লাতু ডেস্ক: সিলেটের দক্ষিণ সুরমায় নাজিরবাজারে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের মরদেহ বুধবার দুপুরে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। নিহতদের পরিবারের আবেদনের প্রেক্ষিতে ময়না তদন্ত ছাড়াই মরদেহগুলো হস্তান্তর করা হয় বলে জানান সিলেটের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ইমরুল হাসান।
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতদের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে ও আহতদের পরিবারে ১০ হাজার টাকা প্রদান করা হয়েছে বলে জানান তিনি। এছাড়া সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আওয়ামী লীগ দলীয় মেয়র প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা করে প্রদান করেন।
বুধবার ভোরে সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের কুতুবপুর এলাকায় বালুবাহি ট্রাক ও যাত্রীবহনকারী পিকআপের সংঘর্ষে এ ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে।
এদকে, দুর্ঘটনায় নিহতদের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। দুর্ঘটনার পর স্থানীয় সূত্রে ১৫ জন মৃত্যুর তথ্য জানা গেলেও পুলিশ ও ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ১৪ জন নিহতের তথ্য জানিয়েছে। দুপুরে এই ১৪ জনের মরনদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
নিহত ১৪ জন হলেন- সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার মো. সিজিল মিয়া (৫৫), একলিম মিয়া (৫৫), হারিছ মিয়া (৬৫), সৌরভ মিয়া (২৭), সাজেদুর (৬০), বাদশা মিয়া (৩০), সাধু মিয়া (৫০), রশিদ মিয়া (৫০) ও মেহের মিয়া (২৫); সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার শাহীন মিয়া (৪০), দুলাল মিয়া (২৬) ও আওলাদ হোসেন (৫০); হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের আমিনা বেগম (৪৫) এবং নেত্রকোনা বারহাট্টার আওলাদ মিয়া (৪০)। এতে আহত হয়েছেন আরো অন্তত ১২ জন। হতাহতদের সকলেই নির্মাণশ্রমিক ছিলেন বলে জানা গেছে।
দুপুরে লাশ হস্তান্তরকালে ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, আহত-নিহতদের স্বজনদের কান্নায় ভারি হয়ে ওঠেছে হাসপাতালের পরিবেশ। হাসপাতালের হিমঘরের পাশে স্বজনদের ভিড় লেগে আছে। মাটিতে গড়াগড়ি করে কাঁদছেন তাদের অনেকে।
হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন নিহত দুলাল মিয়ার ফুপাতো ভাই মো. শাহীন। তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন পাশে থাকা স্বজনরা।
মো. শাহীন জানান, দুলালের বড় ভাই হেলাল আহমদ প্রায় তিন মাস আগে দুর্ঘটনায় মারা যান। তিনি স্ত্রী ও দুই সন্তান রেখে যান। মাসখানেক আগে পরিবারের লোকজন হেলালের স্ত্রী শারমিন বেগমকে (২৫) বিয়ে দেন দুলাল মিয়ার সঙ্গে। বিয়ের দুই সপ্তাহ পর কাজের জন্য সিলেটে আসেন দুলাল। থাকতেন আম্বরখানা সাপ্লাই এলাকার ভাড়া বাসায়।
হিমঘরের পাশে পাশে মাটিতে বসে আহাজহারি করছিলেন মেহের মিয়ার স্ত্রী চাঁদনী বেগম। আহাজারি করে তিনি বলেন, সকালে ডিম রান্না করে দিয়েছিলাম। কিন্তু সে না খেয়েই চলে যায়। এখন আমার বাচ্চাগুলো এতিম হয়ে গেলো। আমি টাকা চাই না। বাচ্চাদের বাবাকে চাই।
কাঁদতে কাঁদতেই চাঁদনী বলেন, গরমে কাল রাতে ঘুম আসছিল না। রাত দুইটার দিকে সে আমারে ডাক দেয়। বলে- তোর জন্য একটা ফ্যান কিনে দেবো। আমারে আ ফ্যান কিনে দিতে পারলো না।
দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও নিহত সাজেদুরের ভাই শের ইসলাম (৫৫)। ভাইকে হারিয়ে আহাজারি করছেন শের ইসলাম। তিনি বলেন, হঠাৎ করে বিপরীতমুখী একটি ট্রাক আমাদের দিকে ছুটে এসে ধাক্কা দেয়। মুহূর্তেই লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় আমাদের সবকিছু।
একই তথ্য জানিয়ে দুর্ঘটনা আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রবিউল ইসলাম বলেন, হঠাৎ বিপরীত দিক থেকে একটি ট্রাক এসে আঘাত করলে আমাদের পিকআপ উল্টে যায়। ট্রাকটি সড়কে তার ডানে চলে এসেছিল। দুর্ঘটনায় আমি আর বাবা আহত হলেও প্রাণে বেঁচে আছি। তবে আমার বড় চাচা আর নেই।
এদিকে দুর্ঘটনার খবর পেয়ে সকালেই ওসমানী হাসপাতালে হতাহতদের দেখতে যান সিলেট সফররত নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী।
আর দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সিলেটের পুলিশ কমিশনার ইলিয়াছ শরীফ বলেন, পিকআপ করে যাত্রী পরিবহন নিষিদ্ধ। তারপরও মহাসড়কে পিকআপে করে যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে। একারণেই এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার যাতে পুণরাবৃত্তি না হয় সে ব্যাপারে আমরা সতর্ক থাকবো।
পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, সিলেট মহানগর থেকে পিকআপে (সিলেট-ন ১১-১৬৪৭) করে প্রায় ৩০ জন নারী-পুরুষ নির্মাণ শ্রমিক জেলার ওসমানীনগর উপজেলার গোয়ালাবাজার যাচ্ছিলেন। সকাল সাড়ে ৫টার দিকে দক্ষিণ সুরমার নাজিরবাজার এলাকার কুতুবপুর নামক স্থানে পৌঁছলে মুনশীগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা সিলেটগামী বালুবাহী ট্রাকের (ঢাকা মেট্রো-ট ১৩-০৭৮০) সঙ্গে শ্রমিক বহনকারী পিকআপের সংঘর্ষ হয়।