আকমল হোসেন:: ‘ফলন্ত ধানের গন্ধে—রঙে তার—স্বাদে তার ভ’রে যাবে আমাদের সকলের দেহ’—জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতায় যে ছবি এঁকেছেন, হাওরপারের গ্রামগুলো এখন যেন ঠিক তা–ই। পাকা ধানের সোনালি রং আর পাকা ফসলের গন্ধে ভরে উঠেছে এখানকার জনপদ। ফসলের খেতে চলছে ধান তোলার উৎসব। ধান ছাড়া অন্য কোনো দিকে ফিরে তাকানোর অবসরটুকু কারও নেই।
মৌলভীবাজারের কাউয়াদীঘি, হাকালুকি, হাইল হাওরসহ সব কটি ছোট-বড় হাওরপার এখন কবিতায় আঁকা জীবনানন্দের গ্রাম। সেসব গ্রামে গেলে চোখে পড়বে ‘আঙিনা ভরিয়া আছে সোনালি খড়ের ঘন স্তূপে’। আলপথে দাঁড়ালে মনে হবে, ‘বাতাসে ধানের শব্দ শুনিয়াছি’। হাওরপারের এ সময়ের জীবন চলছে ফসলের প্রেমে, ফসলের টানে।
কাউয়াদীঘি হাওরটি মৌলভীবাজার সদর আর রাজনগর উপজেলাজুড়ে ছড়ানো। হাওরের বুকে এত দিনের ধানের সবুজ হঠাৎই যেন সোনালি হয়ে গেছে। হাওর হয়ে উঠেছে শস্যের মায়াবী জগৎ। এখন সেই ফসল গোলায় তোলার আয়োজন। তাই নিয়েই একমাত্র ব্যস্ততা। কাস্তে দিয়ে ধান কাটার সুরে ভরে আছে চারপাশ। কাউয়াদীঘি হাওরপারের গ্রামগুলোতে ধান আর কাস্তের শব্দ আর সব আওয়াজকে ছাপিয়ে গেছে। মাথার ওপর সূর্য পুড়িয়ে দিচ্ছে সব। পুড়ুক। ফোঁটায় ফোঁটায় ঘাম জমছে, ঝরে পড়ছে শরীর বেয়ে। ঝরুক। এসবে কারও তোয়াক্কা নেই। এখন শুধু খেত থেকে ঘরে ধান নিয়ে যাওয়ার পালা।
২৪ এপ্রিল বিকেলে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার আখাইলকুরা ইউনিয়নের জগৎপুর দিয়ে কাউয়াদীঘি হাওরের পথে পাওয়া গেল উৎসবের আবাহন। মাঠে মাঠে দল বেঁধে বেঁধে ধান কাটা চলছে। কেউ কাঁধে, কেউ ট্রলিতে, কেউ ঠেলাগাড়িতে করে কাটা ধানের আঁটি নিয়ে যাচ্ছেন বাড়িতে। পথে পথে ছড়িয়ে আছে সোনালি খড়। স্থানে স্থানে টিলার মতো উঁচু হয়ে আছে খড়ের স্তূপ। সড়কের পাশে, মাঠের ভেতর ধানের খোলা। খোলায় ধানের আঁটি ডাঁই করে রাখা। রোদে শুকাতে মেলে দেওয়া হয়েছে ধান।
কাজেরও কোনো শেষ নেই। বেলা পড়ে আসছে আর ধানগুলো জমা করছেন কিষানিরা। পুরোনো দৃশ্যপট বদলে যাচ্ছে। কোথাও কোথাও যন্ত্র নিয়েছে ধানমাড়াইয়ের দায়িত্ব। কোথাও ধান ঝাড়ছেন কেউ। কোথাও গবাদিপশুর খাদ্য জমিয়ে রাখতে তৈরি করা হচ্ছে শুকনো খড়ের গাঁদা। কোথাও চলছে ধান সেদ্ধ। অন্তেহরি বাজারের বিভিন্ন দোকানে কাস্তে, ধান কাটা ও তোলার বিচিত্র মৌসুমি সরঞ্জাম আর বস্তা সাজিয়ে রাখা।
সূর্যের কি আর অবসর আছে? সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। মাঠে ছোট-বড় ধানের খোলায় পাকা ধানের সঙ্গে এসে মিশে যাচ্ছে সূর্যের শেষ প্রহরের সোনালি আভা। সময় তাড়া করছে সবাইকে। একটু পরেই আলো মিশে যাবে। অন্ধকারে ডুবে যাবে হাওর।
কাজ শেষে হাওর থেকে গরু-বাছুর নিয়ে শুরু হলো বাড়ি ফেরা। মাখন নামে প্রান্তিক বর্ণের এক কৃষক সপরিবার স্তূপ করছেন খোলায় মেলে দেওয়া ধান। চাটাই গুটিয়ে নিচ্ছেন তিনি। সকাল থেকেই ধানের মায়ায় তাদের পড়ে থাকা। ফসল কাটা, কাটা ফসল খোলায় নিয়ে আসা, ঝাড়াই-বাছাই করা—নানা কাজের শেষে তবেই না খেতের ধান ঘরের লক্ষ্মী হয়ে ওঠে। এই একসময়, যখন নারী-পুরুষ আর আলাদা হয়ে থাকতেই পারে না। কিষানি সুনুকা ঘরে ফসল তুলতে সেই ভোরে মাঠের খোলায় এসেছেন। সারা দিন চলেছে তাঁর ধানঝাড়াই, রোদে মেলে দেওয়ার পালা। ধান শুকাতে পায়ে পায়ে উল্টেপাল্টে দিয়েছেন সারাটা দিন। দিন শেষে টিলার মতো উঁচু হয়ে উঠেছে ধান।
হাওরপারের গ্রামগুলোতে ধানের খেত আনন্দভরা শ্রমে নারী–পুরুষ আর ধর্ম–বর্ণের ভেদ মুছে দিয়েছে। এ আনন্দের মধ্যেও গোপন এক দুঃখ বয়ে চলেছেন বহু কৃষক। ব্রি ধান-২৮ আর ব্রি ধান-২৯ জাতে চিটার পরিমাণ নিঃস্ব করেছে অনেককেই।
‘কখন সোনার রোদ নিভে গেছে’। কোলাহলও স্তব্ধ হয়ে গেছে। দূর আকাশে জ্বলে উঠছে তারা। হাওরপারের ক্লান্ত দিন শেষে রাতভর চলবে সেই ক্লান্তির বিশ্রাম। ভোরে ধানের আহ্বানে আবার যেতে হবে মাঠে।-খবর : প্রথম আলো