মুহাম্মদ রহিম :: করোনা পজেটিভ ছিলো। আল্লাহর অশেষ রহমতে জীবন ফিরে পেয়েছি। সুস্থ হয়ে ওঠছি। আইসোলেশনের দশ দিন কেটেছে দুশ্চিন্তা ও দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে।
আসলে কোভিড আক্রান্ত হবো-এটা যেন আগেই জানাই ছিলো। আমার স্ত্রী ২৫ ডিসেম্বর থেকে অসুস্থ্যতাবোধ করেন । উনার করোনার উপসর্গ ছিলো তাই ৩০ ডিসেম্বর আমরা দু’জনই টেস্ট করতে যাই। ৩১ ডিসেম্বর সকালে এনএইচএস থেকে ইমেইলে অবহিত করা হয় যে, আমরা দু’জনেরই করোনা পজিটিভ । বলা হয় কমপক্ষে দশদিন আমাদেরকে সেল্ফ কোয়ারিনটিনে থাকতে হবে।
করোনা টেস্টের রিজাল্ট আমাকে তেমন বিচলিত করেনি । টেস্ট রিজাল্ট পাওয়ার কিছুক্ষন পর স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার তো কোনো ডিফ্রেন্ট অনুভূতি লক্ষ্য করছিনা। তুমি কি বিচলিত নও, ভয় হচ্ছেনা? । বল্লাম, করোনার জন্যে প্রস্তুত ছিলাম । আগে থেকেই বুঝতে পেরেছি করোনা আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে। বিচলিত নয় এ কারণে যে, প্রথমতঃ ভাগ্যে বিশ্বাস করি। যদি মৃত্যু লিখাই থাকে তবে সেটাই হবে। দ্বিতীয়তঃ এর আগেও আমি কিছু রোগে ভুগছিলাম। রয়েল লন্ডন হসপিটালে আইসোলেশনে ছিলাম । ঝড় একবার বয়ে গেলে বুঝা যায় দ্বিতীয়বার এর ভয়াবহতা কতটুকু হতে পারে।
শুরু হলো করোনা থেকে মুক্তি প্রস্তুতি। আমাদের ৫জনের সংসার। দুজনই অসুস্থ। কেমন করে বাচ্চাদের আলাদা রাখি। কোনোক্রমেই ওদেরকে দুরে রাখা সম্ভব নয়। বড় সন্তান আমিলিয়ার বয়স ৭। সে আমাদের কথা-বার্তা থেকে করোনাকালীন সময়ে করনীয় ও বর্জনীয় বিষয়গুলো বুঝে ফেলেছে। সাথে সাথে তিনটি কাগজে লিখলো, ‘ইউ আর নট এলাউড ইন দিজ রুম ফর টেন ডেইজ বিকজ অব করোনা ভাইরাস’। এরপর কাগজগুলো বেড রুম ও লিভিং রুমের দরজায় লাগিয়ে দিলো। তার এই সতর্কতা দেখে অবাক হয়েছি, এ বয়সে যে সে এতটুকু বুঝতে পারবে আমি এটা ভাবতেও পারিনি।
স্ত্রীর অবস্থা খারাপ হতে লাগলো । প্রথম অবস্থায় মাথা ও শরীরে ব্যথা, সর্দি, নাক বন্ধ । দু-তিন দিন পর নাকে কোনো গন্ধ অনুভব করতে পারলেন না ও সাথে খাবারের স্বাদ চলে গেলো এবং শুরু হলো বমি । উনার অবস্থা এমনটা হয়েছিলো যে কিছু জিজ্ঞেস করলেও উনি উত্তর দিতে পারতেন না। আমাদের বিয়ের দশ বছরের মধ্যে উনাকে কোনোদিন এতো অসুস্থ দেখিনি। কিন্তু আমি তখনো অনেকটা ভালো। উনি একরুমে আইসোলেশনে আর আমি বাচ্চাদের নিয়ে অন্যরুমে। প্রথম রাত ওরা আমার সাথে আইসোলেশনে থাকলো, কিন্তু দ্বিতীয় রাতে ওরা ঘুম থেকে উঠে মায়ের কাছে চলে গেলো। এভাবেই চলতে থাকলো । চার-পাঁচদিন পর আমার স্ত্রী কিছুটা সুস্থ্য হলেন কিন্তু আমি বেশি অসুস্থ্য বোধ করতে লাগলাম । শুরু হয়েছিলো হালকা কাশি দিয়ে, আস্তে আস্তে নাক থেকে গন্ধ ও স্বাদ চলে গেলো। এভাবে তিন-চার দিন যাবার পর শুরু হলো প্রচন্ড রকমের কাঁশি, সাথে শ্বাস কষ্ট। কাশতে-কাশতে সারা শরীরে ব্যথা হয়ে গেছে। এমন জোরে জোরে কাঁশি, মনে হতো পুরো হৃদপিন্ডই বেরিয়ে আসবে।
কাশি যাহাই হোক শ্বাস-কষ্টটা সামাল দেয়া অনেক কষ্টের। কোনো সময় মনে হতো শ্বাসটা আটকে গেছে। এভাবে দু’এক রাত পের করে নিরুপায় হয়ে জিপিকে ফোন দেই। ডাঃ জোলিয়া অনেক্ষণ আমার কথা শুনলেন আর সাথে সাথে নোট লিখলেন। ১৫/২০ মিনিট পর উনি সিদ্ধান্তে উপনিত হলেন এই বলে যে, খুব সম্ভবত আপনার চেস্ট ইনফেনশন হয়েছে আমি আপনাকে এন্টিবায়োটিক দিচ্ছি। উনি বললেন, আমি কি মেডিসিন বাসায় পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করবো না আপনি কাউকে দিয়ে কালেকশন করাতে পারবেন? আমি বললাম, অসুবিধে নেই আমার ফ্রেন্ড কালেক্ট করবে। এন্টিবায়োটিক খাওয়া শুরু হলো, প্রথমে হাই ডোজ দিয়ে। না কিছুই হলোনা, কাশি আর শ্বাস কষ্টের কারণে বালিশে মাথা রাখাই যায়না। একরাতে এমন মনে হয়েছিল হয়তোবা শ্বাসটা আটকেই যাবে। ইমারজেন্সিতে ফোন দিতে চেয়েও ফোন দেইনি। এ অবস্থায় আসলে কেউই হসপিটালে যেতে চায়না। শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় অনেকবার বিছানা থেকে উঠে দৌড়ে বেলকনিতে গিয়ে শ্বাস নেয়ার চেষ্টা করেছি। নাক দিয়ে গরম পানির ষ্ট্রিম নিলে খানিকটা ভালো লাগতো এজন্যে রোজ কমপক্ষে দশ থেকে পনের বার ষ্ট্রিম নিতাম।
যাক, এন্টিবায়োটিক খাওয়ার দু’দিন পর কাশি একটু কমতে লাগলো। এরপর থেকে একদিন একটু ভালো- পরের দিন একটু খারাপ। এভাবে করে মঙ্গলবার সরকারের বেঁধে দেয়া আইসোলেশনের দশদিন পার হয়েছে। বুধবার থেকে নিজেকে অনেকটা সুস্থ্ মনে হচ্ছে। আমাদের এ কঠিন সময়ে আমার পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও কলিগরা পাশে দাঁড়িয়েছেন। আমি বুঝতে পেরেছি মানুষ আমাদের কতটুকু ভালোবাসে। মানুষের এ ভালোবাসা নতুন করে এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকার স্বপ্ন যুগিয়েছে। এ পৃথিবী অনেক সুন্দর।
লেখক: মুহাম্মদ রহিম
লন্ডন, যুক্তরাজ্য