মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলাধীন কাউয়া-দিঘি হাওর। এই হাওরের পশ্চিম প্রান্তে ফতেপুর ইউনিয়নের এক নিবৃত পল্লি অন্তেহরী। হিজল, করচ, তমালের বন এই গ্রামটিকে করেছে অপরুপ অনন্য। ধুলোমাখা মেঠোপথ পেরিয়ে প্রবেশ করতে হয় গ্রামটিতে। প্রবেশের সাথে সাথে এর বিচিত্র রূপ স্পর্শ করে হৃদয়।
বর্ষায় গ্রামের বাড়িগুলো দেখে মনে হয় পানির ওপর ভেসে আছে। শীত মৌসুমে তার বিপরীত। শীতে এক একটি বাড়ি মনে হবে টিলার ওপর তৈরি। হাওরের বাড়িঘর খুব সহজে পানিতে নিমজ্জিত হয়। এ কারণে বাড়িগুলো অনেক উঁচুতে নির্মাণ করতে হয়। প্রতিটি বাড়ির চারিদিকে দেখা মিলবে বিভিন্ন জাতের গাছ গাছালি। এরমধ্যে অন্যতম হচ্ছে হিজল, তমাল, করচ এই গাছগুলো বর্ষায় হাওরের ঢেউ থেকে বাড়িগুলোকে রক্ষা করে এবং সারাবছর দেশিয় পাখিদের জন্য নিরাপদ আবাসস্থল। শীত মৌসুমে দেশি-বিদেশি নানা জাতের পাখি একত্রে বসবাস করে এখানে। গ্রামের কেউ পাখি শিকার করেন না। বাইরে থেকে পাখি শিকারের উদ্দেশ্যে কেউ এলে তারা বাধা দিয়ে থাকেন।
হাওর পাড়ের এই গ্রামটির অধিকাংশ মানুষই কৃষিজীবী। হাওরে সাধারণত একটি ফসল হয় বোরো ফসল। এ ফসলের ওপর নির্ভর করে তাদের সারা বছর চলতে হয়। খাদ্য শিক্ষা চিকিৎসা সহ সকল মৌলিক চাহিদা এই ফসলের আয় থেকে চলে। পাশাপাশি যে সময় যে কাজ পান সেগুলোও করে জীবন ধারণ করে থাকে। কেউ কেউ বর্ষা মৌসুমে হাওরে মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করে চাহিদা পূরণ করে।
২০১৮ সালে এই গ্রামটিকে সরকারিভাবে পর্যটন কেন্দ্র ঘোষণা করা হয়। নামকরণ করা হয় ’জলের গ্রাম অন্তেহরী’ সারাবছর পর্যটকরা নির্বিঘ্নে আসার লক্ষ্যে নানাবিধ উদ্যোগ নিয়ে কাজ চলছে। সরকারি উদ্যোগে কিছু উন্নয়ন হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে অবকাঠামো গত উন্নয়নের পরিকল্পনা চলছে।
এই গ্রামকে পর্যটন কেন্দ্র ঘোষণা করায় কাজের সুযোগ পাবেন, বোরো ফসলের ওপর নির্ভরশীল গ্রামের অনেক দরিদ্র মানুষ। পাশাপাশি বাড়বে তাদের জীবনযাত্রার মান। বর্ষায় হাওরের বুকে থাকে থইথই জল কিংবা জলের ওপর একটুকরো সবুজের হাতছানি। শাপলা ও শালুক অথবা নাম না জানা বাহারি বঙ্গের ফুল যেন জানান দেয়, স্বাগতম হে অতিথি জলের গ্রামে।
এখানকার সবচাইতে আকর্ষণ ’জলের মধ্যে হিজল-করচের ডুবাডুবি খেলা’ যা ভাটি-বাংলার মানুষের কাছে অতি সাধারণ দৃশ্যপট আর নগরজীবনের কাছে কৌতূহল। পুরো গ্রাম মনে হবে জলের ওপর ভেসে বেড়াচ্ছে। আর প্রতিটি বাড়ি মনে হবে ভাসমান কটেজ।
বর্তমানে হাওর শুকনো, মাঠে সবুজ কচি ঘাস দেখলে মনে হবে সবুজ গালিচা বিছানো হয়েছে। যতদূর চোখ যায় শুধু এই দৃশ্য দেখা যায়। সবুজ মাঠে হাজার হাজার সাদা বক উড়ে বেড়ায় খাদ্যের সন্ধানে। সূর্য যখন পশ্চিম আকাশে হেলান দেয় তখন হাজারো সাদা বক সহ নানা জাতের পাখিগুলো সন্ধ্যা নামার মুহূর্তে গ্রামের গাছগুলোতে এসে আশ্রয় নেয়। ঘুরতে আসা ভ্রমণপিপাসুরা পাখিদের ঘরে ফেরার দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হন বেশি।
রাজনগরের ফতেহপুর ইউনিয়নের গ্রাম অন্তেহরী। কাউয়াদিঘি হাওরকে কেন্দ্র করে এখানে লোকবসতী গড়ে উঠে। গ্রামটি বৈচিত্র্যপূর্ণ রূপ ধারণ করে যখন হাওর পানিতে পরিপূর্ণ থাকে। আর তখনই অন্তেহরী ভ্রমণের উপযুক্ত সময়। নৌকায় চড়ে ঘুরে বেড়ালে এই জলের গ্রামের নান্দনিক রূপ চোখে ধরা পড়বে।
সূর্যের বাড়ি ফিরবার সময় হলে বিকেলের আলো নিমিষেই মিলাতে থাকে। সন্ধ্যার আলো-আঁধারে এ গ্রামের প্রকৃতি যেন অকৃপন হয়ে ওঠে। পশ্চিমাকাশে যখন সূর্য ডুবতে যায় তখন ঘরে ফেরা উড়ন্ত পাখিদের বিচরণ প্রকৃতিকে করে তুলে আরো আকর্ষণীয়।
ভাসমান কোনও রাস্তায় কিংবা উঁচু ভূমিতে দাঁড়িয়ে দেখে নিতে পারেন নিস্তেজ সূর্যের অবগাহন। তখন ঝাঁকে ঝাঁকে সাদা বক উড়ে বেড়ায় অন্তেহরীর আকাশে। এ যেন পাখিদেরও স্বর্গরাজ্য। প্রকৃতি রূপ নেয় অন্য এক লাবণ্যে। তাই বলা চলে, ভ্রমণপিপাসুদের কাছে অন্তেহরী গ্রামখানি প্রশান্তির অন্যতম দর্শনীয় স্থান।
মৌলভীবাজার শহর থেকে অন্তেহরী গ্রামের দূরত্ব ১৪ কিলোমিটার। বসবাস প্রায় ৬ হাজার মানুষের। ৪ থেকে ৫ বছর আগেও বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে শহরের সাথে গ্রামটির সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকতো। বর্তমানে সড়ক পথের ভালো উন্নতি হয়েছে। তাই গাড়ীতে করে সহজে যেতে পারেন অন্তেহরী গ্রামে। প্রকৃতির উদারতা ও প্রাণবন্ত জীবনের স্বাদ নিতে ছুটে আসুন হাওর পাড়ে।
যে ভাবে যাবেন, মৌলভীবাজার শহরের চাঁদনী ঘাট ব্রিজ সংলগ্ন জগতপুর বাস-স্ট্যান্ড থেকে ৩০ টাকা ভাড়ায় সিএনজি চালিত অটোরিকশাতে যেতে পারেন। কিংবা রিজার্ভ গাড়ি নিয়েও সোজা চলে যাওয়া যায় অন্তেহরী বাজারে।