চায়ের রাজধানী খ্যাত শ্রীমঙ্গলে কেজি প্রতি চায়ে ৬৫ থেকে ৮০ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। চায়ের বাজারে ক্লোন টি (ছোট দানা) প্রতি কেজি ৩০০ টাকা থেকে বেড়ে ৩৪০ টাকা থেকে ৩৭০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। ক্লোন টি (মোটা দানা) ৩৬০ টাকা কেজি থেকে বেড়ে এখন ৪০০ টাকায় এবং গুপ্ত টি স্পেশাল চা প্রতি কেজি ৩৫০ থেকে ৩৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এখনও এই বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।
বিটি-২ গ্রেডের চা ৪৫০ থেকে বেড়ে ৫০০ টাকায় বিক্রয় হচ্ছে। দেশের সবচেয়ে উন্নত চা বিটি-গোল্ড বা টি-গোল্ড এখন পর্যন্ত অপরিবর্তিত দামেই অর্থাৎ ৬০০ টাকাতেই এবং গ্রীন-টি এখন পর্যন্ত অপরিবর্তিত দাম অর্থাৎ ৬৫০ টাকা কেজি দরে বাজারে বিক্রি হচ্ছে।
ফিনলে টি কোম্পানির হরিণছড়া চা বাগানের টি-প্লান্টার হক ইবাদুল বলেন, চায়ের দাম বৃদ্ধির জন্য অন্যতম কারণ হলো, চা বাগানগুলোতে উৎপাদন কম। বিশেষ করে, সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন চা বাগানগুলো রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ায় চায়ের উৎপাদন কমে গেছে। বালিশিরা ভ্যালির ৩২টি চা বাগান এবং লস্করপুর ভ্যালির ২৩টি বাগানের প্রায় সবগুলোই ‘লিফরাস্ট’ এবং ‘ লোপার ক্যাটারপিলার’ রোগে আক্রান্ত হয়। এ রোগের কারণেই চা বাগানগুলোতে চায়ের উৎপাদন কম।
চায়ের রোগগুলো উল্লেখ করে তিনি বলেন, সিলেটে এ বছর চায়ের আনকমন দুটি রোগের নাম হলো, ‘লিফরাস্ট’ এবং ‘লোপার ক্যাটারপিলার’। যেটা কোনো বছর হয়নি। লিফরাস্ট হলো ছত্রাকজনিত রোগ। এর ফলে চায়ের কুঁড়ি এবং অন্য পাতাগুলো কালো হয়ে পচে যায়। চা পাতা তখন আর সূর্য থেকে খাবার গ্রহণ করতে পারে না। আর লোপার ক্যাটারপিলার হলো এক ধরনের পোকার আক্রমণ। যারা এক রাতের মধ্যেই চা পাতার রস শুষে নিয়ে পাতাকে ঝাঝড়া করে ফেলে।
তিনি বলেন, কীটনাশক বা বালাইনাশক প্রয়োগ করেও উপকার মিলছে না। কারণ ইতোপূর্বে আমরা চা গাছগুলোতে এতো পর্যাপ্ত পরিমাণে কীটনাশক ব্যবহার করেছি যে, এখন আর তা তেমনভাবে কাজ করছে না; তা রেজিস্ট্যান হয়ে গেছে বলে জানান চা বিশেষজ্ঞ হক ইবাদুল।
শ্রীমঙ্গলের অকশান বায়ার সর্বাধিক চা বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান গুপ্ত টি হাউজের স্বত্ত্বাধিকারী পীযুষ কান্তি দাশগুপ্ত বলেন, বাঙালির অন্যতম প্রিয় পানীয় হলো চা। শরীরকে তাৎক্ষণিক চাঙ্গা করতে চা দারুণ কার্যকর। এর ফলেই চায়ের অভ্যন্তরীণ চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে।
তিনি বলেন, বর্তমানে বাজারে বেড়েছে চায়ের দাম। এ দাম বৃদ্ধির ফলেও ধস নামেনি চায়ের বাজারে। ক্রেতারা দাম বৃদ্ধির মধ্যেই ক্রমাগত কিনে চলেছেন তাদের প্রিয় পানীয়। তিনি বলেন, এক সময় চা বিদেশ থেকে আমদানি করা হলেও শুল্ক বৃদ্ধির কারণে তা করতে এখন অনেকটাই নিরুৎসাহিত দেশীয় চা আমদানিকারী প্রতিষ্ঠান।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০ নম্বর অকশানের চা নিলাম থেকেই দাম বাড়তে শুরু করে। তখনই এক লাফে ১৪ থেকে ১৬ টাকা বেড়ে যায়। পরবর্তী নিলামগুলোতে সেই বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এপ্রিল থেকে পরবর্তী বছরের মার্চ পর্যন্ত সারাবছর অকশানে মোট ৪৫টি চা নিলাম অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
চায়ের সাথে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তাপমাত্রার অস্বাভাবিক ওঠানামা এবং নিয়মতান্ত্রিক বৃষ্টিপাত না হওয়াতে চা-বাগানগুলোতে চায়ের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। এতে করে চা-বাগানের চা-গাছে নানা পোকা-মাকড়ের আক্রমণের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রকারের রোগ-ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ে। ফলে চায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে কম।
একাধিক চা-বাগানের সিনিয়র ব্যবস্থাপকদের মতে, এখন পর্যন্ত চা-শিল্পের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়নি। এ বছর বৈরি আবহাওয়ায় পড়ে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৭/৮ শতাংশ চা উৎপাদন কম হওয়ার সম্বাবনা থাকছে।
এদিকে, চা শ্রমিকরাও বলছেন, পোকা-মাকড়ের আক্রমণের কারণে চা গাছে সঠিক সময়ে নতুন পাতা না আসাতে তারাও বিপাকে পড়েছেন। প্রতিদিন এসব শ্রমিকের পাতা উঠানোর নিরিখ পূরণ করতে পারছেন না।
চা বিশেষজ্ঞদের ধারণা, চা বাগানে রোগবালাইয়ের আক্রমণ দেখা দেয়ায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে চা উৎপাদনে। অন্যদিকে, আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে গত কয়েক বছর ধরে এ অঞ্চলে চায়ের উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে।
তারা বলছেন, জলবায়ুর প্রভাব ও বৈরি আবহাওযায় পড়ে চা উৎপাদন মৌসুমে মৌলভীবাজার জেলার চা বাগানগুলোতে নানা রোগ-ব্যাধির প্রকোপ দেখা দেয়ায় এ বছর চায়ের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়।