ে ভাতঘুমে কখন যে ঢলে পড়েছিলাম, খেয়ালই ছিল না। হঠাৎ ভূমিকম্প। লাফ দিয়ে জেগে উঠলাম। মোবাইল ফোনের ভাইব্রেশন ভূমিকম্পের মতো বালিশ কাঁপিয়ে দিচ্ছে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সৌরভের কণ্ঠস্বর, ‘কই তুই? ঘুমাচ্ছিস?’ আমার তখন উল্টো প্রশ্ন, ‘তুই কই?’ এরই মধ্যে ও বিয়ানীবাজার ছেড়ে এসেছে। গোছগাছ সেরে বের হওয়ার পর কয়েক মিনিটের মধ্যেই রিকশায় করে আমাদের গন্তব্যস্থল শ্রীধরায় চলে এলো সৌরভ। মুচকি হাসি বিনিময়ের পর পদ্মবিলের উদ্দেশে শুরু করি হাঁটা।
গ্রামের মধ্য দিয়ে চলে গেছে পিচঢালা মসৃণ পথ। বসতবাড়ির পর গ্রামের শেষভাগে পড়ল একটি হাফিজিয়া মাদরাসা। বলা হয়, হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর ৩৬০ সফরসঙ্গীর ১৮ জন এখানে সমাহিত রয়েছেন। তাই জায়গাটিকে সবাই ‘আঠারো সৈয়দের মোকাম’ নামেই চেনে। তবে সেই ১৮ জন আউলিয়ার মধ্যে দুজনের কবর চিহ্নিত আছে। বাকিদের কবরের কোনো চিহ্নই নেই। মোকামে ঢুকতে গিয়ে প্রথমেই পড়ল একটি মাঝারি আকারের পুরনো পুকুর। এতে আছে বিরল প্রজাতির গজার মাছ। লোকে বলে, পুকুরের এসব গজার মাছ আর সিলেটে হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর মাজারের গজার মাছ একই প্রজাতির। মাছগুলো ‘মাদারী গজার’ নামে পরিচিত। মাছগুলো কেউ ধরে না। মোকামে আসা লোকজন এই মাছগুলো দেখার জন্য ভিড় জমায়। আমরাও পুকুরের সিঁড়ির শেষ ধাপে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে পড়ি গজার মাছ দেখার আশায়। শুষ্ক মৌসুমে পানি কমে যায় এবং পরিষ্কার থাকে বলে সহজেই মাছগুলো দেখা যায়। তবে এখন ভরা মৌসুমে পুকুরটি পানিতে টইটম্বুর। পানিও বেশ ঘোলা। পুকুরপারের মসজিদ আর গাছগাছালির ছায়া পড়েছে স্থির পানির ওপর। চারপাশে সতর্ক দৃষ্টিতে চোখ মেলে রাখি। অপেক্ষার অবসান হতে অবশ্য কয়েক মিনিট লেগে যায়। বাঁধানো ঘাটের পাশেই ভুশ করে মাথা তুলে ভেসে ওঠে বড়সড় এক গজার মাছ। তবে ক্যামেরা তাক করার সুযোগ না দিয়েই উধাও হয়ে যায় পানির তলদেশে। মাছ দেখে বিদায় নিলাম এখান থেকে।
আঠারো সৈয়দের মোকামের পর পথের দুপাশজুড়ে শুরু হয়েছে বিস্তীর্ণ জলাভূমি। সেই জলাভূমি অনেকটা হাওরের মতোই বড়সড়। সিলেট ও ময়মনসিংহ এলাকায় বড় জলাভূমি বা হাওর-বাঁওড়কে ‘বন্দ’ নামে ডাকা হয়। এর নাম তাই ‘গড়ের বন্দ’। এই গড়ের বন্দের একটি বিলই হচ্ছে ‘পাখন্দ বিল’। পাখন্দ বিলের খ্যাতির কারণ, বিলটিতে গোলাপি পদ্ম বা রক্তকমলের প্রাচুর্য। কিছুদূর যাওয়ার পর পেলাম পাতিহাঁসের বড়সড় একটি দল। রাস্তা দখল করে প্যাঁক প্যাঁক করে ছুটে চলেছে। তার পেছনে বাঁশের কঞ্চি হাতে মধ্যবয়সী একজন লোক হাঁসগুলোকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। হাওর-জলাঞ্চলে এ রকম বড় পরিসরে হাঁস পালন বেশ চোখে পড়ে। হাকালুকিতেও দেখেছিলাম। পথের দুই ধার পানিতে টইটম্বুর। সবখানে কচুরিপানা জমাট বেঁধে ছড়িয়ে আছে। তার মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে যাওয়া সর্পিল পথ। সেই পথে হেঁটে হেঁটে গিয়ে থামি লোকমান আপন ভাইয়ের বাড়ির সামনে। আপন ভাই তখন বাড়িতে ছিলেন না। তবে আমরা যে আসব, সেটি ওনার বাবাকে আগেই তিনি বলে রেখেছিলেন। তাই আগে থেকেই একটা নৌকা ঠিক করে রাখা ছিল। আংকলের সঙ্গে কুশলাদি বিনিময়ের পর আতিথেয়তা গ্রহণ না করে উপায় রইল না। চা-নাশতার পর বৈঠা ঠেলে নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। কচুরিপানার জমাট দঙ্গল ঠেলে নৌকা পাখন্দ বিল পর্যন্ত নিয়ে যেতে না যেতেই অর্ধেক দম বেরিয়ে গেল! তবে নৌকার মাথা পাখন্দ বিলে গিয়ে ঠেকার পর সেই কষ্ট মিইয়ে গেল নিমেষেই। ছিমছাম মনোরম পরিবেশের সুন্দর এক বিল। সবখানে ফুটে থাকা গোলাপি পদ্মের মায়াবী রূপ মন কেড়ে নিল। পানির স্তর থেকে এক-দেড় ফুট ওপর পর্যন্ত উঠে গেছে পদ্মের লতানো গাছ। তার চূড়ায় মাথা উঁচু করে ফুটে আছে মনভোলানো পদ্ম ফুল। নৌকায় করে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম সেই সৌন্দর্য। কোনো কোনো পদ্মের এখন পূর্ণ যৌবন। পাপড়ি ছড়িয়ে গোলাপি আভায় চারপাশ ভরিয়ে দিয়েছে। পাপড়িগুলো ঝরে গিয়ে সোনালি পরাগ রেণু বেরিয়ে পড়া পদ্মগুলোর সৌন্দর্যও অন্য রকম। পদ্মপাতার ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ঝরে পড়া পাপড়িগুলো। ফুটে থাকা একটি পদ্মের ছবি তুলতে গিয়ে দেখলাম, পাপড়ির ভেতরে মৌমাছিরা মধু আহরণে ব্যস্ত। ভালো করে তাকাতে ফুটে থাকা প্রায় সব পদ্মের ভেতরই মৌমাছিদের ব্যস্ততা চোখে পড়ে। ক্লোজআপ ছবি তুলতে গেলে আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে বন বন করে পালিয়ে গেল।
সেই সকালবেলা একপশলা বৃষ্টি হয়েছিল। পদ্মপাতায় এখনো জমে আছে সেই বৃষ্টির পানি। ‘পদ্মপাতার জল’ লাইনটি হয়তো এমন কোনো মোহনীয় দৃশ্য থেকে কবির লেখনীতে এসেছিল। পদ্ম ফুল বাংলাদেশে শরৎ থেকে শুরু করে বসন্ত পর্যন্তও একটু-আধটু ফুটতে দেখা যায়। তবে জলাভূমি রাঙিয়ে রাখে শরত্কালেই। আমাদের দেশে সাধারণত দুই জাতের পদ্ম জন্মে—রক্তকমল ও শ্বেত পদ্ম। রঙের দিক থেকে প্রথমটি গোলাপি, অপরটি সাদা। পদ্মের পাতাগুলো বেশ বড়সড়। তার ফাঁকে ফাঁকে পানিতে ছোট ছোট মাছ নড়াচড়া করতে দেখলাম। এক-দুটি খলসে মাছও চোখে পড়ল। বিলজুড়ে নানা জাতের পাখির বিচরণ ছিল বাড়তি পাওনা। লম্বা গলার সাদা বক, গো-বক আর ফিঙে পাখি চারপাশে ওড়াউড়ি করছিল। বিলের কোনো কোনো জায়গায় জলার ঘাসবন। ঘাসবনের এক জায়গায় একপাল গরু চরে বেড়াতে দেখলাম। ডিঙি নৌকা ভাসিয়ে মাছ ধরার ছবিও চোখে পড়ল। গড়েরবন্দের জলাভূমি আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামজুড়ে ছড়িয়ে আছে। ভরা মৌসুমে বিল থেকে কেউ ঘাস কাটে, কেউ মাছ ধরে, আবার শৌখিন পদ্ম শাপলা সংগ্রহকারীরা তো আছেই। পানি কমে গেলে ধানের চাষ হয়। তবে এবার কচুরিপানার আধিক্যের কারণে অনেকেরই মুখ গোমড়া।
আকাশে মেঘদলের ঘোরাঘুরি চলছে। অন্যদিকে দিনাতিপাত শেষ করে সূর্যও যাই যাই করছে। আলো নিভে যাওয়ার আগে আগেই তাই সামনের কচুরিপানার দঙ্গল পার হওয়ার তাগাদা অনুভব করলাম।
কিভাবে যাবেন
পাখন্দ বিলে যাওয়ার জন্য ঢাকা থেকে বিয়ানীবাজার রুটের বাসে আসতে হবে। ভাড়া ৫০০ টাকার মধ্যেই। এ ছাড়া সিলেট সদর পৌঁছে তারপর স্থানীয় পরিবহনেও যাওয়া যাবে। শহর থেকে রিকশা কিংবা অটোরিকশা নিতে পারেন। ভাড়া যাওয়া-আসা মিলিয়ে যথাক্রমে দেড় শ ও পাঁচ শ টাকার মধ্যে।