কামরুল হাসান, হবিগঞ্জ :: হবিগঞ্জ জেলাকে বরাবরই দ্বিতীয় গোপালগঞ্জ হিসেবে আখ্যাত করা হয়ে থাকে। এক কথায় আওয়ামী লীগে ঘাটি হিসেবে পরিচিত। সংসদীয় আসনের চারটি সিটই দীর্ঘদিন যাবত রয়েছে আওয়ামী লীগের দখলে রয়েছে। কিন্তু চলতি পৌরসভা নির্বাচনে গণেশ উল্টে নগরপিতার চেয়ারটি চলে গেছে বিএনপির ঘরে। ফলে আওয়ামী লীগের ঘরে পরাজয়ের স্বাদ নিতে হলো আওয়ামী লীগকে। খবর: পূর্বপশ্চিম।
জেলার তিন পৌরসভার মধ্যে দুটিতে নৌকা ডুবেছে বিদ্রোহী প্রার্থীদের টানাহেঁচড়ায়। একটিতে অল্প ব্যবধানে পরাজয় বরণ করতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে। তন্মধ্যে মাধবপুর, নবীগঞ্জ ও শায়েস্তাগঞ্জ পৌরসভায় আওয়ামী লীগের এই পরাজয়ের ঘটনা ঘটেছে।
আওয়ামী লীগের খাটিতে পরাজয়ের কারণ নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। ভেতরে ভেতরে আত্মসমালোচনাও। আবার আলোচনায় উঠেছে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব।
তিনটি পৌরসভায় আওয়ামী লীগের ভরাডুবির পর জেলাবাসীর চোখ এখন চুনারুঘাট পৌরসভায়। আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি এ পৌরসভায় ভোট অনুষ্ঠিত হবে। এখানেও কি আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ভরাডুবি হবে? এমন নানা প্রশ্ন চায়ের দোকান, আড্ডা থেকে শুরু করে সব জায়গায়।
গত শনিবার (১৬ জানুয়ারি) দ্বিতীয় ধাপে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলীর নির্বাচনী এলাকার মাধবপুর পৌরসভায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে হারিয়ে নির্বাচিত হন বিএনপির প্রার্থী হাবিবুর রহমান মানিক। এখানে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী শ্রীধাম দাশগুপ্তের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। নির্বাচনে তিনি মাত্র ভোট ৬০৮ পান। এ পৌরসভায় বিজয়ী হয়েছেন বিএনপি দলীয় প্রার্থী হাবিবুর রহমান মানিক। তিনি পেয়েছেন ৫০৩১ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্ধী আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী পঙ্কজ কুমার সাহা পেয়েছেন ৪১৮৫ ভোট।
সহকারী রিটার্নিং অফিসার মুহাম্মদ মনিরুজ্জামান জানান, মোট কাস্টিং ভোটের ৮ ভাগের এক অংশের নিচে পেলে যে কোনো প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। সেই হিসেবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শ্রীধাম দাশগুপ্তের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনৈক আওয়ামী লীগ নেতা জানান, জনসম্পৃক্ততা না থাকলে যা হয়। এমন প্রার্থী নৌকা পেয়েছিলেন। তার সাথে একদিন যিনি প্রচারণায় গেছে পরের দিন আর যায়নি। পরাজয়ের প্রধান কারণ হচ্ছে জনগণের কাছে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর মনোনয়ন যথাযথ হয়নি। জনগণের সঙ্গে প্রার্থীর তেমন সম্পৃক্ততা ছিল না।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতিকুর রহমান বলেন, ঐক্যবদ্ধ থাকলেই আমাদের ঘাঁটি। কিন্তু সবাই যার যার তালে থাকলে পরাজয় তো হবেই। আমার উপজেলা সভাপতি দাঁড়াইছেন স্বতন্ত্র। নৌকার মেয়র আগে যেটা পাশ করাইছলাম হিরেন্দ্র লাল সাহা তার আপন ভাই স্বতন্ত্র। এ কারণে আমি ছাড়া অধিকাংশ নেতাকর্মী যার যার তালে বিভক্ত।
এদিকে নবীগঞ্জ পৌরসভায় টানা দ্বিতীয়বারের মতো বিজয়ী হয়েছেন বিএনপি মনোনীত প্রার্থী ছাবির আহমদ চৌধুরী। ২৬৪ ভোটের ব্যবধানে নৌকার প্রার্থী গোলাম রসুল রাহেল চৌধুরীকে পরাজিত করে তিনি বিজয়ী হন। তবে সূক্ষ্ম কারচুপির অভিযোগে আওয়ামী লীগ এই ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল জাহান চৌধুরী জানান, এ বিষয়ে আইনি লড়াই হবে।
নৌকার প্রার্থী গোলাম রসুল রাহেল চৌধুরী অভিযোগ করে বলেন, নহরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভোট গ্রহণ শেষে ভোটকেন্দ্রের ফলাফল অনুযায়ী আমি ৯৯২ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হই। কিন্তু সরকারি হিসেবে আমাকে ৬৬৯ ভোট দেখানো হয়েছে। আমাকে ইচ্ছা করে ফলাফল টেম্পারিং করে পরাজিত করা হয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন দুটি কেন্দ্রের ফলাফলে পাল্টানো হয়েছে। এসব কেন্দ্রে এজেন্টের কোনো স্বাক্ষর না নিয়ে ফলাফল ঘোষণা করা হয়। নহরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভোট কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা এসব ফলাফল পরিবর্তন করেছেন।
স্থানীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে, নবীগঞ্জে প্রার্থীকে ছাপিয়ে কেন্দ্রীয় যুবলীগের এক নেতা এখানে ছিলেন আলোচনায়। তার কিছু বক্তব্যে মানুষের মাঝে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এতে ভোটের মাঠে নেগেটিভ প্রভাব পড়ে। এছাড়া নেতাদের প্রচারণায় গিয়ে ফটোসেশন, দলীয় কোন্দলও ছিল বড়। এখানে স্থানীয় নেতাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে নিজ দলের প্রার্থী পক্ষে তেমন জোরালো কোনো প্রচারণা চালাননি স্থানীয় নেতারা।
উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি গিয়াস উদ্দিন বলেন, আমাদের নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ কাজ করেছেন। আমাদের প্রার্থী বিজয়ী ছিলেন। পরিকল্পিতভাবে নহরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে আমাদের প্রার্থীর ফলাফল পাল্টে দেওয়া হয়েছে। সেন্টারটি আমার নিজেরই। কিন্তু এখানে আমি অক্ষম। দুই তিনবার আমাকে ওয়ার্নিং দেওয়া হয়েছে না যাইতে। বিজিবি এবং পুলিশ। সকালে কেন্দ্র থেকে প্রিজাইডিং কর্মকর্তা আমাদের একজন এজেন্ট বের করে দেন। ফলাফল ঘোষণার পর এজেন্টরা রেজাল্টশিট চাইলে কর্মকর্তা দেননি। বলেন উপজেলায় যান। সেখান থেকে নিবেন। কিন্তু সেন্টারে ঘোষণা দেন নৌকা পাশ।
এর আগে গত ২৮ ডিসেম্বর শায়েস্তাগঞ্জে পৌরসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে উপজেলা আওয়ামী লীগ পাঁচ ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। কেন্দ্র মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেন বিদ্রোহী প্রার্থীরা। বিদ্রোহী প্রার্থীদের নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়। তাদের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে বলা হলেও কেউ কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত মানেননি। যার কারণে এখানে পরাজয় হয়েছে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর। নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী ফরিদ আহমেদ অলি ৪০৪১ ভোট পেয়ে বেসরকারিভাবে জয়ী হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্ধী আওয়ামী লীগ প্রার্থী মাসুদউজ্জামান মাসুক পেয়েছেন ৩১৪১ ভোট।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুর রশীদ তালুকদার ইকবাল বলেন, আমাদের এখানে বিদ্রোহীর কারণেই মূলত পরাজয়। এখানে বর্তমান মেয়র হয়েছেন বিদ্রোহী তিনি পেয়েছেন ২৫৯৯ ভোট, যুবলীগের বিদ্রোহী একজন ১৫০০ ও আরেকজন বিদ্রোহী পেয়েছেন ১৪০০ ভোট। বিদ্রোহীর কারণেই এ অবস্থা। তিন বিদ্রোহী ও নৌকার প্রার্থীর ভোট যোগ করলে অনেক বেশি।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আলমগীর চৌধুরী বলেন, নবীগঞ্জে নৌকা তো পাশই করছিল। কিন্তু দুই আড়াইশ ভোটের একটা কারসাজি হইছে। সূক্ষ কারচুপি হয়েছে কি না, চিন্তা করতেছি। আর মাধবপুরে প্রার্থীর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। এছাড়া বিদ্রোহী ছিল দুইজন এবং শায়েস্তাগঞ্জে দলের তিন জন বিদ্রোহী ছিল। বিদ্রোহী প্রার্থীদের কারণেই এই পরাজয়। হবিগঞ্জ আওয়ামী লীগের ঘাঁটি। এইবারের পরাজয়টা দুঃখজনক।