রিপন দে:: দায়িত্ববান ব্যক্তি বা দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব অবহেলার কারণে কোন ঘটনা ঘটলে সে দায় এড়ানো যায়না, দায় নিতেই হয়। চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৭৮ লাশ কোন দুর্ঘটনা নয় এটি হত্যাকাণ্ড। দায়িত্বে অবহেলা জনিত কারণে এ লাশের মিছিল। চকবাজার অগ্নিকাণ্ডের জন্য ২০১০ সালের মত বৈধ্য-অবৈধ্য কেমিক্লযা কারখানাকে দায়ি করা হচ্ছে। কিন্তু নিমতলীর সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর কিভাবে ৯ বছর পরেও কেমিক্যাল কারখানা বহাল তবিয়তে ছিল।
২০১০ সালের ৩ জুন রাতে নিমতলীর নবাব কাটারার ৪৩ নম্বর বাড়ির নিচতলায় রাসায়নিকের দোকানে আগুন লাগে। মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে আগুন। এতে ১২৪ জনের মৃত্যু হয়। দগ্ধ হন কয়েক শ’ মানুষ। কেমিক্যাল গুদামে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১২৪ জনের প্রাণহানির সে ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সিটি করপোরেশনের সমন্বয়ে বেশ কয়েকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ওই তদন্ত কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছিল, ২ হাজার ৭৯টি কেমিকেল গুদাম ছিল। এর মধ্যে ৮০০ বৈধ ছিল, বাকিগুলো অবৈধ। সবকটি গুদামই কেরানিগঞ্জের আশপাশে নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছিল প্রতিবেদনে। কিন্তু তদন্ত কমিটির সে সুপারিশ আমলে নিয়ে বাস্তাবায়ন করেনি সরকার বা সিটি কর্পোরেশন।
নিমতলির ট্রাজেডির ৯ বছর পর আবারো একই কারণে ৭৮টি লাশ। চকবাজারের ঘটনায় বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের তথ্যমতে একটি প্রাইভেটকারের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের পর ভবনের একটি অংশে আগুন লাগে। পাশে একটি খাবারের হোটেল ছিল, সেখানে এলপিজি গ্যাস ব্যবহার হতো। এছাড়া হাজি ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলায় কেমিক্যালের মজুদ ছিল। ছিল প্লাস্টিক দানার মতো অতি দাহ্য পদার্থ। এ কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং ৭৮ জনের লাশ এখন পর্যন্ত উদ্ধার করা হয়েছে অনেকেই নিখোঁজ আছেন আবার অনেকেই হাসপাতালের বার্ণ ইউনিটে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন। ধারনা করা হচ্ছে লাশের মিছিল তিন অংকের ঘরে পৌছাবে। শোক আর আহাজারিতে কাতর সারা দেশ।
বাংলাদেশের বিস্ফোরক পরিদপ্তর বলছে, চকবাজারে যে অগ্নিকাণ্ড হয়েছে সেটি বিভৎস রূপ পেয়েছে উচ্চমাত্রার রাসায়নিক দাহ্য পদার্থের কারণেই (সুত্র দৈনিক কালের কন্ঠ)। চকবাজারের ঘটনার পরপর ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র সাঈদ খোকন ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে জানিয়েছেন, রাজধানীর পুরান ঢাকায় কোনো ধরনের দাহ্য পদার্থ ও কেমিক্যালের গোডাউন থাকবে না, থাকবে না, থাকবে না। গোডাউন উচ্ছেদের জন্য কঠোর থেকে কঠোরতর ব্যবস্থা নেয়া হবে উল্লেখ করে সাঈদ খোকন বলেন, ‘ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে পুরান ঢাকার কেমিক্যাল গোডাউন উচ্ছেদের জন্য গত সোমবার থেকেই মোবাইল কোর্ট পরিচালনা শুরু হয়েছে। আগুন লাগার ঘটনার সাত-আট দিন আগে এফবিসিসিআই এর মাধ্যমে কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে একটি বৈঠকও করা হয়েছিল। তারপর থেকে আমরা উচ্ছেদ অভিযান শুরু করি। আমাদের আগে থেকেই উচ্ছেদ অভিযান চলছিল। কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে গতকাল এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটল।’ (সুত্র জাগো নিউজ)
মেয়র বলেছেন ঘটনাটি অনাকাক্ষিত কিন্তু আসলেই কি তাই? নিমতলির ট্রাজেডির এত বছর পরেও কোন পদক্ষেপ না নেওয়াকে শুধুই অবহেলা বলা যায় এবং চকবাজারের মত আরেকটি ট্রাজেডির উর্বর ভূমি তৈরি করে রাখা হয়েছে সেটাই বলা যায়। এলাকাবাসীসহ সংবাদ মাধ্যম বারবার এমন একটি ঘটনা যে ঘটবে তার সংকেত দিয়ে আসছিল। যথাযথ প্রতিকার করলে এমন একপি ঘটনা ঘটত না। বারবার সংবাদ মাধ্যম এ ঘটনা নিয়ে প্রতিবেদন করলেও সংশিষ্ট দায়িত্ব প্রাপ্তদের কোন টনক নড়েনি। যার ফলে নিমতলির ঘটনার ৯ বছর পরেও জাতীর কাদে আরো ৭৮টি লাশ । এই দায় কি দায়িত্ব প্রাপ্তরা এড়াতে পারেন? এটকি শুধুই দূর্ঘটনা নাকি হত্যা? নিশ্চয় এটি হত্যা । কেমিক্যাল কারখানার ব্যাপারে এই অবহেলা শুধু অবহেলা নয় মারাত্মক শাস্তিযোগ্য অপরাধ। চকবাজারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাকে হত্যাকাণ্ড আখ্যা দিয়েছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক তিনি বলেছেন, ‘এ জাতীয় ঘটনাকে আমি হত্যাকাণ্ড বলব। এ জাতীয় অপমৃত্যু বা অবহেলাজনিত মৃত্যু যেন আমাদের দেখতে না হয়। এ জন্য রাষ্ট্রের কাউকে না কাউকে দায় নিতে হবে।’ (সূত্র: জাগো নিউজ)
চকবাজারের অগ্নিকাণ্ড কোন অস্বাভিক ঘটনা নয় এমন কিছু যে ঘটতে পারে তা এলাকাবাসী আগেই ধারনা করেছিল এবং এবং সংবাদ মাধ্যম বারবার তা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। ২০১৭ সালে ৪ জুন দৈনিক প্রথম আলো এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে “নিমতলীর আশপাশ ও পুরান ঢাকার আবাসিক এলাকাগুলো থেকে প্লাস্টিকের কারখানা ও রাসায়নিকের গুদাম সরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে স্থানীয় লোকজন দাবি জানালে, এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো এখনো পর্যন্ত কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।”
দৈনিক ইত্তেফাক ২০১৫ সালে ১২ মে একটি প্রতিবেদনে জানায় “পুরনো ঢাকার প্রায় ৩০ লাখ মানুষ মৃত্যুর ঝুঁকিতে বসবাস করছেন। যে কোন সময় ঘটতে পারে নিমতলীর মত বড় কোন দুর্ঘটনা। ২০১১ সালের ২০ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে ঢাকা মহানগরের আবাসিক এলাকা থেকে অবৈধ রাসায়নিক কারখানা ও গুদামগুলো কামরাঙ্গীরচর ও কেরানীগঞ্জে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ জন্য বিসিকের চেয়ারম্যানকে প্রধান করে একটি ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিবকে প্রধান করে আরেকটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই কমিটিগুলো কাজই শুরু করতে পারেনি।
কোন ঘটনা ঘটার পরপর তা নিয়ে কয়েকদিন আলোচনা আর ৪/৫ টি তদন্ত কমিটি গঠন এ রাষ্ট্রে একটি রুটিন ওয়ার্ক হয়ে গেছে। কিন্তু কি থাকে তদন্ত কমিঠির রিপোর্টে, কি তারা সুপারিশ করে , তার বাস্তবায়ন সম্ভব কিনা বা কতটুকু হয়েছে সে খবর কেই রাখেনা। যাদের রাখার দ্বায়িত্ব তারা এ বিষটি ভুলেই যান। ২০১১ সালের ২০ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে কেমিক্যাল পুরান ঢাকা থেকে সরিয়ে নেবার জন্য বিসিকের চেয়ারম্যানকে প্রধান করে যে কমটি করেছিল সে কমিটি কেনো তা করতে পারেনি বা কেনো তা করা হয়নি এর উত্তর কি রাষ্টের কাছে আছে। এই কমিটি যদি কেমিক্যাল পুরান ঢাকা থেকে সরিয়ে নিত নিশ্চই ৭৮টি লাশ আমাদের দেখতে হত না। যে ঘটনা চাইলে এড়ানো যেত এবং এড়ানোর সুস্পষ্ট উপায়ও জানা ছিল তবুও না করতে পারা নিশ্চই ৭৮টি লাশের পেছনে দায়ী। ৭৮টি লাশের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার কি সম্ভব? নাকি সব সম্ভবের এই দেশে মানুষের লাশের চেয়ে কমদামী আর কিছু নাই?
লেখক: গণমাধ্যম কর্মী।