এ. জে লাভলু:: মৌলভীবাজারের বড়লেখায় বিনা অপরাধে পৃথক দুটি রাজনৈতিক মামলায় সুরমান আলী নামে এক দিনমজুর পাঁচমাস ধরে জেল খাটছেন বলে অভিযোগ করেছে তার পরিবার। পরিবারের দাবি, সুরমান রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন। কিন্তু বিনা দোষে তিনি দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক মামলায় জেলে রয়েছেন।
এমনকি মামলা দুটির বাদিরাও বলছেন, তারা যে ঘটনায় মামলা করেছেন, সেই ঘটনার সঙ্গে সুরমান জড়িত নন। বরং তারাও এখন সুরমানের মুক্তি চান। দিনমজুর সুরমানকে আসামি করায় স্থানীয় ওয়ার্ড বিএনপির নেতারাও রীতিমতো বিব্রত। তারাও তার মুক্তি চেয়েছেন।
সুরমানের স্বজনদের অভিযোগ, বিগত ইউপি নির্বাচনে পক্ষে কাজ না করায় স্থানীয় এক ব্যক্তি হয়রানির উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে একটি রাজনৈতিক মামলায় সুরমানের নাম ঢুকিয়ে দিয়েছেন। এই মামলায় জামিন পেলেও অন্য একটি মামলায় সন্ধিগ্ধ আসামি তিনি এখন জেলে রয়েছেন। এদিকে সুরমান দীর্ঘদিন ধরে জেলে থাকায় অনাহারে দিন কাটছে স্ত্রী-সন্তানদের। সুরমান বড়লেখা সদর ইউপির মুছেলগুল গ্রামের আমান উদ্দিনের ছেলে।
সুরমানের বাবা আমান উদ্দিন ও মা আনোয়ারা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘তাদের ছেলে সুরমান দিনমজুরি করে সংসার চালান। কোনো রাজনীতির সাথে জড়িত নন। সে কাউকে কোনোদিন হয়রানি করেনি। বরং মানুষের বিপদ-আপদে পাশে দাঁড়ায়।’ তারা বলেন, ‘ইউপি নির্বাচনে পক্ষে কাজ না করায় স্থানীয় এক ব্যক্তি হয়রানি করার জন্য সুরমানের নাম মামলায় ঢুকিয়েছে। তাদের ছেলে জেলে থাকায় তার স্ত্রী-সন্তানরা খুব কষ্টে রয়েছেন। তারা খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন।’
সুরমানের ভাই আবুল হোসেন বলেন, ‘যে মামলায় তার ভাইকে এজাহার নামীয় আসামি করা হয়েছে। সেই মামলার বাদি তাকে চেনেন না। অপর মামলার বাদিও বলছেন তিনি যে ঘটনায় অভিযোগ করেছেন, সেই ঘটনার সঙ্গে আমার ভাই জড়িত নন। তারা লিখিতভাবে বলেছেন যে, তাদের ওপর হামলায় ঘটনায় তিনি জড়িত নন। তারাও এখন আমার ভাইয়ের মুক্তির জন্য বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করছেন।’
ভুক্তভোগী সুরমানের পরিবার, স্থানীয় ও মামলা সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি বিএনপির নেতাকর্মীদের গুম, খুন ও নির্যাতনের প্রতিবাদে কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচি গণহত্যা দিবস ও কালো পতাকা মিছিল চলাকালে বড়লেখা উপজেলা বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের ওপর দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এতে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী আহত হন। ওই সময় যুবদল নেতা নুরুল ইসলাম তাফাদারকে কুপিয়ে গুরতর আহত করা হয়। এ ঘটনার প্রায় ৯ বছর পর ২০২৪ সালের ২৩ আগস্ট বড়লেখা পৌর যুবদলের সহসাংগঠনিক সম্পাদক নুরুল ইসলাম তাফাদার বাদি হয়ে স্থানীয় এমপি ও সাবেক পরিবেশমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনসহ বড়লেখা উপজেলা আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের সংগঠনের ৩৮ জন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে থানায় (জিআর (নং-১০১/২৪ (বড়) মামলা করেন। ওই মামলায় সুরমান আলীকে ২৫ নম্বর আসামি করা হয়। এই মামলায় গত বছরের ২১ নভেম্বর সুরমান আলীকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। প্রায় আড়াই মাস জেল খাটার পর গত ৪ ফেব্রুয়ারি সুরমান হাইকোর্ট থেকে জামিন পান। কিন্তু যেদিন সুরমান জামিন পান; ওইদিনই ফের জেলগেট থেকে ডিবি পুলিশ তাকে আটক করে বড়লেখা থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। পরে পুলিশ তাকে জামায়াতে ইসলামির সহযোগী সংগঠন দক্ষিণভাগ উত্তর ইউনিয়ন যুবকল্যাণ পরিষদের সদস্য অহিদ আহমদের করা (জিআর (নং-১৪৪/২৪ (বড়) মামলায় সন্দিগ্ধ আসামি হিসাবে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠায়। এরপর থেকে কারাগারে দিন কাটছে সুরমানের।
মামলার বাদি যুবদল নেতা নুরুল ইসলাম তাফাদার বলেন, ‘২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি বিএনপির দলীয় কর্মসূচি চলাকালে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তাদের ওপর চালায়। এসময় তাকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করা হয়। এতদিন তিনি এই ঘটনার ন্যায় বিচার পাননি। তবে আওয়ামী লীগের পতনের পর তার ওপর হামলাকারীদের নামে তিনি থানায় মামলা করেছেন। ওই মামলার এক আসামির বাবার নাম জানতে গিয়ে ফয়েজ নামে স্থানীয় এক ব্যক্তির দেওয়া তথ্যে দিনমজুর সুরমানের নাম ঢুকানো হয়েছে। পরে তিনি জানতে পেরেছেন, ইউপি নির্বাচনে ফয়েজের সাথে বিরোধের জেরে তিনি সুরমানের নাম দিয়েছেন। তার ওপর হামলার ঘটনায় সুরমান জড়িত নন। বিষয়টি জানার পর তার জামিনের জন্য সবধরনের সহযোগিতা করেছেন। তার মামলায় সুরমান জামিনও পেয়েছেন। তবে অন্য মামলায় ডিবি পুলিশ তাকে আবার গ্রেপ্তার করেছে।’ তিনি বলেন, ‘তার ওপর হামলায় জড়িত প্রকৃত আসামিদের গ্রেপ্তার করছে না পুলিশ। শুধু নিরীহ মানুষকে গ্রেপ্তার করছে।’
অপর মামলার বাদি অহিদ আহমদ বলেন, ‘তিনি অতীতে অনেক জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন। একারণে কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। তবে যে ঘটনায় তিনি থানায় মামলা করেছেন; সেই ঘটনার সঙ্গে দিনমজুর সুরমান জড়িত নন। মামলার এজাহারেও তার নাম নেই। পুলিশ তার মামলায় অজ্ঞাত আসামি হিসাবে তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে জেলে পাঠিয়েছে। তবে তিনি সুরমানের মুক্তি চান। এজন্য প্রয়োজনে যেকোনো সহযোগিতা তিনি করবেন।’
বড়লেখা সদর ইউপির ৬নং ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘সুরমানকে কোনোদিন রাজনৈতিক কোনো কর্মসূচিতে দেখিনি। সে দিনমজুরি করে পরিবার চালায়। মামলার বাদি নুরুল তাকে জানিয়েছেন, স্থানীয় এক ব্যক্তির দেওয়া ভুল তথ্যের ভিত্তিতে সুরমানকে মামলায় ঢুকানো হয়েছে। তাকে গ্রেপ্তার করায় দলের অনেকেও ক্ষুব্ধ।’ তিনি বলেন, ‘সুরমানের পুরো পরিবার বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত। এজন্য তার পরিবারের কাছে আমার লজ্জিত। ’ তিনি বলেন, ‘পুলিশ নিরীহ মানুষকে গ্রেপ্তার করছে। অথচ কত বড় অপরাধীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। যা দুঃখজনক।’
একই ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আপ্তাব উদ্দিন বলেন, ‘আমার জানামতে সুরমান রাজনীতির সাথে জড়িত নন। বরং তিনি নাগরিক হিসাবে বিএনপির ধানের শীষে ভোট দিয়েছেন। তিনি খুব নিরীহ মানুষ। তাকে কোনোদিন রাজনৈতিক দলের মারামারিতে জড়াতেও দেখিনি। আপনি খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন।’
সাবেক উপজেলা ছাত্রদলের নেতা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘সুরমান আলী তার প্রতিবেশী। উনি দিনমজুর। কোনোদিন কারও ক্ষতি করেননি। তিনি শুনেছেন, স্থানীয় এক ব্যক্তি হয়রানির উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক মামলায় তার নাম ঢুকিয়েছেন। যা দুঃখজনক।’ তিনি বলেন, ‘কত বড় বড় অপরাধীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। অথচ নিরীহ মানুষটা বিনা দোষে জেলে রয়েছেন। তিনি জেলে থাকায় তার পরিবার অনাহারে দিন কাটাচ্ছে।’ তিনি তার পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
এ বিষয়ে বড়লেখা থানার ওসি আবুল কাশেম সরকারের মুঠোফোনে কল করা হলেও তিনি ধরেননি।