মুনজের আহমদ চৌধুরী, লন্ডন:
ব্রিটেনজুড়ে মাদকের ছড়াছড়ি এখন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। মরন নেশায় দিশেহারা এখন ব্রিটিশ-বাংলাদেশি তরুণ প্রজন্মও। লন্ডনের বাঙালি কমিউনিটির তরুণদের মধ্যে মাদকসেবী থেকে মাদক ব্যাবসায়ীতে পরিণত হবার উদ্বেগের খবর ক্রমেই বাড়ছে। অনলাইনে মাদক সাপ্লাইয়ের সাইট খুলে মাদক ব্যবসার ঘটনায় কিছুদিন আগে বাংলাদেশি অধ্যুষিত পূর্ব লন্ডনের তিন তরুণের সাজা দিয়েছে আদালত। গাঁজার চাষ হচ্ছে ঘরের ভেতরে ফুলের টবে। পরিস্থিতির বাস্তবতা এমন। হিরোইন, কোকেন থেকে শুরু করে ভয়াবহ সব ড্রাগস হাত বাড়ালেই সহজলভ্য। মাদকের ভয়াল ছোবলে ভাঙছে সংসার, বাড়ছে অশান্তি। আর্থিক অনটন, হতাশাসহ বিভিন্ন কারণে বাড়ছে মাদকে আসক্তি। স্কুলছাত্র থেকে শুরু করে কমিউনিটিতে নারীরাও পিছিয়ে নেই।
প্রবীণ কমিউনিটি নেতা কেএম আবু তাহির চৌধুরী বলেন, মাদক এখন ব্রিটেনে বাঙালির কান্নার নাম। পরিস্থিতি আসলে ভয়াবহ। পুর্ব লন্ডনে মাদকের ভয়াবহতার কারণে সন্তান নিয়ে বসবাস করাই এখন কঠিন। শিশার নামে মাদকের অবাধ বাণিজ্য সবখানে। এখনই প্রতিরোধ করা না গেলে মাদক আমাদের জন্য সংসারে পরিবারে ভয়াবহতম বিপর্যয় ডেকে আনবে।
সর্বনাশা শিশা:
১৮ বছর বা তদুর্দ্ধদের জন্য শিশা লাউঞ্জগুলোতে প্রবেশের বাধ্যবাধকতার কথা আইনে বলা হলেও আসলে তা মানা হচ্ছে না। সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্কুল ছাত্রী থেকে শুরু করে ব্যাংক কর্মকতা, গৃহিনী; মুলত শিশায় ভিড় বেশি মেয়েদেরই। বিকেল গড়িয়ে রাত যত গভীর হয়, দল বেঁধে ব্রিটিশ বাংলাদেশি ছেলে-মেয়েদের ভিড় বাড়তে থাকে শিশার লাউঞ্জগুলোতে। কেবল পুর্ব লন্ডনেই চলছে প্রায় শতাধিক অবৈধ শিশা লাউঞ্জ। শিশার বারগুলোতে বিকেল ৫টা থেকে উঠতি বয়সের ছেলে মেয়েদের ভিড় থাকে রাত দুটো থেকে আড়াইটা অবধি।
নুন্যতম একজনের একেকবারে শিশা সেবনে ব্যায় হয় ১০ পাউন্ড। আর এ ব্যবসায় দুই তৃতীয়াংশই লাভ হওয়ায় সীসায় ঝোঁক বাড়ছে ব্যাবসায়ীদের। অবৈধ এবং অনুমোদনবিহীন এসব শিশা লাউঞ্জগুলোতে একেকটিতে মালিকরা বিনিয়োগ করেন ৩০ হাজার পাউন্ড থেকে শুরু করে ২০০ হাজার পাউন্ড পর্যন্ত। কাউন্সিলের পক্ষ থেকে এসব প্রতিষ্ঠান সিলগালা করার আগ পর্যন্ত ৬ মাস থেকে এক বছর ব্যাবসা করাই থাকে মালিকদের টার্গেট। আর মাত্র ৬ মাসে ২০০ হাজার পাউন্ড পুঁজি উঠানো যায় যেখানে, সেই লোভনীয় ব্যাবসায় বিশেষ করে পুর্ব লন্ডনে ব্যাপকভাবে ঝুঁকছেন ব্রিটিশ বাংলাদেশি তরুণরা।
নাম না প্রকাশের শর্তে একটি শিশা বারের মালিক এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে জানান, পুর্ব লন্ডনে এখন অলিতে-গলিতে বিভিন্ন অফিস-ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানের আড়ালে গজিয়ে উঠেছে প্রায় শতাধিক সীসা লাউঞ্জ। ছোট ছোট জায়গা নিয়ে করা এসব লাউঞ্জে বাতাস চলাচলের জায়গা নেই। অথচ ন্যুনতম ৫০ ভাগ ওপেন প্লেস থাকার কথা শিশা বারে। এইসব লাউঞ্জের একটিরও কোন ধরনের অনুমোদন নেই। অনেকগুলোর টেনেন্ট এগ্রিমেন্টেও মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়ে অন্য ব্যাবসার কথা বলে ভাড়া নেয়া। সম্পূর্ণ অবৈধ এসব লাউঞ্জে কাউন্সিল অভিযান চালাতে যে আইনী প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয় তাতে কয়েক মাস সময় লেগে যায়। আর এ সুযোগটিই নেন ব্যাবসায়ীরা। তবে ধরা পড়লে জরিমানা করা হয় ৫ হাজার পাউন্ড। আর ৬ মাসে অবৈধভাবে ব্যাবসা করে তারা আয় করেন ৩০০ হাজার পাউন্ড। অনেক শিশাবারে চলে অন্যান্য মাদকের ব্যাবসাও।
এ কয়েক মাসে এক স্থানে ব্যাবসা করে রেইডের আগেই অন্য স্থানে স্থান পরিবর্তন করে তারা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিশা-বারের বাইরে প্রবেশ পথে এলাকার বাসিন্দা আর পুলিশের দৃষ্টি এড়াতে চলে নানা লুকোছাপার প্রক্রিয়া। অথচ সেন্ট্রাল লন্ডনসহ লন্ডন বা ব্রিটেনের বিভিন্ন স্থানে বৈধ অসংখ্য শিশা বার রয়েছে। যেগুলোতে বেলকনিতে আইন মেনে বাতাস চলাচলের জায়গা রেখেই চালানো হচ্ছে শিশা বার। ঠান্ডার সময় বাইরে শিশা সেবনরতদের দেয়া হয় ব্ল্যাংকিটও। প্রবেশপথে চেক করা হয় বয়স নিশ্চিত করতে আইডি।
যা বলছেন শিশা সেবীরা:
সপ্তাহে চার পাচঁদিন মাইল এন্ডের একটি শিশাবারে বন্ধু-বান্ধবীদের নিয়ে আসেন ১৭ বছর বয়সী আফসানা ইসলাম। আলাপকালে তিনি বলেন, শিশা তো আর মাদক বা ড্রাগস নয়। শিশা ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে হারাম নয়। এ কারণে অন্যান্য এশিয়ান কমিউনিটির মতো বাঙালি তরুণ কমিউনিটিতে শিশা সহজে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। আর আমরা যারা মুসলমান তরুণ-তরুণী তাদের তো সেভাবে লন্ডনে বা ব্রিটেনে চিত্ত-বিনোদনের জায়গার খুব অভাব। আর নাইট ক্লাবের চেয়ে তো শিশা লাউঞ্জ ভালো… যোগ করেন আফসানা। আর আসলে নেশার চেয়ে আড্ডার টানেই আমরা বেশি যাই। খরচও কম। টানতে টানতে অভ্যাস হয়ে গেলে হঠাৎ প্রিয় ফ্লেভারের নেশা ছেড়ে দেয়া কষ্টকর।
আফিকুল ইসলাম তানভীর নামে আরেক বাংলাদেশ থেকে আসা স্টুডেন্ট জানান, মুলত ইস্ট লন্ডনের শিশা লাউঞ্জগুলোতে কাজ করেন বাঙালিরাই। যাদের ওয়ার্ক রাইট নেই তারা সপ্তাহে ৫-৬ দিন কাজ করে অনায়াসে ৩০০ পাউন্ড রোজগার করতে পারেন। পাশাপাশি এখানে সম-বয়সী ছেলে-মেয়েদের আনাগোনায় সময়টাও ভালো কাটে। শিশার আসক্তির ব্যাপকতার ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে তিনি জানান, শিশারবারে মা-মেয়ের দেখা হওয়ার মতো ঘটনার সাক্ষী তিনি নিজেই।
শিশা সর্বনাশা:
শিশায় নিকোটিন না থাকায় এটি সিগারেটের চেয়ে অনেক কম ক্ষতিকর, এবং স্বাস্থ্যের জন্য হানিকর নয় এমনটি প্রচারণা চালানো হলেও চিকিৎসকরা বলছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা।
ব্রিটেনের ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের ফ্যাকালটি অব মেডিসিনের ক্লিনিক্যাল লেকচারার ডাঃ মনজুর মোহাম্মদ শওকত বলেন, আসলে শিশা হচ্ছে এক ধরণের ধুমপান। অনেকে মনে করে যে শিশা কম ক্ষতিকর, কারণ এটাতে পানি আছে। সিগারেটে যেসব ক্ষতিকারক উপাদান আছে- যেমন নিকোটিন, টার, আর্সেনিক, লীডসহ বিভিন্ন ধরনের ক্যামিকেল, এগুলো শিশাতেও আছে। সবচেয়ে আতংকের বিষয় হচ্ছে, একটা সিগারেট কয়েক মিনিটের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। কিন্তু অন্যদিকে শিশা টানে মানুষ লম্বা সময় ধরে। কেউ ১ ঘন্টা শিশা টানলে তা ১০০টি সিগারেটের চেয়েও বেশি ক্ষতিকর। এটা হচ্ছে রিসার্চের ফাইন্ডিংস।
ডাঃ মনজুর আরো বলেন, কেউ যদি মনে করে এটা সিগারেটের চেয়ে কম ক্ষতিকর, এটা ভুল। শিশা সিগারেটের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতিকর। কেউ কেউ মনে করে ট্রাডিশনাল শিশার চেয়ে হারবাল শিশা ভালো কিন্তু এটার কোন যৌক্তিকতা মেডিক্যাল সাইন্সে নেই। দীর্ঘ সময় ধরে যারা শিশায় আসক্ত তাদের ল্যাং ইনফেকশন, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ ল্যাং ডিজিস, কোলন ক্যান্সারসহ বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেক গুণ বেড়ে যায়। বুকে ধড়পড়, শ্বাস কষ্ট এগুলো শিশাসেবীদের কমন প্রবলেম। আতংকের বিষয় হচ্ছে, মহিলাদের মধ্যে এখন শিশাসেবীদের হার বাড়ছে। শিশাসেবী মহিলাদের ক্ষেত্রে ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁিক মারাত্বক। কেউ শিশা ত্যাগে আগ্রহী হন, এ নেশাটি ত্যাগ করতে চান তাহলে লোকাল জিপি সার্জারীতে যোগাযোগ করে এজন্য সার্পোট আছে, তা তারা নিতে পারেন।
ব্রিটেনজুড়ে সহস্রাধিক শিশাবার:
ব্রিটিশ হার্ট ফাউন্ডেশন তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, ২০০৭ সালে ব্রিটেনে শিশাবার ছিল মাত্র ১৬৯টির মতো। ২০১২ সালে ৫৫৬টি। আর এ সংখ্যা এখন হাজার ছাড়িয়ে গেছে। ফ্রিডম অব ইনফরমেশন রিকোয়েষ্ট থেকে তথ্য সংগ্রহকারী একটি প্রতিষ্ঠানের তথ্যে বলা হয়েছে, ব্রিটেনের সব এলাকাতে শিশাবার শতকরা ৪০ভাগ বেড়েছে। বিপুলসংখ্যক অবৈধ শিশাবার গত কয়েক বছরে ব্রিটেনে কাউন্সিল ও পুলিশের যৌথ অভিযানে বন্ধ করা হয়েছে। করা হয়েছে জড়িতদের জরিমানাও। কিন্তু, ব্রিটেনজুড়ে গত ৫ বছরে কতটি অবৈধ শিশাবার বন্ধ করা হয়েছে, বর্তমানে চালু আছে কতটি, এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। সিটি প্রাইমারী কেয়ার ট্রাস্টের স্মোকিং প্রিভেন্টেশন এডভাইজার কাসিম চৌধুরী বলেছেন, শিশা ব্রিটেনে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। শিশা সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি বলা হয়, এটি সিগারেটের চেয়ে কম ক্ষতিকর। কিন্তু ওয়ার্লড হেলথ অর্গানাইজেশনের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, গড়ে এক ঘন্টা শিশা সেবন ২০০ সিগারেটের ক্ষতির মাত্রায় সমপরিমান।
কী বলা আছে আইনে:
ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে কার্যকর ২০০৬ সালের হেলথ এক্টে বলা হয়েছে, শিশা লাউঞ্জ বা শিশাবারে ৫০ শতাংশ অপেন স্পেইস থাকা বাধ্যতামুলক। শিশা লাউঞ্জের প্ল্যানিং পারমিশন আর ভ্যালিড ফায়ার সেইফটি সার্টিফিকেট নিশ্চিত করার কথা বলা আছে আইনে। শিশাবারে ১৮ বছরের নিচে কাউকে প্রবেশের সুযোগ দেয়া যাবে না। প্রত্যেকের আইডি চেক করার কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে আইনে। এছাড়া শিশায় যেসব ক্যামিক্যাল, টোবাকো প্রোডাক্ট ব্যবহার করা হয় তা বৈধভাবে ব্রিটেনে আমদানীর প্রমাণ থাকতে হবে। শিশার ওয়াটার পাইপে ছবি নিয়ে ধুমপানের সতর্কতা সন্নিবেশিত থাকা বাধ্যতামুলক। কিন্তু অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসব আইন আর বিধিমালার বেশিরভাগই মানা হয়না পূর্ব লন্ডনের শিশা বারগুলোতে। আলাপকালে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের একজন কাউন্সিলর বলেন, অবৈধ শিশাবারের বিরুদ্ধে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল আইনগতভাবে ব্যাবস্থা নিচ্ছে। এ ব্যাপারে প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
ধুমপান বা শিশা মাকরুহ:
ব্রিটেনে সম্প্রতি প্রকাশিত ধুমপান বিষয়ক একাধিক গ্রুপের গবেষণায় বলা হয়েছে, এলকোহল বা মদ পানে ইসলামে কঠোর বিধি-নিষেধের কারণে মুসলমানদের একটি বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠী শিশা সেবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। শিশাসেবন ধর্মীয়ভাবে নিষিদ্ধ নয়-এমন যুক্তি তাদের। এ ব্যাপারে একজন আলেম বলেন, শিশা বা ধুমপান হারাম নয়। কিন্তু যে কোনও ধরনের স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর নেশা দ্রব্য গ্রহণ ইসলাম ধর্মে মাকরুহ। শিশাসেবনের নামে পুরুষ-মহিলার বেপর্দা চলাফেরা, একত্রে বসা ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে বর্জনীয়। তিনি আরো বলেন, শিশা ইসলামে হারাম নয়, কিন্তু এটি নেশা বা আসক্তির পর্যায়ে চলে গেলে, সেটি ইসলাম সমর্থন করে না।