আকমল হোসেন:: কাউয়াদীঘি হাওরের প্রান্তসীমায় ছায়ারেখা। সবুজ ধানখেতে পড়ে বিকেলের রোদ। গোধূলি নামকরণ সার্থক করে রাখালেরা গরুর পান্থশালার দিকে নিয়ে যাচ্ছেন গবাদিপশুর পাল।
গরু–মোষগুলো এই হাওরের স্থায়ী বাসিন্দা নয়। হয় রোজ সকালে চার-পাঁচ কিলোমিটার দূরের গ্রাম থেকে গরুগুলোকে আনা হয় অথবা গরুগুলোর জন্য হাওরেই বানানো হয় অস্থায়ী ডেরা। শুকনা মৌসুমে হাওরে অস্থায়ীভাবে গরু-মোষ লালন-পালনের পুরোনো-প্রচলিত একটি পদ্ধতি হচ্ছে এই বাথানব্যবস্থা।
মৌলভীবাজার সদর ও রাজনগর উপজেলা নিয়ে কাউয়াদীঘি হাওর। শুকনা মৌসুমে বিকেলে হাওরের দিকে গেলে গরুর ছোট ছোট পালের দেখা মেলে এখানে–ওখানে। একেক পালে ৫টি থেকে ১০টি গরু-মহিষ। বিলের পাড়ে, চরের মধ্যে বিভিন্ন জাতের ঘাস বেড়ে ওঠে। গরু-মোষ সেই ঘাস খেয়ে দিন পার করে।
বেলা হেলে পড়লে রাখালেরা গরু–মোষের দল নিয়ে গ্রামের দিকে রওনা দেন। হাওরের পথে পথে ধুলা উড়িয়ে বাড়ি ফিরতে অনেকেরই সন্ধ্যা হয়ে যায়। গ্রাম থেকে এই চরগুলোর দূরত্ব চার-পাঁচ কিলোমিটার, হয়তো আরও বেশি। এই সময়টিতে কিছু লোক মাস ভিত্তিতে গৃহস্থদের গরু-মহিষ হাওরে চরিয়ে থাকেন। বিনিময়ে বাড়তি কিছু টাকার দেখা পান তাঁরা।
এই বাড়তি রোজগারের আরও একটি বিকল্প হচ্ছে বাথানব্যবস্থা। রাখালেরা প্রতিদিন গ্রামে ফেরেন না। গরু–মোষ হাওরের চরে ঘাস খায়, ঘুরে বেড়ায়, সন্ধ্যার আগে আগে দলবেঁধে চেনা ডেরার কাছে ফিরে আসে। এ রকম কোনো এক সন্ধ্যার আগে কাউয়াদীঘি হাওরের জিবনিয়া কান্দিতে অনেকগুলো মোষকে জড়ো করতে দেখা গেল দু-তিনজন লোককে।
সেখানে বাঁশের খুঁটিতে রশিতে বেঁধে রাখা হচ্ছে মোষগুলোকে। জিবনিয়া কান্দি থেকে কিছুটা দূরে মেলাগড়ে পাশাপাশি মিলল দু–তিনটি গরুর বাথান। তখন সন্ধ্যা আরও ঘনিয়ে এসেছে। বাথানমালিকেরা গরুগুলোকে রাতের থাকার স্থানে নিয়ে আসতে ব্যস্ত। এই নিয়ে রাখালদের ছোটাছুটি। ছোট-বড় গরুগুলোও দলে দলে চলে আসে থাকার স্থানে। গরু-মহিষের বাচ্চাগুলোকে রাখা হয় ত্রিপলে ঢেকে। বড়গুলো খুঁটিতে বেঁধে।
কফিল উদ্দিন, সেজুল মিয়াসহ সংসার, গ্রাম থেকে দূরে থাকা কয়েকজনের সঙ্গে ওখানেই দেখা। তাঁরা এসব বাথান চালান। একেকটি বাথানে ১০০ থেকে ৩০০ বা তারও অধিক গরু-মহিষ থাকে। একটি বাথানে অনেক মালিকের গরু-মহিষ। একেকজন মালিকের ৪-৫টি থেকে ১০-১৫টি পর্যন্ত গরু-মহিষ। শুকনা মৌসুমে উজানে পর্যাপ্ত ঘাস থাকে না। গরু-মোষ পালন কঠিন হয়ে যায়।
তখন বিভিন্ন গ্রামের গৃহস্থরা তাঁদের গরু-মোষ বাথানে পাঠিয়ে দেন। পৌষ থেকে চৈত্র-বৈশাখ পর্যন্ত বাথান চলে। ছোট–বড় অনুযায়ী একটি গরু-মহিষের জন্য মাসে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা দিতে হয় গৃহস্থকে। তবে গাভির মালিককে নগদ টাকা দিতে হয় না। বাথানমালিক দুধ বিক্রি করে যা পান, তাই তাঁদের। এই বাথানমালিকদের নিজেদেরও গরু-মোষ থাকে। নিজের গরু-মোষের সঙ্গে অন্য মালিকের গরু-মোষ লালন-পালন করেন।
এক মৌসুমে মাথাপিছু ১০-২০ হাজার করে বাড়তি টাকা রোজগার হয়। অনেকে ১৫-২০ বছর ধরে এ রকম বাথান চালান। শুকনা মৌসুমে হাওরজুড়ে ১৫-২০টি বাথান থাকে। আগে কৃষিতে যন্ত্রের উপস্থিতি ছিল না। চাষের কাজে গরু-মহিষই ছিল অবলম্বন। গরু-মোষের সংখ্যা ছিল বেশি। বাথানের সংখ্যাও ছিল অনেক। এখন অনেক কমে গেছে। কিন্তু বাথান-সংস্কৃতি বিলুপ্ত হয়ে যায়নি।
কৃষি-জগতে এ এক অন্য ধরনের স্বল্পকালীন জীবনব্যবস্থা। আশপাশে কোনো ঘরবাড়ি নেই। কয়েক কিলোমিটার দূরে দূরে গ্রাম। অস্থায়ী তাঁবুর মতো ডেরায় কিছু মানুষ তখন রান্নাবান্না, খাওয়াদাওয়া সেরে আরও একটা ভোরের খোঁজে ঘুম-কাতর হয়ে পড়েন। ঝড়বৃষ্টি শুরুর আগপর্যন্ত পরিবার থেকে দূরের একলা এই তাঁবুবাস তাঁদের চলতে থাকে। একদিন বৈশাখের আকাশ ছাপিয়ে বৃষ্টি নামলে হাওরের বুকে থইথই পানির ভাসান আসে। তাঁরাও তাঁবু গুটিয়ে গরু-মোষ নিয়ে পা বাড়ান বাড়ির পথে। খবর : প্রথম আলো