লাতু ডেস্ক:: রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের ‘ঘোড়া’ কবিতার কয়েকটি লাইন এ রকম, ‘মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে;/ প্রস্তরযুগের সব ঘোড়া যেন—এখনো ঘাসের লোভে চরে…।’ না, এ ঘোড়াগুলো মহীনের নয়, কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরেও তারা ঘাসের লোভে আসেনি। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নানা রং ও আকারের প্রায় অর্ধশত ঘোড়া সমবেত হয়েছিল একটি স্থানে। এগুলো এসেছিল জয়-পরাজয়ের খেলায়। পৌষের কুয়াশামাখা শীতের দুপুর থেকে বিকেলকে দৌড়ে দৌড়ে রঙিন করেছে, উষ্ণ করেছে এই ঘোড়া ও ঘোড়সওয়ারের দল।
বছরের শেষ দিন আজ শনিবার মৌলভীবাজার জেলা স্টেডিয়ামে ঐতিহ্যবাহী ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল জেলা পরিষদ। এটি তাদের প্রতিবছরের নিয়মিত আয়োজনেরই একটি অংশ। এ আয়োজনে সার্বিক সহযোগিতা করেছে জেলা ক্রীড়া সংস্থা।
আজ বেলা সাড়ে ১১টার দিকে জেলা স্টেডিয়ামে গিয়ে দেখা যায়, শিশু-কিশোর, নারী-পুরুষসহ হাজারো মানুষে ভরা স্টেডিয়ামের গ্যালারি। মাঠের ভেতর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে লাল, কালো, সাদাসহ ছোট-বড় অনেক ঘোড়া। সেগুলো ঘিরে আছেন ঘোড়ার মালিক, সহযোগী ও শিশু-কিশোর ঘোড়সওয়ারেরা। ঘোড়াগুলোকে নানাভাবে যত্ন করা হচ্ছে। কেউ ঘোড়ার পিঠ-ঘাড় ঘষে দিচ্ছেন। কেউ পা টেনে দিচ্ছেন। ঘোড়াগুলো এসেছে সিলেট, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও মৌলভীবাজারের বিভিন্ন স্থান থেকে। প্রতিটি ঘোড়ার সঙ্গে একজন করে শিশু-কিশোর ঘোড়সওয়ার আছে।
ঘোড়সওয়ার তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী বাহুবলের জাহাঙ্গীর আলম বলে, ‘দুই বছর ধরে ঘোড়া দৌড়াই। ঘোড়া দৌড়াইতে আরাম লাগে। এখন আমি ঘোড়া থেকে পড়ি না।’ আরেক ঘোড়সওয়ার চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র আলমগীর আহমদ বলেছে, সে চার বছর ধরে ঘোড়া দৌড়ায়।
ঘোড়ার মালিক বাহুবলের আবদুর নূর বলেন, ‘আমি ১০ বছর ধরে বিভিন্ন স্থানে হওয়া প্রতিযোগিতায় ঘোড়া নিয়ে যাই। খেলায় হারা-জিতা আছে। খালি জিতার লাগি দৌড় প্রতিযোগিতায় আসি না।’ তিনি দুটি ঘোড়া নিয়ে এসেছেন প্রতিযোগিতায়। শুধু মৌলভীবাজারই নয়, চুনারুঘাট, কিশোরগঞ্জ, ভৈরব, নবীগঞ্জ, কমলগঞ্জসহ যেখানেই দৌড়ের ডাক পান, ঘোড়া নিয়ে সেখানে যান।
ঘোড়াগুলোর নামেও চমক আছে। প্রতিটি ঘোড়াই আলাদা নামে পরিচিত। ‘কংসরাজ’, ‘দুই ভাইয়ের মায়া’, ‘টেকর পাখি’, ‘দাদা-নাতি’, ‘হংসরাজ’, ‘টিপু সুলতান’, ‘মায়ের রাজা’, ‘মুকুট রাজা’, ‘বাংলা ভাই’, ‘টু হৃদয়’, ‘ডালিম বাংলা’, ‘ট্রিগার’, ‘রণজিৎ’, ‘দুই বন্ধুর মায়া’, ‘রাজন বাংলা’, ‘লালু পাগলা’, ‘লাল বারুদ’, ‘আর্মি টাইগার’, ‘মামুন রাজা’, ‘রণজিৎ বাচ্চা’, ‘পাঁচ ভাইয়ের মায়া’, ‘বাঘ বাচ্চা’, ‘গরিবের বন্ধু’, ‘দিল দেওয়ানা’, ‘আরিয়ান বাহাদুর’, ‘আমার স্বপ্ন’, ‘টপ সিঙ্গার’, ‘মামা-ভাগিনা’, ‘শুভরাজ’, ‘মাহীরাজ’, ‘হৃদয় বাংলা’, ‘নিউ সোনার তরি’, ‘সোনার ময়না’, ‘মায়ের আদেশ’—এ রকম নানা কিসিমের ৪৪টি ঘোড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে।
সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার মো. দিলওয়ার হোসেন দুটি ঘোড়া নিয়ে এসেছেন দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে। তাঁর একটি ঘোড়া বিভিন্ন স্থানের প্রতিযোগিতায় জিতে যায় বলে নামও রেখেছেন ‘রণজিৎ বাচ্চা’। তাঁর কথায়, দৌড়ে জয় পাওয়া তো রণেই জয় পাওয়া। তাঁর পাঁচটি ঘোড়া আছে। তিনি বলেন, ‘বাবা-দাদারা ঘোড়া দৌড়াইছন; আমরাও এটা ধরি রাখছি।’
প্রতিযোগিতায় বড় ও ছোট—এ দুই ভাগে ঘোড়দৌড় হয়েছে। চূড়ান্ত পর্বে ছোট দলে প্রথম হয়েছে ‘শুভরাজ’, দ্বিতীয় ‘আমার স্বপ্ন’ এবং তৃতীয় হয়েছে ‘আর্মি টাইগার’। বড় দলে প্রথম হয়েছে ‘জয় বাংলা, দ্বিতীয় ‘সোনার ময়না’ এবং তৃতীয় হয়েছে ‘নিউ সোনার তরি’। বিশেষ পুরস্কার পেয়েছে ‘রণজিৎ বাচ্চা’।
আজ বিকেলে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন মৌলভীবাজার জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মিছবাহুর রহমান। প্রধান অতিথি ছিলেন মৌলভীবাজার-৩ আসনের সংসদ সদস্য নেছার আহমদ। অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান, পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাকারিয়া, পৌর মেয়র মো. ফজলুর রহমান, মৌলভীবাজার সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. কামাল হোসেন ও জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খোদেজা খাতুন।
জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মিছবাহুর রহমান বলেন, ‘এই ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতার একটা উদ্দেশ্য আছে। নতুন প্রজন্ম ঘোড়দৌড় কী, তা জানে না। আমরা ছোটবেলায় ঘোড়দৌড় দেখেছি। এটি গ্রামবাংলার একটি প্রাচীন ঐতিহ্য। এটা অনেকটাই হারিয়ে গেছে। আমরা তরুণ ও শিশুদের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া এ খেলাকে পরিচিত করাতে চাইছি। এ ছাড়া বিজয়ের মাসের শেষ দিনটাও যেন আনন্দ-উল্লাস করে কাটে, সে ব্যবস্থা করেছি।’