রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪ খ্রীষ্টাব্দ | ৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ



Sex Cams

                    চাইলে বিজ্ঞাপন দিতে পারেন

গরিবের নিউমোনিয়া চিকিৎসায় বাংলাদেশি ডাক্তারের আবিষ্কার ছড়াচ্ছে বিশ্বে
নিউজ ডেস্ক

নিউজ ডেস্ক



বিজ্ঞাপন

প্রাণঘাতী নিউমোনিয়ার চিকিৎসায় বাংলাদেশি এক ডাক্তারের উদ্ভাবিত পদ্ধতি আফ্রিকাসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এক প্রতিবেদনে এমনটি জানিয়েছে লন্ডনভিত্তিক সাময়িকী দ্য ইকনমিস্ট।

সিলেটের একটি হাসপাতালে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে প্রশিক্ষণ শুরু করার পর প্রথম রাতেই তিনটি শিশুকে নিউমনিয়ায় মারা যেতে দেখেন ডা. মোহাম্মদ চিশতী।

শিশুগুলোকে ফেস মাস্ক বা নাকের কাছে রাখা টিউবের মাধ্যমে অক্সিজেন দেয়া হচ্ছিল। এটাকে ‘লো-ফ্লো’ টেকনিক বলে। কম আয়ের দেশগুলোতে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী এই ‘লো-ফ্লো’ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।

কিন্তু সিলেটের ওই হাসপাতালে স্পষ্টতই এই পদ্ধতি কাজ করছিল না। একারণে ডা. চিশতী উন্নত ব্যবস্থা আবিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেন। ফেলে দেয়া স্যাম্পুর বোতল ব্যবহার করে প্রায় দৈব অনুপ্রেরণায় এই পদ্ধতি আবিষ্কারে তিনি সক্ষম হন।

ডা. চিশতীর উদ্ভাবিত পদ্ধতিই অন্যান্য স্বল্পোন্নত দেশগুলোতেও ছড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। কারণ, এটি শুধু আক্রান্ত শিশুদের প্রাণ রক্ষায় অধিক কার্যকরই নয়, একই সঙ্গে এটি তৈরির খরচ অত্যন্ত কম।

গত বছর নিউমনিয়ায় পাঁচ বছরের কম বয়সী ৯ লাখ ২০ হাজার শিশু মারা গেছে। এই বয়সসীমার শিশুদের জন্য এই অসুখটিই সবচেয়ে মারাত্মক। বাংলাদেশে ২৮ শতাংশ শিশুমৃত্যুর কারণ নিউমোনিয়া।

শ্বাসযন্ত্রে ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস সংক্রমণের ফলে নিউমনিয়া হয়। এই অসুখ প্রকট আকার ধারণ করলে আক্রান্ত ব্যক্তি দমবন্ধ হয়ে মারা যেতে পারেন।

বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশগুলোর অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের জন্য নিউমোনিয়া বিশেষ প্রাণঘাতী। অপুষ্টির কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। এছাড়াও শরীরের অক্সিজেনের মাত্রা বেশি এবং কার্বনডাইঅক্সাইডের মাত্রা কম রাখার জন্য নিউমনিয়ায় আক্রান্ত শিশুরা জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে। কিন্তু এতে তাদের প্রচুর শক্তি খরচ হওয়ায় একসময় তারা এভাবে বেশিক্ষণ নিঃশ্বাস নিতে পারে না।

ডা. চিশতীর যন্ত্রটি এমনভাবে নকশা করা হয়েছে যা শিশুর শ্বাস-প্রশ্বাস চালিয়ে যাওয়ার এই পরিশ্রম কমিয়ে দেয়। এটি তৈরি ও ব্যবহারের খরচও অত্যন্ত কম।

‘লো-ফ্লো’ পদ্ধতিতে অক্সিজেন দেয়া হলে শ্বাস-প্রশ্বাস চালিয়ে যাওয়ার পরিশ্রম কমে না। উন্নত দেশগুলোতে শ্বাস-প্রশ্বাসের কষ্ট কমানোর জন্য যে যন্ত্র ব্যবহার করা হয় তার দাম প্রায় ১৫ হাজার ডলার। একারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গরীব দেশগুলোতে তুলনামূলক কম খরচে ‘লো-ফ্লো’ পদ্ধতি ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছে।

ডা. চিশতী অস্ট্রেলিয়া সফরের সময় ‘বাবল-সিপিএপি’ নামের এক ধরনের অক্সিজেন সরবরাহের যন্ত্র দেখতে পান। নির্ধারিত সময়ের আগে জন্ম নেয়া শিশুদের শ্বাস-প্রশ্বাসে সহায়তা করার জন্য এটি ব্যবহার করা হয়।

‘বাবল-সিপিএপি’ যন্ত্রের দাম ছয় হাজার ডলার। এটি অক্সিজেন সরবরাহে ধনী দেশগুলোতে যন্ত্রের চেয়ে কম দামি হলেও গরীব দেশের হাসপাতালগুলোর জন্য এটা ব্যয়সাপেক্ষ।

দৈবচক্রে ডা. চিশতী একটি শ্যাম্পুর বোতল দেখতে পান যার মধ্যে কিছু বাবল বা বুদ্বুদ আটকে ছিল। সেটা দেখে তিনি হঠাৎ অনুধাবন করেন, এটি শিশুদের অক্সিজেন সরবরাহের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। শ্যাম্পুর খালি বোতলের সঙ্গে তিনি অক্সিজেন, কিছু নল ও পানিভরা প্লাস্টিকের বোতল যুক্ত করে নতুন একটি যন্ত্র উদ্ভাবন করেন।

ঢাকা হসপিটাল ফর ইন্টারন্যাশনাল ডায়রিয়া ডিজিজ রিসার্চ-এর রোগীদের ওপর ডা. চিশতী পরীক্ষামূলকভাবে এই যন্ত্র প্রয়োগ করেন। ২০১৫ সালে তিনি ও তার সহকর্মীরা এই পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করেন। এতে নিউমোনিয়ার নতুন চিকিৎসার সম্ভাবনা দেখা যায়।

হাসপাতালটি এখন এটা নিয়মিত ব্যবহার করছে। এখানে নিউমোনিয়ায় শিশু মৃত্যুর সংখ্যা ৭৫ শতাংশ কমে গেছে। অর্থাৎ, ধনী দেশগুলোতে উন্নত যন্ত্র ব্যবহার করে যত শিশুর প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হয়, ঢাকা হসপিটালেও এখন ওই পরিমাণ নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুর প্রাণ বাঁচানো যায় অনেক কম খরচে।

ইকনমিস্টকে ডা. চিশতী জানান, প্রাণ বাঁচানোর সাথে সাথে তার যন্ত্রের কারণে নিউমোনিয়ার চিকিৎসার খরচ ৯০ শতাংশ কমে গেছে। তার নকশায় ‘বাবল-সিপিএপি’ যন্ত্রের তৈরিতে খরচ হয় ১.২৫ ডলার বা ১০৫ টাকা। এতে অক্সিজেনও ব্যবহার করতে সাধারণ যন্ত্রের চেয়ে অনেক কম পরিমাণে।

তিনি জানান, ২০১৩ সালে ওই হাসপাতালে অক্সিজেন কিনতে ব্যয় করেছে ৩০ হাজার ডলার, কিন্তু ২০১৭ সালে এতে তাদের খরচ হয় মাত্র ছয় হাজার ডলার।

ডা. চিশতীর আইডিয়া অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ছে । তিনি ও তার দল অক্সিজেন সরবরাহের নতুন যন্ত্রটি ইথিওপিয়ার কয়েকটি হাসপাতালে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার শুরু করবেন। সেখানেও এটা ঢাকার হাসপাতালের মতোই সফল হলে, নিশ্চিতভাবেই এটা অন্যান্য জায়গায় ব্যবহার করা শুরু হবে বলে জানায় ইকনমিস্ট।

বাংলাদেশি এই বিজ্ঞানীর আবিষ্কারের সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে- কোনো পদ্ধতির মূল কর্মপদ্ধতি বুঝতে পারলে তা থেকে অনেক সহজে বিশাল কিছু অর্জন করা সম্ভব। যন্ত্রের কার্যকারিতার জন্য ব্যয়বহুল উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন প্রযুক্তি জরুরি নয়, এটা তারই একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।