নিজস্ব প্রতিবেদক:: মৌলভীবাজারের বড়লেখার দক্ষিণ শাহবাজপুর ইউনিয়নের মোহাম্মদনগর গ্রামে বাঁশ পড়ে বিদ্যুতের তারে টান খেয়ে ভেঙে পড়া প্রধানমন্ত্রীর উপহারের আশ্রয়ন প্রকল্পের একটি ঘরের বারান্দা অবশেষে মেরামত করা হচ্ছে। দুই-তিনদিনের মধ্যে ঘরের বারান্দার মেরামত কাজ শেষ হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
গত ১৮ ডিসেম্বর বাঁশ কাটার সময় বাঁশ পড়ে বিদ্যুতের তারে টান খেয়ে ঘরের বারান্দা ভেঙে পড়ে। কিন্তু গত ২০ ডিসেম্বর প্রশাসন আশ্রয়ন প্রকল্পের ওই ঘরটির দরজা, জানালা, টিনের চালাসহ আসবাবপত্র ভাঙচুর ও চুরির অভিযোগে থানায় মামলা করে। বড়লেখা সদর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মো. ফজলুল করিম চৌধুরী বাদী হয়ে দক্ষিণ শাহবাজপুর ইউনিয়নের মোহাম্মদনগর গ্রামের বাসিন্দা মো. সাদিক, আব্দুল মালিক, মো. রেজা ও জাসমিন বেগমকে আসামি করে মামলাটি করেন।
এদিকে ভাঙচুর-চুরির অভিযোগে দায়ের করা মামলার ঘটনায় বিষ্মিত এলাকাবাসী। তাদের দাবি, মামলার এজাহারে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে তা সঠিক নয়। মূলত আশ্রয়ন প্রকল্পের এই ঘরের নিম্নমানের কাজ ঢাকতে এই সাজানো মামলা করা হয়েছে বলে তারা পাল্টা অভিযোগ করে ঘটনাটির নিরপেক্ষ তদন্ত চান। এই ঘটনা নিয়ে গত ০৫ জানুয়ারি বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলে টনক নড়ে সংশ্লিষ্টদের। এরপর ভেঙে পড়া ঘরটির বারান্দার মেরামতের কাজ শুরু হয়।
রোববার সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, ভেঙে পড়া ঘরের বারান্দার দুটি পিলারের কাজ শেষ হয়েছে। একটি পিলারে শ্রমিকরা আস্তর করছেন। আগের পিলারগুলোতে রড না থাকলেও নতুন পিলারগুলোতে রড দেওয়া হয়েছে। ওই ঘরের বাসিন্দা পারভিন নেছাকে তখন পাওয়া যায়নি।
স্থানীয় বাসিন্দা নুরুল ইসলাম ও আব্দুল হান্নান বলেন, ‘৩-৪ দিন ধরে বাঁশ পড়ে বিদ্যুতের তারে টান খেয়ে ভেঙে পড়া আশ্রয়নের ঘরের কাজ চলছে। পত্রিকায় খবর প্রকাশের পর থেকে প্রশাসন তড়িঘড়ি করে ঘরের কাজ শুরু করেছে। এসব ঘরের কাজ নিম্নমানের হয়েছিল; যার কারণে সামন্য বাঁশ পড়ে ভেঙে গেছে। কাজ ভালো হলে কখনও ভেঙে পড়ত না।’
এ ব্যাপারে জানতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুনজিত কুমার চন্দের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আশ্রয়ন প্রকল্পের যে ঘরের বারান্দা ভেঙে পড়েছিল, সেই ঘরটির কাজ প্রায় শেষ হয়ে গেছে।’ তবে বিষয়টি নিয়ে তিনি প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলতে বলেন।
প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা উবায়েদ উল্লাহ খান বলেন, ‘যে ঘরের বারান্দা ভেঙে পড়েছিল, ওই ঘরে কাজ করানো হচ্ছে। কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে।’
ঘর ভাঙচুর-চুরির অভিযোগে থানায় দায়ের করা মামলার ব্যাপারে শাহবাজপুর তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ পুলিশ পরিদর্শক মো. রবিউল হক রোববার বিকেলে মুঠোফেনে বলেন, ‘ঘটনাটি এখনও তদন্ত চলছে। আশপাশের কয়েকজনের স্বাক্ষি নেওয়া হয়েছে। মামলার বাদি ও এজাহারে উল্লেখিত স্বাক্ষিদের বক্তব্য নেওয়ার বাকি রয়েছে।’
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, উপজেলার দক্ষিণ শাহবাজপুর ইউনিয়নের মামদনগরের (মোহাম্মদনগর) প্রধানমন্ত্রীর উপহারের পাওয়া আশ্রয়ন প্রকল্পের একটি ঘরে থাকেন পারভীন নেছা। ওই এলাকার বাসিন্দা মো. সাদিক ও তার পিতা আব্দুল মালিক আশ্রয়ন প্রকল্পে পারভীন নেছার পাশের ঘরে থাকেন। মো. রেজা ও জাসমিন বেগম তাদের আত্মীয়। গত ১৮ ডিসেম্বর রাত আনুমানিক ৮টা থেকে ৯টার দিকে মো. সাদিক, আব্দুল মালিক, মো. রেজা ও জাসমিন বেগম দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পারভীন নেছাকে আশ্রয়ন প্রকল্পের ঘর ছেড়ে যেতে হুমকি দেন। একপর্যায়ে তারা পারভীন নেছার জন্য বরাদ্দ হওয়া বসতঘরে হামলা চালিয়ে দরজা, জানালা, টিনের চালাসহ আসবাবপত্র ভাঙচুর করেন। পাশাপাশি তারা (আসামিরা) বসতঘর সংলগ্ন চারা সবজিগাছ কেটে ৮০ হাজার টাকার ক্ষতিসাধন, ঘরের বাসনপত্র ও নগদ টাকা চুরি এবং ৫ হাজার টাকার বাঁশ ঝাড় কেটে নেন।
এদিকে ঘটনার পর সরেজমিনে ঘটনাস্থলে গিয়ে মামলার এজাহারে উল্লেখিত ঘটনার সঙ্গে বাস্ততার কোনো মিল পাওয়া যায়নি। দেখা যায়, উপকারভোগী পারভিন নেছার ঘরের বারান্দার তিনটি পিলার ভাঙা আছে। বারান্দার চালা মাটিতে পড়ে আছে। তবে দরজা, জানালা কিংবা দেয়ালে ভাঙচুরের কোনো আলামত নেই। আঙিনার চারাগাছ সম্পূর্ণ অক্ষত। এছাড়া মামলার এজাহারে ঘটনার সময় উপকারভোগী পারভীন নেছা ঘরে উপস্থিত থাকার কথা এবং ১ নম্বর স্বাক্ষী হিসেবে উল্লেখ করা হলেও তার (পারভীন নেছা) দাবি, ওই দিন তিনি বাড়িতে (আশ্রয়নে) ছিলেন না।
মুঠোফোনে আলাপকালে পারভীন নেছা বলেছিলেন, ‘যেদিন বারান্দা ভাঙছে ঐদিন আমি ওখানে (ঘটনাস্থলে) ছিলাম না। গাজিটেকায় ছিলাম। আমি পরের দিন গিয়া দেখছি বারান্দা ভাঙা। কিভাবে ভাঙছে তাও জানিনা। এসিল্যান্ড স্যার ও তহশিলদার মরির (মহুরি) দিয়া মামলা লেখাইছন। তারা মামলাত কিতা লেখছইন (লিখেছেন) আমি কইতাম পারতাম নায়।’
মামলার বাদী ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মো. ফজলুল করিম চৌধুরী বলেছিলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আমি মামলা করেছি। এর থেকে বেশি কিছু মন্তব্য করতে পারব না।’
এদিকে মামলার এজাহারে ঘটনার সময় রাত ৮টা থেকে ৯টা উল্লেখ থাকলেও আশ্রয়ন প্রকল্পের পাশের জামে মসজিদের ইমাম মো. আব্দুল মন্নান বলেছিলেন, ‘ঘরের বারান্দা যখন ভেঙে পড়ে, তখন আনুমানিক দুপুর দেড়টা হবে। আমি মসজিদের সামনে ছিলাম। লোকজন বাঁশ কাটার সময় কয়েকটি বাঁশ কারেন্টের লাইনে পড়ে ঘরের বারান্দায় টান খায়। এরপর বারান্দাটি পড়ে যায়। কেউ ইচ্ছা করে ভাঙেনি কিংবা কোনো মারামারির ঘটনায়ও ভাঙেনি।’
স্থানীয় ইউপি সদস্য আব্দুল মন্নান বলেছিলেন, ‘এখানে কেউ হামলা করে ঘর ভাঙেনি। বাঁশঝাড় কাটার সময় ১ থেকে ২টি বাঁশ কারেন্টের লাইনে পড়ে ঘরের পিলারে টান খেয়ে দুইটি পিলার সম্পূর্ণ ও একটি পিলার আংশিক ভেঙে পড়ে। মূলত নিম্নমানের কাজের কারণেই পিলারসহ বারান্দা মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে। তা ঢাকতেই প্রশাসন হামলা ও ভাঙচুরের অভিযোগ এনে থানায় মামলা করেছে।’
বড়লেখার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. জাহাঙ্গীর হোসেইন মুঠোফোনে বলেছিলেন, ‘উপকারভোগী পারভিন নেছা আমাদের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন পাশের ঘরের লোকজন তাকে ভয়ভীতি দেখায়। তাকে থাকতে দেয়না। বিভিন্ন ধরনের ঝামেলা করে। এই হিসেবে আমরা ধারণা করেছি এটা তারা করেছে (বারান্দা ভেঙেছে)। প্রথমে তারা (আসামিরা) বলেনি। পরে তারা ভাঙার কথা বলেছে এবং ঠিক করে দেবে বলে জানিয়েছে। এটা এখন আদালতের বিষয়।’