বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ খ্রীষ্টাব্দ | ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ



Sex Cams

                    চাইলে বিজ্ঞাপন দিতে পারেন

প্রকৃতিপুত্র নিসর্গসখা অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা
বিশেষ প্রতিবেদক

বিশেষ প্রতিবেদক



বিজ্ঞাপন

বৃক্ষাচার্য, জীববিজ্ঞানী, বিজ্ঞান লেখক, অনুবাদক ও উদ্ভিদ গবেষক নিসর্গসখা অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা বলেছিলেন, জীববৈচিত্র্য রক্ষার আন্দোলন আমাদের দেশে আছে, জোরেশোরেই আছে, তবে প্রাণিজগতের দিকে পক্ষপাত অধিক, উদ্ভিদজগৎ অপেক্ষাকৃত অবহেলিত। বনরক্ষা বিষয়ে আমাদের উদ্বেগ আছে, তবে একক প্রজাতির বিলুপ্তি ঠেকানো আর বনরক্ষা দুটি সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। প্রথমটির জন্য প্রয়োজন প্রতিটি বিপন্ন প্রজাতি বাঁচানোর দায়িত্ববোধ ও প্রকৃতিপ্রেম। এখানে ভালোবাসা মুখ্য, বৈষয়িকতা গৌণ। যা আমাদের মনে আজও তেমন নিবিড় ও গভীর নয়।

মৌলভীবাজারের বড়লেখার পাথারিয়া পাহাড়ের কোলে জন্ম দ্বিজেন শর্মার। প্রকৃতি ও গাছগাছালির প্রতি ভালোবাসা ও লেখালেখির কারণে তিনি উপমহাদেশের প্রকৃতিপ্রেমী প্রতিটি মানুষের কাছে এক বিষ্ময়। প্রকৃতি নিয়ে তার আজীবনের ভালবাসা থেকেই দ্বিজেন শর্মাকে ‘নিসর্গসখা’ বলা হয়।

বাংলাদেশে প্রকৃতি ও নিসর্গবিষয়ক লেখালেখিরও পথিকৃৎ ছিলেন দ্বিজেন শর্মা। আজ এ মানুষটার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ৮৮ বছর বয়সে রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

নিসর্গপ্রেমিক দ্বিজেন শর্মার জন্ম ১৯২৯ সালের ২৯ মে, মৌলভীবাজারের বড়লেখার পাথারিয়া পাহাড়ের কাছে শিমুলিয়া গ্রামের কবিরাজ বাড়িতে। তার বাবা চন্দ্রকান্ত শর্মা ছিলেন ওই অঞ্চলের বিখ্যাত কবিরাজ। তাই বাড়িটি আজও কবিরাজ বাড়ি বলে পরিচিত। মায়ের নাম মগ্নময়ী দেবী। ছয় ভাইবোনের মধ্যে দ্বিজেন শর্মা ছিলেন পঞ্চম।

উদ্ভিদের প্রতি ভালবাসা দ্বিজেন শর্মার বাবার কাছ থেকেই পাওয়া। বাবার বারণ সত্ত্বেও মাঝে মাঝেই ছুটে যেতেন গহিন জঙ্গলে। প্রকৃতি পুত্র দ্বিজেন শর্মার মূল প্রেরণা ছিলো দেশের সর্ব বৃহৎ জলপ্রপাত মাধবকুন্ডের উৎস পাথারিয়া পাহাড়। তার দীর্ঘ কর্মময় জীবনে পৃথিবীর বহু অঞ্চলে ভ্রমণ ও সময় কাটলেও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত হৃদয়ে দোলা দিতো শৈশব স্মৃতির ঘন বনাঞ্চল আবৃত বড়লেখা উপজেলার পাতারিয়া। যেখান থেকে সৃষ্টি মাধবকুন্ড জলপ্রপাত।

বৃক্ষসখা দ্বিজেন শর্মার ডাকনাম ছিল খোকা। পড়াশোনা শুরু হয় শিমুলিয়া গ্রামের পাঠশালায়। আসামের করিমগঞ্জ পাবলিক হাইস্কুল থেকে ১৯৪৭ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। কলকাতা সিটি কলেজ থেকে স্নাতক অর্জনের পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ভিদবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেন।

তিনি উদ্ভিদবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে চাকরি করেছেন করিমগঞ্জ কলেজ, বিএম কলেজ ও নটরডেম কলেজে। পরে মস্কোর প্রগতি প্রকাশনে চাকরি করেছেন প্রায় ২০ বছর। এরপর দেশে ফিরে যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিতে।

১৯৬০ সালে দেবী চক্রবর্তীর সঙ্গে দ্বিজেন শর্মার বিয়ে হয়। তাদের এক ছেলে সুমিত্র শর্মা আর এক মেয়ে শ্রেয়সী শর্মা।

দ্বিজেন শর্মা শত ব্যস্ততার মাঝে দেশের বিভিন্ন এলাকাসহ রাজধানীতে অসংখ্য জায়গায় গাছ লাগিয়েছেন নিজ হাতে। তৈরি করেছেন উদ্যান ও বাগান। গাছের পরিচর্যা ও সংরক্ষণ এবং প্রকৃতিবান্ধব শহর গড়ার জন্য লড়াইও করেছেন।

প্রকৃতি ও নিসর্গবিষয়ক লেখালেখিরও পথিকৃৎ দ্বিজেন শর্মা। উদ্ভিদ ও প্রকৃতি নিয়ে ১৯৬২ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত তিনি তার প্রথম গ্রন্থ ‘শ্যামলী নিসর্গ’ লেখেন। বাংলা ভাষায় এরকম বই এটাই প্রথম ছিল।

গাছ, ফুল বা ফলের বর্ণনায় লিখেছেন ময়মনসিংহ গীতিকা, জীবনানন্দ দাশ, জসীমউদ্দীনের কাব্য থেকে শুরু করে সিলেটের লোকগীতি কিংবা মধ্যযুগের কাব্যগাথার উদ্ধৃতি।

তার লেখা বইয়ের মধ্যে রয়েছে-‘সপুষ্পক উদ্ভিদের শ্রেণীবিন্যাস’, ‘ফুলগুলি যেন কথা’, ‘গাছের কথা ফুলের কথা’, ‘এমি নামের দুরন্ত মেয়েটি’, ‘নিসর্গ নির্মাণ ও নান্দনিক ভাবনা’, ‘সমাজতন্ত্রে বসবাস’, ‘জীবনের শেষ নেই’, ‘বিজ্ঞান ও শিক্ষা : দায়বদ্ধতার নিরিখ’, ‘ডারউইন ও প্রজাতির উৎপত্তি’, ‘বিগল যাত্রীর ভ্রমণ কথা’, ‘গহন কোন বনের ধারে’, ‘হিমালয়ের উদ্ভিদরাজ্যে ডালটন হুকার’, ‘বাংলার বৃক্ষ’ ইত্যাদি।

দ্বিজেন শর্মা ২০১৫ সালে একুশে পদক, ১৯৮৭ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, শিশু একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, নুরুল কাদের শিশুসাহিত্য পুরস্কার, রবীন্দ্র পদক, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন পরিবেশ পুরস্কারসহ নানা সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।

বাংলাদেশ তরুপল্লবের সভাপতি সেলিনা রহমান জানান, বৃক্ষাচার্য ও বরেণ্য নিসর্গী অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে রোববার বিকেলে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে আলোচনা সভা ও তরুপল্লব দ্বিজেন শর্মা নিসর্গ পুরস্কার অর্পণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনোয়ার হোসেন অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মার স্মৃতিচারণ করে বলেন, স্যারের সঙ্গে মেশার সুযোগ হয়েছিল আমার। তিনি ছিলেন অতি নিভৃতচারী অসাধারণ একজন মানুষ। যার কাছ থেকে প্রকৃতি এবং আমরা অনেক কিছুই পেয়েছি। স্যার আজ নেই তাই উনার অসমাপ্ত কাজের দায়িত্ব আমাদেরকে নিতে হবে।