দেশ ডেস্ক:: সাত বছরের সংসার জেসমিনের। হঠাৎ ঘটে ছন্দপতন। খোঁজ নিয়ে দেখেন স্বামী অন্য মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছে। স্বামীকে ফিরিয়ে আনার পথ খুঁজতে থাকেন। খবর পান এক কবিরাজের। সব খুলে বলেন তাকে। সমস্যার সহজ সমাধানের আশ্বাস দেন কবিরাজ। তবে দিতে হবে ১০ হাজার টাকা।
স্বামীকে ফেরাতে মরিয়া জেসমিন অনেক কষ্টে সে টাকা দেন। কবিরাজ তাকে দেন তাবিজ। কিন্তু এতে ফল হয়নি কোনো।
নানা কারণ। রোগ-বালাই ছাড়ছে না শিশুকে। কান্নাকাটি করে রাত-দিন। কেউবা অবাধ্য বাবা-মায়ের। অনেকে আবার পাল্টাতে চান ভাগ্য। দ্বারস্থ হন তান্ত্রিক-কবিরাজের। শহর বা গ্রামের দেয়ালে সাঁটানো লোভনীয় বাণীর পোস্টার। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চটকদার বিজ্ঞাপন। লোহা, পিতল, রূপা এমনকি স্বর্ণের মতো দামি ধাতুর তাবিজে দেয়া হয় ভাগ্য বদল ও রোগমুক্তির মন্ত্র। এই সময়ে এসেও বহু মানুষের নির্ভরতা তাবিজে। প্রতারিত হওয়ার তালিকাও দীর্ঘ। বিশেষজ্ঞ আলেমদের অনেকে বলছেন, তাবিজ ব্যবহার বৈধ নয়। এই তাবিজ কাউকে ভালো করতে পারে কিংবা মন্দ করতে পারে এটি বিশ্বাস করাও মারাত্মক ধরনের শিরক।
ফার্মগেটে ছোট দুই মেয়েকে নিয়ে থাকেন শিলা দাস। তার স্বামী সুধির দাস একটি কোম্পানিতে চাকরি করেন। বড় মেয়ের বয়স ৭ বছর। ছোট মেয়ে দুই বছরে পা দিয়েছে। ছোট মেয়ে কথা শুনতে চায়না বাবা-মায়ের। সেইসঙ্গে রাতে না ঘুমিয়ে কান্না করে। শিলা দাস বলেন, এসব একজন সবজি বিক্রেতার কাছে বললে তিনি নিজেই তাবিজ দেন। ১০০ টাকাও নেন। সবজি বিক্রির পাশাপাশি তিনি তাবিজও দেন মানুষকে। ১৫ দিন হলো মেয়ের গলায় তাবিজ দিয়েছি। এখনো কোনো পরিবর্তন দেখতে পাইনি।
আফরিন আক্তার নামে এক নারী বলেন, নড়াইলের একজন কবিরাজ তাবিজ দেয়ার কথা বলে আমার কাছ থেকে তিন লাখ টাকার স্বর্ণ হাতিয়ে নিয়েছে। ফোন দিয়ে আমাকে বলতো তাবিজ দিয়ে কোটিপতি বানিয়ে দেবে। ৭ ধরনের স্বর্ণ আছে তা সব এক স্থানে রাখতে। সেখানে সেই কবিরাজ একটি তাবিজ রেখে দেবে। তার কথামতো আমি ৭ ধরনের স্বর্ণ রেখে আসি। এবং তিনি একটি তাবিজ রেখে যান। পরে তার দেয়া সব নাম্বার বন্ধ করে রাখে। তখন বুঝতে পেরেছি প্রতারিত হয়েছি।
মিরপুর শাহ আলী মাজারের সামনে রহিমা বেগম গলায় লাল সুতা ও বিভিন্ন পুথির মালা পেঁচিয়ে বসে আছেন। হাতে একটা বাঁশি। মাজারে আগতদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে তাবিজ দেন। অনুসারীরা তাকে ঘিরে বসে আছে। কাউকে তাবিজ আবার কাউকে ঝাঁড়ফুঁকের মাধ্যমে বিদায় দিচ্ছেন। রহিমা বেগম বলেন, ২০ বছর ধরে এই কাজ করি। অনেক মানুষের সমস্যার সমাধান করেছি। ২০০ টাকা হাদিয়া ছাড়া কারও কাছ থেকে কোনো টাকা নেই না। বিভিন্ন রোগ ও পারিবারিক সমস্যার জন্য মানুষ বেশি আসে।
আজমিরী খাতুন নামে এক কবিরাজ বলেন, আমি মুন্সীগঞ্জের এক পীরের মুরিদ। কয়েক বছর ধরে জ্বিনের মাধ্যমে রোগী দেখি। অনেক মানুষ ভালো হচ্ছে। অনেকের সমস্যার সমাধান হয়েছে। একজন মহিলা প্যারালাইজ্ড রোগে ৬ মাস ধরে ভুগছিল। তাকে ১৫ দিন ধরে জ্বিনের মাধ্যমে চিকিৎসা দিচ্ছি। এখন উঠে বসতে পারে। প্রথমে ৩ হাজার টাকা বকশিস নেই এবং রোগ বুঝে টাকা নেয়া হয়। তারপর তেল ও অন্যান্য জিনিসে তাবিজের কাজ করি। রোগীর সমস্যার সমাধান হয়।
এ ব্যাপারে প্রখ্যাত আলেম মাওলানা ফরীদ উদ্দিন মাসঊদ বলেন, তাবিজকে যদি কেউ ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করে তা জায়েজ। তবে তাবিজকে যদি কেউ সবকিছু মনে করে তা জায়েজ নেই।
জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সিনিয়র পেশ ইমাম মুফতি মিজানুর রহমান বলেন, তাবিজ এবং ঝাঁড়ফুঁক এই দুই ধরনের পার্ট আছে। ইসলামে ঝাঁড়ফুঁক হলো দোয়া কালাম পড়ে পানিতে ও শরীরে ফুঁ দেয়া। এই ঝাঁড়ফুঁক হাদিসের দ্বারা প্রমাণিত। এটি বৈধ এবং এই নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। তবে তাবিজ নিয়ে ভিন্নমত আছে, বেশিরভাগ আলেম বলেন, এটি মোটেই ঠিক না। আমাদের উপমহাদেশের ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের কিছু স্কলাররা বলেন, কোরআনের আয়াত বা হাদিসে বর্ণিত যেকোনো দোয়ার মাধ্যমে দেয়া হলে সেটি বৈধ। কিন্তু হাদিসে তাবিজ হিসেবে যে শব্দটি এসেছে সেটি স্পষ্টভাবে কোরআনে সম্পূর্ণ নিষেধ। এ বিষয়ে সরাসরি কোরআন বা হাদিসের বক্তব্য যদি সামনে নিয়ে আসি তাহলে কিন্তু এইখানে আর বৈধ বলার সুযোগ থাকে না। কোরআনের আয়াত সম্বলিত তাবিজ ব্যবহারে অসম্মান বা অমর্যাদা হয়। তখন কোরআনের আয়াতের প্রতিও যথাযথ সম্মান নষ্ট হয়। এই তাবিজ কাউকে ভালো করতে পারে কিংবা মন্দ করতে পারে এটি বিশ্বাস করাও মারাত্মক ধরনের শিরক। কেউ যদি জানতে পারে তাবিজ ব্যবহার করা অন্যায়, তবুও ব্যবহার করছে তাহলে সেই শিরক থেকে তওবা না করা পর্যন্ত সে ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে না। তিনি আরও বলেন, সর্বপ্রথম আল্লাহর বিধানকে গুরুত্ব সহকারে মানা এটি মানুষের দ্বায়িত্ব এবং কর্তব্য। যদি এটি কোনো পেশা বা ব্যবসার জন্য হয় তাহলে সে বিষয়ে মানুষকে সতর্ক হতে হবে। এবং যারা এটি করেন তাদেরকেও আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার ভয় থাকা উচিত। ঝাঁড়ফুঁক এবং ব্যক্তিগত জীবনে কিছু আমল আছে এগুলোর উপরে বিশ্বাস এবং আস্থা রাখা উচিত। এটিই হলো একজন মুমিনের কর্তব্য। কোরআনের সবচেয়ে দামি এবং গুরুত্বপূর্ণ সূরা ফাতিহা। জ্বীনদেরকে এই কাজে ব্যবহার করার কোনো সুযোগ নেই। এটি কবিরাজদের দাবি হতে পারে। এটি মোটেই সঠিক কাজ নয়।
খ্যাতিমান আলেম শায়খ আহমাদুল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেন, রোগ থেকে আরোগ্য লাভের জন্য সাধারণ ওষুধের পাশাপাশি পবিত্র কোরআনের আয়াত এবং হাদিসে বর্ণিত দোয়া পাঠ করে রোগীর ওপর ফুঁ দেয়া এবং বিভিন্নভাবে এগুলো পাঠ করার মাধ্যমে ট্রিটমেন্ট করার বিষয়টি কোরআন-হাদিস দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত। কিন্তু কোরআন করিমের কোনো আয়াত বা দোয়াকে লিখে মানুষের শরীরে ঝুলিয়ে রাখা বা ধারণ করা এ বিষয়টি সেভাবে প্রমাণিত হয়নি।
গোপালগঞ্জের ভবানীপুর মাদ্রাসার প্রধান মুফতি মাসউদুর রহমান বলেন, তাবিজ-কবচ মানুষ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহার করে। শরীয়তের সঙ্গে এই তাবিজের কোনো সম্পর্ক নেই। বরং শরীয়াতে তাবিজ সম্পর্কে নিষেধাজ্ঞা আছে। যদি এটি কেউ বিশ্বাস করে ব্যবহার করে তাহলে আমরা বলবো সে আল্লাহর ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে তাবিজে আস্থা স্থাপন করলো। জাহিলিয়া যুগেও এটি ছিল।
হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, প্রতিটি রোগ হয় একটি বা একাধিক সুনির্দিষ্ট কারণ থেকে। রোগের চিকিৎসা হচ্ছে সেই কারণটিকে দূর করা বা দমিয়ে রাখা। এবং রোগের কারণে সৃষ্ট যে লক্ষণগুলো মানুষের শরীরে দেখা দেয় সেগুলোকে নিয়ণন্ত্রিত রাখা। এই কারণে ঔষধ, থেরাপিসহ নানা যাতীয় পদ্ধতির উদ্ভাবন হয়েছে। এগুলো হচ্ছে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের একটি অবদান। কিছু লোক রোগীর চিকিৎসার জন্য তাবিজ-কবচ ইত্যাদি ব্যবহার করে। এটি পৃথিবীর সব জনগোষ্ঠীর মধ্যে দেখা যায়। সে জনগোষ্ঠী এক্ষেত্রে তাদের ঢাল হিসেবে ধর্মকে ব্যবহার করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই তাবিজের সঙ্গে রোগ নিরাময়ের ন্যূনতম কোনো সম্পর্ক বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এটি হচ্ছে কুসস্কার বা অপ-সস্কার। তাবিজ ব্যবহারকারীরা অপসস্কার এবং কুসস্কারকে আশ্রয় দেয়া মানে অগ্রগতির ধারা থেকে মানুষের আরও পিছিয়ে যাওয়া।
সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, মানুষকে সময়ের সঙ্গে সচেতন হতে হবে এবং বিজ্ঞানসম্মত উন্নত চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। আমাদের স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের একটি বড় ভূমিকা আছে তারা এলাকার সবাইকে এই ব্যাপারে সচেতন করবেন। এলাকায় এই ধরনের কোনো ভণ্ড কবিরাজ, ওঝা থাকলে তাদের নিবৃত করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। রাষ্ট্র, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, সিভিল সোসাইটির অনেক করণীয় আছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো নিষ্ক্রিয় বলে প্রতারক চক্র সক্রিয় হয়েছে। সূত্র : মানবজমিন