মুনজের আহমদ চৌধুরী :: স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ব্রিটেনের অভ্যুদয় ১৭০৭ সালের পহেলা মে। আর দেশটি ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেয় ১৯৭৩ সালের পহেলা জানুয়ারি। ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেওয়ার আগে ২৬৬ বছর ব্রিটেন স্বাধীন ও এককভাবে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচালিত হয়েছে। দেশটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার পর ৪৬ বছর পার হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অভিন্ন মুদ্রা ইউরো বা অভিন্ন ভিসা সেনজেনেও ব্রিটেন কখনও যোগ দেয়নি।
আজকের ব্রিটেনের এক-তৃতীয়াংশের বেশি নাগরিক মনে করে, ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এককভাবে পথ চলতে পারবে না।
যে বাস্তবতায় ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিয়েছিল ব্রিটেন, তার অনেকখানিই এখন আর প্রাসঙ্গিক নয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেশিরভাগ দেশ গত এক দশকে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত। দেশগুলোর লাখ লাখ কর্মহীন মানুষের চাপে ব্রিটেন নাগরিকদের চিকিৎসা, শিক্ষার মতো মৌলিক চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যান্য দেশ থেকে আসা নিত্যপণ্যের ওপর ব্রিটেন অনেকাংশে নির্ভরশীল। কিন্তু, ব্রিটেনে রফতানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় দেখানোর পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কৃষকরা রাস্তায় হাজার হাজার লিটার দুধ ফেলে, উৎপাদিত শাক-সবজি ফেলে প্রতিবাদ করেছেন।
দুই.
ব্রিটেনের ২০১৫ সাল থেকে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ইস্যু—ব্রেক্সিট। ব্রিটেন ইউরোপে থাকবে কিনা, এই ইস্যুতে জনরায় জানতে ২০১৬ সালের ২৩ জুন ব্রিটেনে রেফারেন্ডাম অনুষ্ঠিত হয়। সেই রেফারেন্ডামে ৫১ দশমিক ৯ শতাংশ জনগণ ব্রিটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হওয়ার পক্ষে রায় দেয়। ২০১৭ সালের নির্বাচনেও ব্রেক্সিটের পক্ষের দল কনজারভেটিভ পার্টি আবারও সরকার গঠনে সক্ষম হয়। ব্রেক্সিট রেফারেন্ডামে ব্রিটিশ জনগণ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগের পক্ষে রায় দিলেও ব্রিটেনের এমপিরা সে রায় বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়ান। ব্রেক্সিট নিয়ে বারবার দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েন খোদ সরকারি দলের সংসদ সদস্যরাই। লেবার পার্টি তো বটেই ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ দলেরও বহু এমপি-মন্ত্রী ব্রেক্সিট নিয়ে দলীয় সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে মন্ত্রিসভা তো বটেই, দলও ত্যাগ করেছেন। অনেকে নতুন দল গঠন করেছেন।
ব্রিটেনের সংসদীয় গণতন্ত্রের অবাধ স্বাধীনতার সৌন্দর্যের উল্টোপিঠের অস্থিরতায় আক্রান্ত এখন দেশটির রাজনীতি। এমন অস্থিরতার ফলে সরকার যেমন দুর্বল হতে থাকে, তেমনি আন্তর্জাতিক বাজারে দুর্বল হতে থাকে পাউন্ড, যার ধাক্কা লাগে ব্রিটেনের অর্থনীতিতেও।
তিন.
বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) ব্রিটেনের সাধারণ নির্বাচন। বরিস না করবিন—এই নির্বাচনে কে জিতবেন—সে প্রশ্নের উত্তর জানতে অপেক্ষা করতে হবে শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত। শুক্রবার বিকেলে জানা যাবে ৬৫০টি আসনের ভোটের ফল। ব্রিটেনের আইন অনুযায়ী—নির্বাচনে কোনও দলকে এককভাবে সরকার গঠন করতে হলে ৬৫০টি সংসদীয় আসনের মধ্যে জিততে হবে অন্তত ৩২৬টি আসনে।
ভোটের একদিন আগে এ লেখাটি যখন লিখছি, তখন পর্যন্ত প্রায় সব জরিপে এগিয়ে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি। জুয়ার চেইন শপগুলোয় জুয়াড়িরা কোটি কোটি বাজি ধরছেন কনজারভেটিভ পার্টির নেতা বরিস জনসন আর লেবার পার্টির নেতা জেরেমির নামে। পুঁজিবাদের বাজারে নির্বাচনি পণ্য-ব্যবসায় মিডিয়াওয়ালা, জুয়া ব্যবসায়ীদের পোয়াবারো। এসবই নাকি নির্বাচনি অর্থনীতি।
কিন্তু, সর্বশেষ ২০১৬ সালের রেফারেন্ডাম, ২০১৭ সালের ব্রিটেনের সাধারণ নির্বাচনে বেশিরভাগ জরিপের তথ্য পরবর্তী সময়ে ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
ব্রিটেনের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ব্রেক্সিট দ্রুত বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতিতে ভোট চেয়েছেন। ব্রিটেনে এবারও যদি ঝুলন্ত সরকার গঠিত হয়, অর্থাৎ কনজারভেটিভ পার্টি এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায়, তাহলে ব্রেক্সিট-প্রক্রিয়া বিলম্বিত হবে। আর বরিস জনসনের দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও তার প্রতিশ্রুত সময়ের মধ্যে ব্রেক্সিট কীভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব, তার সুস্পষ্ট কোনও রূপরেখা তার দল প্রকাশ করেনি। ব্রিটেনের রাজনীতিতে বরিসের সমালোচকরা তাকে ‘ব্রিটিশ ট্রাম্প’ হিসেবে অভিহিত করেন। রাজনৈতিক অবস্থান পরিবর্তন, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ও বেফাঁস মন্তব্যের জেরে তিনি জেরবার, সমালোচিত।
লেবার পার্টি নেতা জেরেমি করবিনের ব্রেক্সিট নিয়ে বক্তব্য পুরোটাই অস্পষ্ট আর স্ববিরোধীও। তিনি বলছেন, লেবার পার্টি বিজয়ী হলে পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে তারা ব্রেক্সিট নিয়ে দ্বিতীয় রেফারেন্ডামের আয়োজন করবেন। লেবার পার্টির বহু এমপি প্রার্থী তাদের নির্বাচনি প্রতিশ্রুতিতে ব্রিটেনের ইউরোপ না ছাড়ার পক্ষে থাকার ঘোষণা দিয়ে ভোট চাইছেন।
আর জেরেমি করবিন বলছেন, তার দল জিতলে আর দ্বিতীয় রেফারেন্ডাম হলে সেক্ষেত্রে তিনি নিরপেক্ষ থাকবেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, লেবার পার্টির ভেতরে ব্রেক্সিটবিরোধী ও ব্রেক্সিটপন্থী দুই পক্ষকে আপাতত সন্তুষ্ট রাখতে জেরেমির এ কৌশল তার জন্য ভোটের মাঠে বুমেরাং হতে পারে।
জো সুইনসনের দল লিবারেল ডেমোক্র্যাট (লিবডেম) আসন্ন নির্বাচনে তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। ব্রেক্সিট নিয়ে লিবডেমের নীতিই বরং বড় দুই দলের বিবেচনায় সবচেয়ে স্পষ্ট। জো সুইনসন সুস্পষ্টভাবে বলছেন, তারা সরকারে যেতে পারলে ব্রেক্সিট আটকাতে চান। যদিও তাদের এককভাবে সরকার গঠনের কোনও সম্ভাবনা নেই।
আর হেরে গেলে লিবডেমও দ্বিতীয় রেফারেন্ডামের জন্য ক্যাম্পেইন করবে। তবে, ঝুলন্ত সংসদ হলে কোয়ালিশনের কিং মেকার হিসেবে আবির্ভূত হতে পারেন লিবারেল ডেমোক্রেটরা।
স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি ওয়েলসের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল প্লাইড ক্যামরু ও গ্রিন পার্টির মতো ব্রিটেনের দ্বিতীয় সারির রাজনৈতিক দলগুলো দ্বিতীয় রেফারেন্ডামের পক্ষে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করছে।
চার.
ব্রেক্সিট ব্রিটেনের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে এখন সবচেয়ে বড় সংকট। দল-মত নির্বিশেষে দেশটির বেশিরভাগ মানুষ ইস্যুটির নিষ্পত্তি চান।
বৃহস্পতিবারের নির্বাচনি লড়াইয়ে বিবদমান দলগুলোর মধ্যে কনজারভেটিভ পার্টি দ্রুত ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। অপেক্ষাকৃত স্পষ্টতর প্রতিশ্রুতিমাখা আশ্বাসের ফুলঝুরি তাকে ভোটারদের কাছে নিঃসন্দেহে এগিয়ে রেখেছে।
বিশ্বজুড়ে প্রবল উগ্র জাতীয়তাবাদের ঢেউ ব্রিটেনেও লেগেছে। এমন বাস্তবতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে লেবার পার্টিকে ফার লেফটিস্ট ধারায় ফেরাতে জেরেমিকে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হয়ে আসতে হবে। তাহলে সেটি হবে প্রতিকূলতা আর বিদ্বেষের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় ইতিহাস। যদিও সমীকরণের হিসাবে সে সম্ভাবনা ক্ষীণ।
এবার লেবার পার্টি থেকে ছয়জন, কনজারভেটিভ পার্টি ও লিবডেম থেকে একজন করে মোট আটজন ব্রিটিশ বাংলাদেশি প্রার্থী এমপি হওয়ার লড়াইয়ে রয়েছেন। বর্তমান ব্রিটিশ পার্লামেন্টে তিন ব্রিটিশ বাংলাদেশি নারী সংসদ সদস্য হিসেবে রয়েছেন। আসন্ন নির্বাচনে অন্তত চারজনের জয়ের সম্ভাবনা প্রবল। চার জনই নারী। রোশনারা আলী ও আফসানা বেগমের বিজয় অনেকটা নিশ্চিত। লেবার পার্টি ক্ষমতায় গেলে টিউলিপ সিদ্দিক ও রূপা হক নিজ নিজ আসনে তৃতীয়বারের মতো জিতে আসতে পারলে এবার ব্রিটেনের মন্ত্রিসভায় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রথম মন্ত্রী পাওয়ার প্রত্যাশা পূরণের সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যদিকে, কনজারভেটিভরা টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় গেলে সেক্ষেত্রে দলটির একমাত্র বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রার্থী ডা. আনোয়ারা আলী হ্যারো ওয়েস্টে জিতে আসতে পারলে তারও মন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
পাঁচ.
ব্রিটেনে প্রতিরক্ষার মতো বিষয়ে জনগণের অভিমত প্রতিফলনের দাবি বাড়ছে। ব্রিটেনের সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া, সাইবার সিকিউরিটি, জেনোফোবিয়া, সীমান্ত সমস্যাসহ বহু বিষয় নিয়ে আরও সুস্পষ্ট বক্তব্য চান ভোটাররা।
ব্রিটেনে এখন ব্রেক্সিট চূড়ান্ত বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া, তৎপরবর্তী প্রতিবেশী রাষ্ট্র ও সীমান্ত সমস্যার সমাধান, সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় নীতিগত পরিবর্তনের পথটি সংকীর্ণ। তবু, নির্বাচনে জয়-পরাজয় ব্রিটেনকে জাতীয় ইস্যুতে বিভক্ত করতে পারে না। এটাই দেশটির রাজনৈতিক সৌন্দর্য।
প্রতিটি দেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটারদের মূল আগ্রহের কেন্দ্রে থাকে একটি প্রশ্ন, ক্ষমতায় কে আসছে, পুনর্বহাল নাকি পরিবর্তন?
আশ্চর্যজনক হলেও সত্য—ব্রিটেনের ভোটে এ প্রশ্ন ছাপিয়ে ভোটাররা উদ্বেগ নিয়ে উত্তর খুঁজছেন—ব্রেক্সিটের কী হবে, সেই প্রশ্নের। কারণ, ঠিক সাড়ে তিন বছর আগে ব্রেক্সিট বাস্তবায়নে ব্রিটেনের জনগণ ব্যালটের রায়ে ভোট দিয়েই তাদের অভিমত জানিয়েছিলেন। কিন্তু, ব্রিটেনের এমপিরা সে জনরায় বাস্তবায়ন করেননি।
লেখক: লন্ডনে বসবাসরত সাংবাদিক