তারেক মাহমুদ:
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অপরূপা মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলা প্রাচীন ইতিহাস ঐতিহ্যের এক সমৃদ্ধ নিদর্শন ক্ষেত্র। এখানকার অধিকাংশ স্থানের রয়েছে ঐতিহাসিক ভিত্তি। বিভিন্ন এলাকার নামকরণের ইতিহাস, স্থাপত্য, প্রাচীন ঘটনা-অনুঘটনা ঘাঁটলে এর সত্যতা পাওয়া যায়। ইতিহাসের নির্যাস পাওয়া যায় বড়লেখার প্রত্যেকটি অঞ্চলে, প্রত্যেকটি জনপদে। কোথাও ইতিহাসের নিগূঢ় বাস্তবতা, কোথাও আবার লোককথা ও প্রচলিত বিশ্বাসকে পুঁজি করে গড়ে উঠেছে এখানকার ইতিহাস।
বড়লেখার ঐতিহাসিক ‘খোঁজার মসজিদ’টি এরকমই এক প্রাচীনতম নিদর্শন। ঐতিহাসিক এ মসজিদটি বড়লেখা পৌর-শহর থেকে প্রায় ৮কিলোমিটার পশ্চিমে দাসের বাজারের অদূরে ল’ঘাটি গ্রামে অবস্থিত। মোঘল স্থাপত্য-রীতিতে চুন-সুরকি দিয়ে নির্মিত এই মসজিদের ছাদে রয়েছে বিরাট আকৃতির ৩টি বিশেষ গম্বুজ। মূল ভবনের দেয়ালের পুরুত ৭-৮ ইঞ্চি। ভেতরের অংশে দেয়াল, মেরাবি এবং মিনারের গায়ে রয়েছে পাথরের কারুকাজ। মসজিদের সামনে সু-পরিসর চত্বর এবং প্রবেশদ্বারের তোরণটিতে রয়েছে গম্বুজের অনুরূপ আকৃতির উঁচু মিনার। মিনার সংলগ্ন গার্ডওয়ালের উত্তর-দক্ষিণে রয়েছে কবরস্থান। কবরস্থানেও চুন-সুরকি দিয়ে নির্মিত ভগ্ন প্রাচীর বেষ্টিত ১টি বেশ পুরাতন কবর বিদ্যমান। মূল ভবন অক্ষত রেখে মসজিদের সামনের অংশ সংস্কার করা হয়েছে বেশ কয়েকবার।
মসজিদটি কবে, কারা নির্মাণ করেছিলেন সে সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য বা ঐতিহাসিক শিলালিপি পাওয়া যায়নি। ফলে ঐতিহাসিক এই মসজিদকে ঘিরে জনমনে গড়ে উঠেছে নানা কিংবদন্তি। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, মসজিদটি ১৬শ শতকের দিকে মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব শাসনামলে নির্মিত হয়েছে। তবে স্থানীয়দের বিশ্বাস সম্পূর্ণ গায়েবী-ভাবে আবির্ভূত হয়েছে মসজিদটি। এ জন্য স্থানীয়দের কাছে এটি ‘গয়বী মসজিদ’ (অলৌকিক) নামেও সমধিক পরিচিত। কথিত আছে যে, খোঁজার মসজিদে কিছু মানত করলে মনোবাসনা পূর্ণ হয়। আর এই লোকবিশ্বাসকে ধারণ করেই দৈনন্দিন জীবনের নানা প্রতিকূলতায় হাঁপিয়ে ওঠা মানুষরা এখানে এসে নামায, দোয়া, জিকিরসহ বিভিন্ন ইবাদতে মশগুল থেকে সময় কাটান।
স্থানীয়রা জানান, মসজিদটি কবে নির্মাণ করা হয়েছে সে সম্পর্কে সঠিক তথ্য গ্রামের কেউ জানেন না। অলৌকিকভাবে আবির্ভূত হওয়ার গল্প তাঁরা লোকমুখে শুনে এসেছেন। তবে এই মসজিদে কিছু মানত করলে যে ইচ্ছা পূরণ হয় সেটা সত্য। মসজিদে প্রতিদিনই দূর দূরান্ত থেকে সাধারণ দর্শনার্থী এবং মানতকারীরা আসেন। তবে বৃহস্পতিবার দিনটি এখানে বিশেষ দিন হিসেবে মর্যাদাপ্রাপ্ত। তাই প্রতি বৃহস্পতিবারে এখানে বেশি পরিমাণ লোক সমাগম ঘটে। মানতকারীরা এখানে এসে শিরণী বিতরণ করেন। পুরুষের পাশাপাশি মহিলাও আসেন। সৃষ্টিকর্তার কাছে চাওয়া পাওয়ার কথাগুলোও জানান কায়মনো বাক্যে।
মসজিদে এভাবে মানত করার বিষয়ে বড়লেখা বাজারের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খতিব মাওলানা মুফতি রুহুল আমীন শাহবাজপুরডটকম’কে বলেন, ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদ নিয়ে কৌতূহল থাকতে পারে তাই দর্শনার্থী যাওয়া স্বাভাবিক। তবে মানত করা এবং সেখানে গিয়ে মোরগ-খাসি ইত্যাদি জবাই দেয়া রীতিমত বাড়াবাড়ি। ইসলাম এ ধরনের কাজকে সমর্থন করে না। তিনি বলেন, কুরআন হাদিসের সঠিক জ্ঞানহীন লোকেরাই সাধারণত এসব বেদাতের পথকে ইসলামের সরল পথ মনে করে।
মসজিদের স্থাপত্যরীতি ও নির্মাণকাল সম্পর্কিত তথ্য জানতে দেশের প্রখ্যাত প্রত্নতত্ত্ব গবেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. একেএম শাহনাওয়াজরে সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি শাহবাজপুরডটকম’কে বলেন, যেহেতু মসজিদে কোন শিলালিপি পাওয়া যায়নি সেহেতু স্থাপত্য রীতি অনুসরণ করেই নির্মাণকাল নির্ণয় করতে হবে। স্থাপত্য রীতি অনুসারে এটি মোগল আমলেরই ধরে নেয়া যায়। কারণ মোগল স্থাপত্যের মসজিদগুলোই সাধারণত তিন গম্বুজবিশিষ্ট হয়ে থাকে। গম্বুজ প্লাস্টার করা থাকে এবং মূল কাঠামো একটু উঁচু বেদিতে থাকে। লোকবিশ্বাসের আবরণে আমাদের দেশের অনেক জায়গাতেই ঐতিহাসিক স্থাপত্য গুলোকে কেন্দ্র করে গড় উঠেছে নব্য ‘লাল সালু’। আমাদের উচিত সঠিক ইতিহাসের প্রচার করা।