ড. পার্থ ব্যানার্জী :: জীবনের অভিজ্ঞতাগুলো ও অনুভূতিগুলো লিখে রাখি প্রতিদিন- অনেকটা সেই পুরোনো দিনের ডায়রির মতো। তখন মানুষ দিস্তে দিস্তে সাদা কাগজ দোকান থেকে কিনে এনে কলম দিয়ে লিখতো। আর এখন তার বদলে সোশ্যাল মিডিয়াতে বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতে লেখে- কম্পিউটারের কী-বোর্ডের সাহায্যে। আঙুল আর মাথা আর হৃদয় কিন্তু সেই একই রকম কাজ করছে। তারা ঠিক একই রকম সক্রিয়, সচেতন।
মগজ থেকে হৃদয়ে অনুভূতি প্রবাহিত হলো, পৌঁছে গেলো। আর সেখান থেকে আবার মগজে গেলো খবর দিতে- লেখার জন্য, কথা বলার জন্যে আমি প্রস্তুত। মস্তিষ্ক তখন হাতকে, আঙুলকে নির্দেশ দিলো, ‘এবারে লিখে ফেলো। আর দেরি করোনা।’ শুধু চাই সময় ও সুযোগ। একটু নীরবতা। শুধু চাই সাদা কাগজ আর পেন। আর এখন শুধু চাই একটা ল্যাপটপ, ডেস্কটপ, কিংবা স্মার্টফোন।
ট্রাম্পের জাতিবিদ্বেষ, বর্ণবিদ্বেষ, নারীবিদ্বেষ, ধর্মবিদ্বেষ, দরিদ্রবিদ্বেষ, শ্রমিক ইউনিয়ন-বিদ্বেষ, পরিবেশবিদ্বেষ, বিজ্ঞানবিদ্বেষ। একটা মানুষের মনে যখন এতো বিদ্বেষ থাকে, ঘৃণা থাকে, আর তা প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে প্রকাশিত হয়, লক্ষ মানুষকে প্রভাবিত করে এবং তাদেরকেও বিদ্বেষী করে তোলে, তখন কী মনে হয়?
মনে হয়, এই মানুষটা জীবনে কখনো ভালোবাসা পায়নি, শান্তি পায়নি, স্নেহ মমতা পায়নি। সে ওপরে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতে পারে, তার হাতে ভয়ঙ্কর পুলিশ, মিলিটারি, গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র থাকতে পারে। ওপরে সে ভয়ঙ্কর শক্তিধর এক রাষ্ট্রনায়ক। কিন্তু মনের ভেতরে সে একজন ব্যর্থ, হতাশাগ্রস্ত, অবসাদগ্রস্ত পুরুষ। চিরকাল সে শুধু ব্যর্থ হয়েছে। তার স্কুলের, কলেজের শিক্ষক, অধ্যাপকরা বলেছে, সে ছিল একজন সর্বনিম্নস্তরের ছাত্র। ব্যবসা-বাণিজ্যের জগতে সে ছিল চূড়ান্ত ব্যর্থ। দেউলিয়া হয়ে যাবার সময়ে নানা ছলচাতুরির সুযোগ নিয়ে, এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের অনুদানের সুযোগ নিয়ে সে আবার উঠে দাঁড়িয়েছে।
সে প্রকাশ্যেই নারীদের বিরুদ্ধে অশ্লীল কথা বলে। তার মুখে আটকায় না। কুৎসিত পর্ণোগ্রাফির, নীলছবির তারকারা তার শয্যাসঙ্গিনী। এমনকি, অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরীদের পাচারকারী এক চক্রের সদ্যধৃত এক মার্কিন ধনকুবেরের সঙ্গে তার ওঠাবসা ছিল, এমন অভিযোগও করা হচ্ছে।
এই ব্যক্তি এখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। তার হাতে পরমাণু বোমার সুইচ। পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ক্ষেপণাস্ত্র, গুপ্তচরবৃত্তি এবং রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক তোলপাড় করে দেওয়ার সমস্ত চাবিকাঠি যে দেশটার হাতে, সেই দেশের কোটি কোটি মানুষ তাকে নির্বাচিত করেছে তাদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে।
এর থেকে কী মনে হয়? মনে হয় মানুষ কতটা অজ্ঞ, অন্ধকারাচ্ছন্ন, এবং অশিক্ষিত। কারা তাদেরকে এতটা মগজধোলাই করেছে? করেছে একশ্রেণীর মিডিয়া। করেছে লিবারাল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, প্রতিজ্ঞাভঙ্গতার যুগ। কংগ্রেসের ব্যর্থতার জন্যে আজ ভারতে বিজেপির মতো এক চরমপন্থী, প্রান্তিক শক্তি ক্ষমতার শিখরে। আর এখানে আমেরিকায় ডেমোক্রেটিক পার্টির ক্লিনটন, ওবামা ইত্যাদিদের শাসনে সাধারণ খেটে খাওয়া কোটি কোটি মানুষের মোহভঙ্গ। তার বহিঃপ্রকাশ ট্রাম্পের মতো এক মানবসভ্যতার পক্ষে বিপদজনক, উন্মাদপ্রায় ব্যক্তির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া।
হিটলারও কিন্তু ঠিক এই ধরণেরই আর্থ-সামাজিক অবস্থায় প্রান্তিক, মার্জিনাল এক হাসির খোরাক রাজনীতিক থেকে বিশ্বের ত্রাসের সঞ্চার করা স্বৈরতান্ত্রিক গণহত্যাকারী হিসেবে উঠে এসেছিলো। মানুষ আর ইতিহাস পড়েনা। তাই মানুষ আর ইতিহাস মনে রাখেনি। আবার সেই ফাঁদে পা দিচ্ছে।
ঘৃণার ফাঁদ। হিংসার ফাঁদ। কোনো একটা জাতির, ধর্মের, লিঙ্গের, অথবা মতের মানুষকে বলির পাঁঠা চিহ্নিত করে দেশ ও রাষ্ট্রের সমস্ত ব্যর্থতার দায় তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া। আর অতি ধনিক শ্রেণীকে আরো ধনী, আরো ক্ষমতাবান করে তোলার রাস্তা পরিষ্কার করে দেওয়া।
হিটলার বলির পাঁঠা খাড়া করেছিল ইহুদিদের। ভারতে বিজেপি ও আর এস এস খাড়া করেছে মুসলমানদের, এবং নিম্নবর্গের মানুষদের। ট্রাম্প তার স্কেপগোট– বলির পাঁঠা তৈরি করেছে গরিবের গরিব ইমিগ্রেন্টদের। মেক্সিকোর অর্থনীতি আমেরিকাই ধ্বংস করে দিয়েছে। ল্যাটিন আমেরিকার অর্থনীতি আমেরিকা শেষ করেছে স্বৈরতন্ত্রী শাসকদের ক্ষমতায় বসিয়ে। গণতন্ত্র ধ্বংস করে দিয়েছে সালভাদোর, গুয়াটেমালা, হণ্ডুরাস, নিকারাগুয়া, বলিভিয়া, আর্জেন্টিনা, পেরুতে। সেখানকার মানুষ যখন জীবন বাঁচানোর তাগিদে সবকিছু পিছনে ফেলে শিশুর হাত ধরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমেরিকায় চলে আসছে, তখন তাদের ধরে ধরে জেলে পুরে দেওয়া হচ্ছে। বাচ্চাদের বাবা মায়ের থেকে আলাদা করে খাঁচায় পুরে রাখছে ট্রাম্পের পুলিশ, মিলিটারি, ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্ট। হিটলার যেমন করে ইহুদিদের কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পে খাঁচায় পুরে রেখেছিলো।
বাংলাদেশের ১৯৭১’এর গণহত্যার পিছনে ছিল সি আই এ এবং নিক্সন-কিসিঞ্জারের সরকার। ট্রাম্পের পূর্বসূরি। মানুষ মনে রাখেনি। মানুষ আর ইতিহাস পড়েনা। মিডিয়া তাদের ভুলিয়ে দিয়েছে সবকিছু।
আমেরিকায় যেসব নতুন, প্রগতিশীল, নবপ্রজন্মের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এইসব ভয়াবহ ঘটনা ফাঁস করে দিচ্ছে, তারা এখন ট্রাম্পের নতুন বলির পাঁঠা। তাদেরকে যে কোনো প্রকারে শত্রু চিহ্নিত করতেই হবে। আলেক্সান্ড্রিয়া ওকাসিও কর্টেজ, ইলহান ওমার, রাশিদা ত্লাইব এবং আয়ানা প্রেসলি — মিডিয়ার ভাষায় “দ্য স্কোয়াড”- এখন এই ঘৃণা ও শত্রু চিহ্নিতকরণের শিকার। ট্রাম্প তার বিষাক্ত সোশ্যাল মিডিয়া বার্তায়, টুইটে বলেছেন- তারা যেন “যেখান থেকে এসেছিলো, সেখানেই ফিরে যায়।” অর্থাৎ, তোমরা এখানে থাকতে পারবেনা। আমরা থাকতে দেবোনা।
সোশ্যাল মিডিয়াতে আমাকেও এরকম কথা অনেকবার শুনতে হয়েছে। এগারোই সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলার পরে আমরা যখন রাস্তায় নেমে কাজ করছিলাম মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্যে, তখন বহুবার এসব কথা আমরা শুনেছি। গাড়ির জানলার কাচ নামিয়ে আমাদের মুখের ওপর থুথু ছুঁড়ে দিয়ে চলে গেছে জাতিবিদ্বেষীরা। তাদের নেতা এখন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
মার্কিন কংগ্রেসের হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভ এই সপ্তাহে এক ঐতিহাসিক ভোটে ট্রাম্পের এই রেসিস্ট বার্তাসমূহকে সরকারিভাবে ধিক্কার জানিয়েছে। আসুন, আমরা এই সিদ্ধান্তকে জোরালো সমর্থন জানাই। আসুন, আমরা নবপ্রজন্মের উজ্জ্বল এই নারী ব্যক্তিত্বদের প্রবলভাবে সমর্থন করি।
এই সমর্থন, এই সলিডারিটি পৃথিবীর কোণে কোণে অশুভ শক্তির পরাজয়বার্তা ধ্বনিত করুক। স্বৈরতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ, ধর্মান্ধতা, ঘৃণা ও হিংসার রাজনীতির পতন ঘটুক।
ড. পার্থ ব্যানার্জী,
লেখক ও কলামিস্ট,
নিউ ইয়র্ক ।