হাতে হলুদ রঙের একটি ছোট পলিথিন ব্যাগ। এরমধ্যে একসেট পুরোনো জামাকাপড়। ধীর পায়ে বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে আসলেন। চেহারায় অসুস্থতার ছাপ। যেন নড়াচড়ার শক্তি হারিয়েছেন।কোথা থেকে আসছেন- জিজ্ঞেস করতেই, অনেকটা ভাবলেশহীনভাবে চেয়ে থাকলেন। এরপর অনেকটা বিরক্তি নিয়েই বললেন, সৌদি থেকে। কণ্ঠে ক্ষোভ আর চোখে-মুখে হতাশা। চোখ ছলছল করছে। আর কিছু জিজ্ঞেস করতেই হাঁটা দিলেন সামনের দিকে।
তবে যাওয়ার সময় বললেন, পারলে সৌদিতে আর মেয়ে মানুষ পাঠাইয়েন না।
ওরা বহুত খারাপ। আমাদেরকে মানুষই মনে করে না। যা ইচ্ছা, তাই ব্যবহার করে। চল্লিশ পেরোনো এই নারীর বাড়ি ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলায়। মাস ছয়েক আগে গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে সৌদি আরব গেছেন। বেতন পাওয়া তো দূরের কথা, উল্টো কপালে জুটেছে অমানসিক নির্যাতন। মঙ্গলবার রাত ১১টায় এমিরেটস এয়ারলাইন্সের একে-৫৮৪ নম্বর ফ্লাইটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান এই নারী। এর আগে সৌদির গৃহকর্তার নির্যাতনের শিকার হয়ে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন দেশটিতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের রিয়াদস্থ সেইফ হোমে।
সৌদি আরব যাওয়ার সময় যে কাপড়ে গিয়েছিলেন, সেই কাপড়েই ফিরেছেন তিনি। তার সঙ্গে একই ফ্লাইটে দেশে ফিরেছেন আরো ৪২ নারীকর্মী। যারা প্রত্যেকেই একই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন। এদের একজন লুৎফা খাতুন। তিনি বলেন, তাকে ১২ দিন ধরে একটি কক্ষে আটকে রেখেছিল গৃহকর্তার ছেলে। পরে মৃত্যুমুখে পতিত হলে তাকে রাস্তায় ফেলে আসা হয়। সেখান থেকে উদ্ধার করে সেইফ হোমে রেখে আসে পুলিশ। তিনি প্রায় একবছর কাজ করলেও গৃহকর্তা কোনো বেতন দেননি। ফেরত আসা নারীদের অভিযোগ, তারা নিয়মিত বেতন পাননি, ঠিকমতো খেতে দেয়া হয়নি। এ ছাড়া সবারই অভিযোগ, মালিকের হাতে মারধরসহ নানাধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তারা।
মঙ্গলবার এই নারীদের দেশে ফেরার সময় বিমানবন্দরে তাদের সার্বিক সহযোগিতা দেয় প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড। এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন, বোর্ডের সহকারী পারিচালক জাহিদ আনোয়ার, তানভীর আহমেদ, উপসহকারী পরিচালক আবদুল কাদেরসহ অন্য কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। এ ছাড়া ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের পক্ষ থেকে ফেরত আসা এ নারীদের প্রত্যেককে খাবার সরবরাহ করা হয়। দূরের নারীকর্মীদের আশকোনাস্থ ব্র্যাকের লার্নি সেন্টারে থাকার ব্যবস্থা করা হয়।
বিএমইটির তথ্যমতে, গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে এ পর্যন্ত আড়াই লাখেরও বেশি বাংলাদেশি নারী সৌদি আরবে গেছেন। ১৯৯১ সাল থেকে দেশটিতে নারী কর্মীরা যাওয়া শুরু করে। তবে ব্যাপকভাবে শুরু হয় ২০১৫ সালের পর থেকে। ওই বছর ২০ হাজার ৫২ জন নারীকর্মী দেশটিতে যায়। এরপর থেকে প্রতিবছরই এ সংখ্যা বাড়তে থাকে। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালে ৬৮ হাজার ২৮৬ জন, ২০১৭ সালে ৮৩ হাজার ৩৫৪ জন নারীকর্মী সৌদি আরব যান। আর চলতি বছরের প্রথম ৮ মাসে দেশটিতে নারীকর্মী গেছেন ৪৯ হাজার ৬৪০ জন।
এদিকে নারীকর্মী যাওয়ার পর থেকেই অতিরিক্ত কাজ করানো, মারধর, শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের অভিযোগ আসতে থাকে। এসব কারণে দেশটিতে ফিলিপাইন, নেপাল এবং ইন্দোনেশিয়া তাদের নারীকর্মী পাঠানো বন্ধও করে দেয়। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশি নারীকর্মীদের চাহিদা বাড়ে দেশটিতে। কিন্তু নারীদের ওপর নির্যাতন হবে না- এমন শর্তে বাংলাদেশ কর্মী পাঠালেও বাস্তবে তার প্রতিফলন ঘটেনি। বরং ফেরত আসা নারীদের ভাষ্যমতে, নির্যাতন থেমে নেই। সংশ্লিষ্ট গৃহকর্তার বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এই নির্যাতনের কারণ কেউ জানতে পারে না।
এমনকি বাংলাদেশ দূতাবাসেরও তেমন কিছু করার নেই এক্ষেত্রে। জানা গেছে, বিভিন্ন সময় গৃহকর্তার নির্যাতনের শিকার হয়ে পালিয়ে আসা নারীরা দেশটির বাংলাদেশ দূতাবাসের রিয়াদ ও জেদ্দার দুটি সেইফ হোমে আশ্রয় নেন। ফিরে আসা নারীরা জানান, প্রতিদিন কমপক্ষে ৫০-৬০ জন নারী সেখানে আশ্রয় নেন। বর্তমানে শুধু রিয়াদের সেইফ হোমেই রয়েছে দুই শতাধিক নারী গৃহকর্মী।
মঙ্গলবার রাতে কথা হয় ফেরত আসা নারী নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা উপজেলার বাসিন্দা লুৎফা খাতুনের সঙ্গে। তিনি জানান, গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে তার গ্রামের দালাল জয়নালের মাধ্যমে সৌদি আরবে গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে যান। কিন্তু যে বাসায় তাকে কাজ দেয়া হয় সেই বাসার মালিক, মালিকের স্ত্রী এবং ছেলে প্রায় প্রতিদিনই নানা কারণে মারধর করতো। খেতে দিত না। এতে করে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ সময়ে তাকে চিকিৎসাও করায় নি। বাড়ির সব কাজ তাকেই করতে হতো। অনেক সময় মধ্যরাত পর্যন্ত কাজ করতে হতো। কিন্তু গত একবছরে এক মাসের বেতনও তাকে দেয়া হয়নি। বেতন চাইলে মাঝে মাঝে গৃহকর্তার স্ত্রী কাগজে তার সই নিতো। কিন্তু টাকা দিতো না।
তিনি বলেন, গৃহকর্তার ছেলে ছিল খুবই খারাপ। তাকে নানা কারণে প্রায়ই মারধর করতো। তাদের এই নির্যাতন থেকে বাঁচতে পালিয়ে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করেছেন কিন্তু পারেননি। লুৎফা খাতুন জানান, ২ মাস আগে একদিন তাদের কাপড়চোপড় ইস্ত্রি করছিলাম। এ সময় গৃহকর্তার ছেলে মিথ্যা ও তুচ্ছ কারণে তাকে মারধর করে। তিনি বলেন, ওইদিন মাগরিবের সময় থেকে এশা পর্যন্ত তাকে একটানা মারধর করে। রড দিয়ে বেধড়ক পেটায়, উপর্যুপরি লাথি মারতে থাকে।
ওইদিনের বীভৎসতার কথা বলতে গিয়ে লুৎফা খাতুন কেঁদে ফেলেন। তার সারা শরীরে আঘাতের ক্ষত রয়েছে বলে জানান। এ সময় তিনি হাতের আঘাতের চিহ্ন দেখান। লুৎফা বলেন, ‘ওইদিন পালিয়ে যাওয়ার সময় গৃহকর্তার ছেলের খালাতো ভাই আমাকে দেখে ফেলে। পালাতে বাধা দেয়। পরে নির্যাতনের কথা জানিয়ে পা জড়িয়ে ধরি। তিনি আমাকে একটি বাসায় নিয়ে গিয়ে গৃহকর্তার ছেলেকে খবর দেন। সেখানেও তাকে মারধর করে। এ সময় গৃহকর্তার ছেলেকে তিরস্কার করে ওই আশ্রয়দাতা। তিনি বলেন, সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয় গৃহকর্তার মায়ের বাড়িতে।
সেখানে দোতলার একটি কক্ষে আটকে রাখা হয়। সেই ঘরে একদিন কেটে যাওয়ার পরও তাকে কোনো খাবার দেয়া হয়নি। পরদিন ওই বাসায় এক কাজের মহিলা বিষয়টি টের পেয়ে গোপনে খাবার দেয়। এরপর ওই রুমে আরো ১২ দিন রাখা হয় তাকে। কিন্তু এর মধ্যে একদিনও তাকে খাবার দেয়া হয়নি। অবশেষে ১২ দিন খাবার না খাওয়ায় তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন। তার নড়াচড়ার শক্তি ছিল না। পরে নিশ্চিত মৃত্যু হবে মনে করে তাকে রাস্তায় ফেলে আসে। সেখান থেকে দুই ব্যক্তি উদ্ধার করে পুলিশের কাছে নিয়ে যায়। থানায় তাকে খাবার দেয়া হয়। পুলিশ সব কথা শুনে তাকে সফর জেলে পাঠায়। সেখানে একমাস অবস্থানের পর মঙ্গলবার দেশে পাঠানো হয়।
একই ফ্লাইটে ফেরা নরসিংদীর শিল্পী রানী শাহা বলেন, তিনি রিয়াদের সেইফ হোমে ছিলেন। বলেন, তাদের সঙ্গে মানসিক ভারসাম্য এক নারী আসছিলেন। কিন্তু দুবাই বিমানবন্দর থেকে তাকে আর পাওয়া যায়নি। তার খবর কেউ বলতে পারছেন না। তিনি জানান, প্রতিদিনই সেইফ হোমে নির্যাতিত নারীরা আসছেন। তারা আসার আগেও প্রায় ৫০ জন নতুন করে এসেছে। এ ছাড়া আরো দুই শতাধিক নারীকর্মী রিয়াদের সেইফ হোমে অবস্থান করছেন।
এদিকে মঙ্গলবার রাতে বিমানবন্দরে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে দেখা গেছে, নির্দিষ্ট ওই ফ্লাইট ছাড়াও বিভিন্ন ফ্লাইটে অনেক নারীই ফেরত আসছেন। বিমানবন্দরে কর্মরত সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রায় প্রতিদিনই অসংখ্য নারী ফেরত আসেন। কিন্তু সেসব খবর অনেকেই জানেন না।