শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী:: নাম হলো পরিচয় ও নিদর্শন। নামের আরবি হলো ‘ইসম’। ইসম অর্থ চিহ্ন, আলামত, পরিচিতি, লক্ষণ; উন্নয়ন, বর্ধন, সম্মান, সুনাম, যশ, খ্যাতি ইত্যাদি। মানুষ দুনিয়ায় আসার পর প্রথম যা লাভ করে তা হলো তার নাম-পরিচয়। মৃত্যুর পরেও মানুষের নাম বেঁচে থাকে। তাই শিশুর সুন্দর নাম তার জন্মগত অধিকার।
শিশুর নাম রাখার অধিকারী হলেন প্রথমত পিতা-মাতা, দাদা-দাদি, নানা-নানি, ভাই-বোন, ফুফু-খালা, চাচা-মামা এবং আত্মীয়স্বজন। নাম যেন অর্থবহ হয় তা খেয়াল রাখতে হবে। এ জন্য কোনো বিজ্ঞজন বা আলেমের সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে। কখনো কখনো কোনো মুরব্বি বা বুজুর্গ ব্যক্তির মাধ্যমেও নামকরণ করা হয়ে থাকে। যে কেউ নাম নির্বাচন ও নামের প্রস্তাব বা পরামর্শ দিতে পারেন। অভিজ্ঞ আলেম বা বিজ্ঞ ব্যক্তি প্রস্তাবিত নামের অর্থ, গুণাগুণ ও তাৎপর্য অনুসারে এর প্রাধান্য ব্যাখ্যা করবেন। সন্তানের অভিভাবকেরা নাম গ্রহণে সিদ্ধান্ত নেবেন। এটাই শিশুর নামকরণের সর্বোত্তম পদ্ধতি।
নামের সঙ্গে ‘মুহাম্মদ’ প্রায় অনেকেরই দেখা যায়। এটি নামের অলংকার। আমাদের প্রিয় নবী (সা.)–এর প্রথম, প্রধান ও মূল নাম মুহাম্মদ। তাই নবীজির প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও আনুগত্যের নিদর্শনস্বরূপ অনেকের নামের শুরুতে মুহাম্মদ লেখা হয়ে থাকে। মুহাম্মদ মূলত স্বতন্ত্র একটি নাম। মুহাম্মদ জগতের শ্রেষ্ঠ নাম। তাই সাহাবায়ে কিরাম ও তত্পরবর্তী তাবেইন ও তাবে-তাবেইনদের যুগে দেখা গেছে পরদাদা, দাদা, বাবা ও ছেলের একই নাম ‘মুহাম্মদ’। (নবীজি ছাড়া অন্য কারও মুহাম্মদ নাম শুনলে দরুদ শরিফ পড়া প্রযোজ্য নয়)।
কারও নাম মুহাম্মদ হলে বা নামের সঙ্গে মুহাম্মদ থাকলে তা সংক্ষেপে মো., মু., মোহাং, মোহা. লেখা উচিত নয়; বরং পূর্ণরূপেই লেখা কর্তব্য। মুহাম্মদ শব্দটি বাংলায় ‘মোহাম্মদ’ বা ‘মহম্মদ’ ইত্যাদি বিভিন্ন বানানে দেখা যায়, এগুলো প্রচলিত হলেও আরবি উচ্চারণ হলো ‘মুহাম্মাদ’। ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষায়ও মুহাম্মদ শব্দটি পূর্ণরূপে লেখা জরুরি; তা না হলে ভিসা, পাসপোর্টসহ অফিশিয়াল কাগজপত্রে নানান জটিলতা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা থাকে।
নাম অর্থবহ ও সুন্দর হওয়া বাঞ্ছনীয়। আমাদের এই অঞ্চলের নামগুলো কিছু আরবি, কিছু ফারসি, কিছু উর্দু, কিছু বাংলা এবং কিছু কিছু নামে একাধিক ভাষার শব্দের সংমিশ্রণও রয়েছে। নামের আগে বা পরে বংশপরিচয় থাকাটাও স্বাভাবিক। যেমন শুরুতে সৈয়দ, শেখ ইত্যাদি এবং শেষে চৌধুরী, ভূঁইয়া, মিয়া ইত্যাদি। এগুলো শুধুই পরিচয়ের জন্য, জ্ঞান-গরিমা বা মহত্ত্ব প্রকাশের জন্য নয়।
আরবরা বংশপরিচয়ের জন্য ছেলে বা মেয়ের নামের সঙ্গে বাবার নাম বা বংশের নাম ব্যবহার করে থাকে, এটিই শ্রেয়তর। অনেক নারীকে দেখা যায় বিয়ের পরে নামের সঙ্গে নিজ বংশের নামের পরিবর্তে স্বামীর বংশের নাম অথবা পিতার নামের পরিবর্তে স্বামীর নাম যুক্ত করেন; এটি অপ্রয়োজনীয় এবং অযৌক্তিক। নবী–পত্নীগণ ও সাহাবায়ে কিরামের বিবিগণ এমনটি করেননি।
নাম এক শব্দে হওয়া ভালো। একাধিক শব্দে নাম রাখাতেও কোনা বাধা নেই। আসল নাম ও ডাক নাম একই হতে পারে, ভিন্নও হতে পারে। যেমন নবীজি (স.)-এর মেজ পুত্র আবদুল্লাহ (রা.)-এর আরও দুটি নাম ছিল তাহের ও তায়্যেব। সন্তানের নাম পিতা বা মাতার নামের সঙ্গে মিলিয়ে রাখা জরুরি নয়। একইভাবে জরুরি নয় ছেলের নামের সঙ্গে বাবার নাম এবং মেয়ের নামের সঙ্গে মায়ের নাম অথবা তার বিপরীত উল্লেখ করা। তবে নাম যেন অর্থপূর্ণ, শ্রুতিমধুর ও সহজ হয় সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। নামের সঙ্গে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে স্বতন্ত্রভাবে পিতার নাম, মাতা ও স্বামী বা স্ত্রীর এমনকি সন্তানের নামও উল্লেখ করা যেতে পারে।
কারও নাম ভালো অর্থবহ না হলে তা পরিবর্তন করে রাখা যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বিভিন্ন সাহাবির এরূপ নাম পরিবর্তন করে রেখেছিলেন। সাধারণত জন্মের সপ্তম দিনে আকিকা করে নাম রাখা হয় বা নাম রাখার পর সুবিধামতো সময়ে আকিকা করে সন্তানের নাম উল্লেখ করে দোয়া করা হয়। তাই মানুষ এই নামকে আকিকা দেওয়া নাম বলে। বিশেষ কারণে কারও নাম পরিবর্তন করা হলে এর জন্য নতুন করে আকিকা করতে হবে না। তবে পূর্বে আকিকা না করে থাকলে অবশ্যই সুবিধামতো সময়ে তা আদায় করা সুন্নত। শিশুর সুন্দর ও ভালো অর্থবহ নাম রাখা একটি সুন্নত। আকিকা করা আরেকটি স্বতন্ত্র সুন্নত। নাম জন্মের পর যেকোনো সময় রাখা যায়। সাত দিনের মধ্যে নামকরণ করা ভালো, বিলম্ব হলেও ক্ষতি নেই। জন্মের পূর্বেও নাম নির্ধারণে বাধা নেই।
নবী (সা.) বলেছেন, ‘জন্মের সপ্তম দিবসে নবজাতকের নাম রাখো।’ (তিরমিজি: ২৮৩২)। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘সপ্তম দিনে রাসুলুল্লাহ (সা.) হাসান (রা.) ও হোসাইন (রা.)-এর আকিকা দিয়েছেন এবং তাঁদের নাম রেখেছেন।’ (বায়হাকি: ১৯০৫৫)।
শিশুর নামকরণের পর তার জন্মনিবন্ধন করা উচিত। এতে তার নাগরিক অধিকার ও জাতীয় স্বীকৃতি নিশ্চিত হয়। এর মাধ্যমে শিশুর চিকিত্সাসেবা, শিক্ষালাভ এবং আন্তর্জাতিক পরিষেবাসমূহ প্রাপ্তির পথ সুগম হয়। ভবিষ্যতে সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আইনগত ক্ষেত্রে সুবিধাসমূহ গ্রহণ করা সহজ হয় এবং জটিলতামুক্ত হওয়া যায়।
নাম সঠিক থাকার জন্য প্রথম স্কুল বা বিদ্যালয়ে ভর্তির সময় শিশুর নাম ও পিতা-মাতার নাম সঠিকভাবে লেখা উচিত। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের দায়িত্ব বেশি। জন্মনিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস বা কর্মক্ষেত্র, টিকিট, হোটেল-মোটেলসহ সর্বত্র সঠিক নাম পূর্ণরূপে লেখা কর্তব্য। তা না হলে নানান সমস্যা ও জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।
নামেই শুরু, নামেই শেষ। পবিত্র কোরআন শুরু হয়েছে নাম দ্বারা। (সুরা ফাতিহা, আয়াত: ১-৪)। প্রথমে আল্লাহ তাআলা আদম (আ.)–কে নাম শেখালেন। (সুরা বাকারা, আয়াত: ৩১-৩৩)। নাম দিয়েই পবিত্র কোরআন সমাপ্ত করা হয়েছে। (সুরা: নাস, আয়াত: ১-৬)। রোজ হাশরে কিয়ামতের ময়দানে নাম ধরেই মানুষকে ডাকা হবে আল্লাহর দরবারে। (হাদিস)।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।