সৌদি গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তা সেজে ভারতীয় নাগরিককে অপহরণ করে অর্থ ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনায় আটক তিন বাংলাদেশিকে দেশটির শরিয়াহ আইনে প্রত্যেকের ডান হাত ও বাম পা কর্তন করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। সম্প্রতি সৌদির আদালত এ রায় ঘোষণা দেন।
এই তিন বাংলাদেশির পক্ষে তাদের স্বজনরা সৌদি সরকারের কাছে বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে ক্ষমার আবেদন করেছেন।
রায় কার্যকরের পর তাদের দেশে প্রেরণেরও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সৌদি আরবের পূর্বাঞ্চলীয় শহর জুবাইলে ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বরের ঘটনা। ওইদিন ঘটনাস্থল থেকে আটক হন প্রবাসী তিন বাংলাদেশি। পরবর্তীতে পুলিশি হেফাজতে তাদের জবানবন্দি ও জব্দকৃত আলামতের ভিত্তিতে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় গত ৮ মে দেশটির আদালত উল্লিখিত শাস্তি দেন।
সৌদি আরবে সাজাপ্রাপ্ত তিন বাংলাদেশি হলেন- কুমিল্লার তিতাস থানার কাশীপুর গ্রামের কামাল উদ্দিনের ছেলে কাউসার মাহমুদ (পাসপোর্ট এফ-১১৫২৫২০), নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও থানার ঝরছার গ্রামের আব্দুল মালেকের ছেলে শাহিনুর (পাসপোর্ট এ-০৯৭৭৭৬২) ও মাদারীপুরের রাজৈর থানার দুর্গাবার্দি গ্রামের মোহাম্মদ সৈয়দ আলীর ছেলে রুবেল খালাসী (পাসপোর্ট এবি-১৪৭২৪৭২)।
জানা গেছে, সৌদি আরবের রিয়াদে বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম কাউন্সিলর মো. সারোয়ার আলম প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান সচিব বরাবর একটি চিঠি পাঠিয়েছেন সম্প্রতি। চিঠিতে তিন বাংলাদেশির অপরাধের ধরণ এবং সৌদি আদালতের রায়ের সর্বশেষ অবস্থা তুলে ধরেন।
তিনি চিঠিতে আদালতের রায়ের তথ্যানুযায়ী উল্লেখ করেন, ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর সৌদি আরবের পূর্বাঞ্চলীয় শহর জুবাইলের রাস্তায় কর্তব্যরত পেট্রোল পুলিশ একটি চলন্ত করোলা গাড়ির পেছন থেকে এক ব্যক্তি সাহায্য চাচ্ছে মর্মে দেখতে পায়। পুলিশ ওই গাড়ি থামার নির্দেশ দিলেও চালক না থামিয়ে পালিয়ে যেতে থাকে। ধাওয়া করে পুলিশ ওই গাড়ির পেছন সিটে ক’জন ভারতীয় নাগরিককে (সাহায্য প্রার্থী) দেখতে পান।
পুলিশ ওই গাড়িতে থাকা তিন বাংলাদেশিকে নকল পিস্তল, দু’জন নেপালি নাগরিকের ড্রাইভিং লাইসেন্স ও একজন ভারতীয় নাগরিকের ইকামা কার্ডসহ তাদের আটক করে। তাদের জুবাইল (রিয়াদ) পুলিশ স্টেশনে হস্তান্তর করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া ওই ভারতীয় নাগরিককে তার কর্মস্থল থেকে ভাড়ার বিনিময়ে বাসায় পৌঁছে দেয়ার জন্য অভিযুক্ত তিনজন গাড়িতে উঠায়। পরবর্তীতে তিনজন নিজেদের গোয়েন্দা পুলিশ, জেনারেল পুলিশ বলে পরিচয় দিয়ে পিস্তল দিয়ে ভয় দেখিয়ে তার কাছ থেকে অর্থ সামগ্রী ছিনিয়ে নেয়।
সারোয়ার আলম আরও উল্লেখ করেন, পরবর্তীতে সৌদি পুলিশের বিস্তারিত তদন্তে প্রমাণিত হয় যে, এই ঘটনা ছাড়াও ইতোপূর্বে ওই এলাকায় প্রবাসী তিন শ্রমিক আরও অনেক ছিনতাই ও ডাকাতি কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। সেই সকল ঘটনায় ভুক্তভোগীদের জবানবন্দি এবং অভিযুক্তদের সঙ্গে পাওয়া অকাট্য প্রমাণাদির ভিত্তিতে সর্বোপরি অভিযুক্তদের নিজের মোবাইলে তাদের বিভিন্ন অপকর্মের ভিডিও ও ছবিতে প্রমাণিত হয়েছে যে, ওই তিন ব্যক্তি ডাকাতি চক্র গঠন করে নিজেদের সৌদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য বা কর্তাব্যক্তি পরিচয় দিয়ে অপকর্ম করে আসছিল।
অধিক সংখ্যক অপরাধের কারণে এবং অপরাধের ধরণ বিবেচনা করে আদালত তিন বাংলাদেশিকে ইসলামি আইন অনুযায়ী ডাকাতির শাস্তি হিসেবে (হদ্দে হেরাবা) প্রত্যেকের ডান হাত এবং বাম পা কর্তন এবং আটক হওয়ার দিন থেকে এক বছর কারাভোগের রায় দেন। রায় কার্যকরের পর তাদের দেশে প্রেরণের নির্দেশ দেয়া হবে।
শ্রম কাউন্সিলর বলেন, রায় ঘোষণার ৩০ দিনের মধ্যে আপিলের সময় দেয়া হয়। দূতাবাস কর্তৃপক্ষ জেলখানায় তাদের সঙ্গে দেখা করে যেকোনো প্রয়োজনে দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেয়।
কিন্তু ওই তিন বাংলাদেশি বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গে এ ব্যাপারে কোনো যোগাযোগ করেনি। সাজা ঘোষণার কিছু দিনের মধ্যে তাদের সৌদি সরকার সাজা মওকুফ করে দেবেন এমন ধারণা থেকে তারা আপিল করা থেকে বিরত থেকেছেন বলে পরে দূতাবাসকে জানিয়েছেন সাজাপ্রাপ্ত তিন বাংলাদেশি।
এদিকে নির্দিষ্ট সময়র মধ্যে আপিল না করায় সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন শেষে যেকোনো মুহূর্তে রায় কার্যকরের প্রস্তুতি রয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষের। এই ঘটনাটিকে স্পর্শকাতর উল্লেখ করে সারোয়ার আলম চিঠিতে উল্লেখ করেন এহেন গর্হিত অপরাধের প্রতি অনমনীয় দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে প্রবাসে দেশের ভাবমূর্তি সমুন্নত রাখার স্বার্থে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পরামর্শক্রমে দূতাবাসের পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনা প্রদানের জন্য অনুরোধ করা হলো।
আরেক চিঠিতে শ্রম কাউন্সিলর প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে জানান, বর্তমান প্রেক্ষাপটে অপরাধীদের পরিবারের পক্ষ থেকে ক্ষমার আবেদন পাওয়া গেলে দূতাবাস সৌদি আরবে যথাযথ কর্তৃপক্ষের বরাবর প্রেরণ করা যেতে পারে। পরবর্তীতে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দণ্ডপ্রাপ্ত তিন বাংলাদেশির পক্ষে তাদের স্বজনরা আলাদা আলাদাভাবে সৌদি সরকারের কাছে দয়া মওকুফ চেয়ে আবেদন করেন।
এরপর প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সংস্থা ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের পক্ষ থেকে গত বৃহস্পতিবার দণ্ডপ্রাপ্ত কাওসার মাহমুদ, শাহিনুর ও রুবেল খালাসীর পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদিত ক্ষমার আবেদন রিয়াদস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। বাংলাদেশ দূতাবাস ক্ষমার এই আবেদন সৌদি সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরে পেশ করবেন। তবে শেষ পর্যন্ত তাদের ক্ষমা করে দেয়া হবে নাকি শাস্তি কার্যকর করা হবে তা কিছুদিনের মধ্যেই জানা যাবে।