প্রশান্ত কুমার :: হামহাম ঝর্ণা সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না। প্রথম যখন নামটা দেখলাম তখন মনে হলো বিসিএসের জন্য এই নামটা কোথাও পড়ে থাকবো। আবার মনে হচ্ছিল এটা সৌদি আরবে কি-না। কারণ জমজমের সাথে নামের দিক থেকে হামহামের বেশ মিল আছে। ট্যুরের জন্য যখন ফাইনালি বাসে উঠেছি তখন একবার চেক ইন দিয়ে একটা পোস্ট করতে চেয়েছিলাম। খুঁজেই পেলাম না। হয়তো বানান ভুলের কারণেও এমন হতে পারে। ইংরেজিতে হামহামের বানান, Humhum, এটাকে হুমহুম বা হুমহাম বা হামহুম বা হামহাম বহুভাবে উচ্চারণ করা যায়। তবে, হামহামই মনে হয় সঠিক। ওখানকার নেটিভরা সেরকমই উচ্চারণ করে।
হামহাম ট্রাকিং এ যাওয়ার জন্য ফেসবুকে একটা পোস্ট চোখে পড়ে। আমার যাওয়ার আগ্রহ এবং কৌতূহল কোনোটাই ছিল না। জাস্ট একটা কমেন্ট করতে হয় তাই করেছিলাম। বলেছিলাম, যে কেউ আলাউড?? পোস্টদাতা বললেন ট্রেলটা একটু কঠিন হবে। আমার একটু ইগোতে লাগলো। বাংলাদেশে কী এমন পাহাড় আছে যে সেখানে চড়তে পারবো না। মনে মনে চ্যালেঞ্জটা নিলাম। এর মধ্যে একবার ডেট পিছাইলো। তবু মেনে নিলাম। অনেক প্রতিকূলতা সত্বেও ট্রেলটাতে অংশ নেয়ার জন্য একটু আগ্রহী হয়ে উঠেছিলাম। এর আরও একটি কারণ আছে। কয়েকদিন ধরেই ভাবছিলাম জীবনে এডভেঞ্চার নেই। কিছু এডভেঞ্চার দরকার। কিন্তু সব এডভেঞ্চারে মন সাড়া দিচ্ছিল না। যেমন নদী বা সমুদ্র রিলেটেড কোনো এডভেঞ্চারের প্রতি মোহ নেই কারণ জল এবং জলের ঢেউয়ে প্রচুর ভয় পাই। নদ নদী আর সাগর বাদ দিলে দেশের সীমার মধ্যে যেটা থাকে সেটা হল পাহাড়। এবং এই পাহাড়কেও যদি বাদ দিই তাহলে আর থাকে কী? মানুষ কি সমতলে হামাগুড়ি দিয়ে এডভেঞ্চার করবে?
রাজি হয়ে গেলাম। রাজি হওয়ার আরেকটা কারণ এখানে সবাই অপরিচিত। ফেসবুকে একজনের সাথে মাত্র পরিচয় ছিল। তাও ওই লাইক-কমেন্টের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এর চেয়ে বেশি চিনতাম না। অপরিচিতদের সাথে ঘুরতে যাওয়া নিশ্চয় আনন্দদায়ক।
ঢাকা থেকে মৌলভীবাজার পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব যার উপর ছিল তিনি তাহমিনা আপু। আমাদের সতেরো জনের ট্যুর গ্রুপের একমাত্র নারী সদস্য এবং সমস্ত ট্যুরের তিনি একজন লিডার, অন্যতম লিডার। সবাইকে ফোন করে অর্গানাইজ করার দারুণ ক্ষমতা আছে তাঁর। উত্তরা থেকে হামহাম পর্যন্ত এবং ফিরে আসার সময় আবার উত্তরা পর্যন্ত তিনি দারুণ গাইড করেছেন।
পাহাড়ে হাঁটার অভিজ্ঞতা ছিল না; কিন্তু উৎসাহ ছিল। ভয়ের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর ছিল চীনা জোঁক। এগুলো খুবই ক্ষুদ্রাকৃতির। কিন্তু রক্ত চুষে খায়। তার চেয়ে ভয়ঙ্কর এই জোঁকগুলো পা দিয়ে কোমর পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যেকোন পয়েন্টে ঢুকে মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। দুই একজনের মুখে সেরকম গল্প শুনেছি। এবং সেজন্য আমাদের গ্রুপের অভিজ্ঞরা আগে থেকেই সাবধান করে দিলেন কেউ যেন কোথাও না থামে। অল্প গতিতে হলেও হাঁটতে হবে। থামলেই জোঁকে ধরতে পারে। আমি বড় মোজা পরে নিয়েছিলাম এবং ট্রাউজারের নিচের অংশ মোজার মধ্যে এমনভাবে ঢুকিয়ে রেখেছিলাম যাতে জোঁক কেন জোঁকের বাপও কিছু করতে পারবে না। জোঁকের প্রতি ভয় কমই ছিল। সামান্য কয়েকটা জোঁক আর কতটুকুই বা রক্ত খাবে? কিন্তু ভয় হচ্ছিল ওগুলো যদি শরীরের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট দিয়ে ঢুকে যায়। এবং সেজন্য সমস্ত ট্রেকিংটাতে মনে হচ্ছিল আমার শরীরের কোন না কোন পয়েন্ট দিয়ে নিশ্চয় কিছু ঢুকে যাচ্ছে। আরও ভয়ের ব্যাপার হল পয়েন্টগুলো চেক দিতেও পারছি না। লোকজনের সামনে লজ্জা পাব বলেই শুধু না। চেক দেয়ার সময় যদি একটা জোঁক লাফ দিয়ে ওসব জায়গায় ঢুকে যায়। সমস্ত ট্রেকিংটা এভাবে সন্দেহবাতিগ্রস্ত হয়ে কাটিয়েছি।
টানা দুই ঘন্টা উঁচুনিচু পাহাড়, পিচ্ছিল পথ এবং সংকীর্ণ পথের দুই ধারে ভয়ঙ্কর খাদের মধ্যে দিয়ে হেঁটে হেঁটে একটা পর্বতচূড়া পেলাম। সেখান থেকে ভারতের সীমানা দেখা যায়। আর ঝর্ণার শব্দ শোনা যায়। ওখানে একটু রেস্ট নেয়ার এবং আমাদের সাথে যারা একটু পেছনে পড়ে গিয়েছিল তাদের জন্য একটু ওয়েট করা দরকার ছিল। এবং ওখানে সেই ভয়ঙ্কর মশা দেখলাম। ভয় পাচ্ছিলাম এগুলো এনফিলিস কিনা। তবে একজন বলল, এই মশার কামড়ে ম্যালেরিয়া হয় না। তখন একটু স্বস্তি পেলাম। এরপর সবাই এলে একসাথে খাড়া এবং পিচ্ছিল ঢাল বেয়ে নামতে থাকলাম। এটা এমন ঢাল এবং পিচ্ছিল যে একটু অসতর্ক হলেই গড়াতে গড়াতে নিচে পড়ে যেতে হবে। আমি মনে মনে বাঙলা ফিল্মের সিঁড়ি দিয়ে পড়ে যাওয়া কল্পনা করছিলাম আর হাতের লাঠিটা সামনে দিয়ে একটু একটু করে নিচে নামছিলাম।
নিচে নেমে গিরিপথ। সেই পুরাতন পাথর আর শীতল জলের গিরিপথ যা হামহাম ঝর্ণা থেকে বয়ে এসেছে। নিচে নেমে ঝর্ণার দিকে এগোতে থাকলাম। আমাদের আগেই বলে দেয়া হয়েছিল আমরা যেন ভুল করেও গাইডের আগে উঠে না যায় এমনকি পিছনেও যেন না পড়ে যায়। কিন্তু কে শোনে কার কথা। ঝর্ণার দিকে এগোতে থাকলাম। পাথরে বেঁধে পড়েও গেলাম কয়েকবার। তারপর ঝর্ণার কাছে এলে সব কষ্ট ভুলে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইলাম। কিন্তু কাছে ফোন ছিল এবং গ্রুপের সব সদস্য না এলে পানিতে নামলাম না। এর পরে শুধু উল্লাস। ঝর্ণার শীতল জল একটানা পড়েই যাচ্ছে। কারো জন্য অপেক্ষা করার তাড়া নেই তার। কেউ ভিজলেও পড়ছে না ভিজলেও পড়ছে। এমনকি তাকে দেখার কেউ না থাকলেও সে তার দায়িত্ব অবহেলা করছে না। এটা নিশ্চয় একটা প্রাকৃতিক উৎসব।
ফটোসেশন করে আবার ফিরে আসতে হবে। অনেক আনন্দ পেয়েছি। কিন্তু ভয় ছিলই। ফেরার পথে খাড়া ঢাল বেয়ে উঠতে হল। কত ফুট জানি না। কিন্তু কোন থামাথামি নেই। একটানা বেয়ে উপরে উঠেই শরীর ছেড়ে দিল। মনে হতে লাগলো আর ফিরে যেতে পারবো না। তারপর কিছু স্ন্যাকস, স্যালাইন খেয়ে আবার যাত্রা শুরু করলাম। আসার পথে কয়েকজনের জোঁকে ধরেছিল। আর কয়েকজনের ধরেনি কিন্তু তারা আতঙ্কে ছিল। পাহাড় থেকে নেমে এসে অনেকে তাদের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো চেক করতে লাগলো।
হামহাম থেকে মৌলভীবাজার ফেরার পথে মাধবপুর টি এস্টেটে ঢুকলাম। সেখানে একটা সুন্দর লেক আছে। ওটাতে নেমে একটু সাঁতার কাটলাম। ফেরার পথে বৃষ্টি ছিল যা আমাদের ভালোলাগাতে আরও কিছু যোগ করেছে।
ট্যুরমেটদের মধ্যে রিপন দে দাদাকে ধন্যবাদ না দিলেই হয় না। তিনি একজন দারুণ ট্রেকার। নিঃস্বার্থ সদা হাস্যোজ্বল মানুষটি ঘুরতে পছন্দ করেন। পরিবেশ সচেতন। পাহাড়ে আমরা যেন কোন বোতল, কোনো পলিথিনের পেপার, প্যাকেট না ফেলি তার জন্য তিনি আগে থেকেই অনেক অনুরোধ করে বলেছিলেন। ট্যুরমেটদের সবাইকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ দিই। এসব ট্যুরে পরিচিত অপরিচিত কোন কথা নেই। একজন আরেকজনকে যথেষ্ট সাহায্য করে। আর সবচেয়ে বেশি ধন্যবাদ দিতে চাই বিমান দাকে। তার পোস্টের কারণেই এই ট্যুরটাতে অংশগ্রহণ করতে পেরেছি। তিনি শরীরে জ্বর স্বত্বেও আমাদের সাথে ট্রেকিং করেছেন।
পুনশ্চ: ট্যুর গ্রুপটার নাম “বাঙ্গাল: bangal travellers“। ফেসবুকে আছে। ভ্রমনপিপাসুরা এড হতে পারেন।
যেভাবে যাবেন:
ঢাকা থেকে বাসে বা ট্রেনে মৌলভীবাজার, কমলগঞ্জ বা শ্রীমঙ্গল। সেখান থেকে জীপ বা সিএনজি অটোরিক্সা করে কলাবন। কলাবন থেকে গাইড নিয়ে রাজকান্দী রিজার্ভ ফরেস্টের ভেতর দিয়ে ২ ঘন্টা হাটলেই পেয়ে যাবেন হামহাম ঝর্ণা।
লেখক: প্রভাষক, সরকারি বরহামগঞ্জ কলেজ, মাদারীপুর।