মুনজের আহমেদ চৌধুরী :: ব্রেক্সিটকে ঘিরে ব্রিটেনের রাজনৈতিক আকাশে অস্থিরতা ক্রমেই বাড়ছে। প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে সরে যাবার পর এখন তাঁর স্থলাভিষিক্ত কে হবেন নতুন প্রধানমন্ত্রী, সে লড়াইয়ের প্রথম দিন ছিল গতকাল বৃহস্পতিবার।
সে লড়াইয়ে বিশাল ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন লন্ডনের সাবেক মেয়র বরিস জনসন। বরিস ১১৪ ভোট পেয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জেরেমী হান্ট পেয়েছেন মাত্র ৪৩ ভোট। তৃতীয় স্থানে থাকা মাইকেল গোভ পেয়েছেন মাত্র ৩৪ টি ভোট। একমাত্র এশিয়ান পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত সাজিদ জাভিদ কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেই উফে আসতে পারেননি।
তিন জন প্রার্থী বাদ পড়েছেন প্রধানমন্ত্রীত্বের দৌড় থেকে বৃহস্পতিবারের এ লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে। এ লড়াইয়ে বরিস জনসন বিশাল ব্যবধানে এগিয়ে থাকার খবরে দলীয় সমর্থন নির্বিশেষে বহু মানুষ হতাশ হয়েছেন।
ব্রেক্সিট ইস্যুতে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিট ক্যামেরন যখন গনভোটের ডাক দিলেন, তখনই সাধারণ ব্রিটিশ জনগণের চোখে ভোল পাল্টানো এক চরিত্র হিসেবে মোটাদাগে আভিভূর্ত হন বরিস। সে নির্বাচনের ফলাফলের প্রেক্ষিতে ডেভিট ক্যামেরন পদত্যাগ করেন। সে সময়ও প্রধানমন্ত্রী হতে উৎগ্রীব ছিলেন ক্যামেরনেরই ছেলেবেলার বন্ধু বরিস। এরপর থেরেসা মের সরকার ফেলে দেবার, থেরেসার মের সরকারকে বিপদে ফেলবার মতো যত মন্ত্রীসভার সদস্যদের ধারাবাহিক পদত্যাগের ঘটনা ঘটেছে পেছনের কলকাঠি নাড়াঁদের নেপথ্যের নায়ক ছিলেন ৫৪ বছর বয়সী রাজনীতিবিদ বরিস জনসন।
এখন পর্যন্ত পরিস্থিতির বিচারে ক্ষমতাশীন দলের পার্টির নেতা নির্বাচিত হয়েই পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীত্বের দৌড়ে বরিসই এগিয়ে, সেটাই এখনকার বাস্তবতা। দলের ভোটে জিতে তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন। সে সুযোগ ব্রিটেনের গনতান্ত্রিক আইনে বিদ্যমান। কিন্তু ব্রেক্সিট প্রশ্নে বার বার নিজের অবস্থান পাল্টানো বরিসের দেশের সাধারণ মানুষের কাছে ভাবমুর্তির সংকট রয়েছে। তিন বছর আগের বরিসের ভাবমুর্তি আর জনপ্রিয়তা তার ভোলবদল আর ক্ষমতালিপ্সুতায় তলানীতে ঠেকেছে তার বিভিন্ন হটকারী কর্মকান্ডে-এমনটিই বলছেন তার সমালোচক সহ ব্রিটেনের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বরিস জনগণের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ইতিমধ্যেই তার সাফল্য কামনা করেছেন। জন্মসুত্রে মার্কিন নাগরিক বরিসই কী তবে হচ্ছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন? যে ব্রিটিশ চেতনা ও ব্রিটিশ জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে ইউরোপ ছাড়তে কাংঙ্খিত ব্রেক্সিটের পক্ষে রায় দিয়েছিলেন ব্রিটিশ জনগণ, বরিস জনসনের পক্ষে তার কতটুকু পুরন করা সম্ভব হবে সেটা নিয়ে আলোচনা চলমান থাকবে আরো কিছুদিন।
কেননা, লন্ডনের মেয়র থাকাবস্থায় লন্ডনকে সাধারণ মানুষের জন্য আন-এফোর্ডেবল করে তুলেছিলেন বরিস, এ অভিযোগ তার সমালোচকদের। লন্ডনের মেয়র থাকাবস্থায় একটি সাক্ষাতকারে বরিস ১৭ বার বলেছিলেন, তিনি আর সংসদ সদস্য পদে দাড়াবেন না। এর একমাস পরই তিনি অক্সব্রীজ এলাকা থেকে এমপি নির্বাচন করে জয়ী হন।
২০১৬’র ২৩ জুন ব্রিটিশরা ব্রেক্সিটের পক্ষে গনভোট দিয়েছিল। এখন পুরো দেশের মানুষের ভাবনা পাল্টে গেছে। এখনকার বাস্তবতা হলো, এবার গনভোট হলে ব্রেক্সিটের বিপক্ষেই ভোট দেবে ব্রিটিশরা। ২৩ শে জুনের সে নির্বাচনের আগে হঠাৎ ভোল পাল্টে লাল বাসে করে লীভের পক্ষে ক্যাম্পেইন চালিয়ে ব্রিটেনকে বিভক্ত করতে সমর্থ হয়েছিলেন বরিস। এর ফলাফলে ডেভিট ক্যামেরনকে পদত্যাগ করে স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে কয়েক ঘন্টার মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ছাড়তে হয়েছিল।
এরপর থেরেসার মন্ত্রীসভায় ফরেন সেক্রেটারী হন বরিস। আর প্রধানমন্ত্রী হয়ে থেরেসা মে তার প্রথম রাজনৈতিক ভুলটি করেন প্রতিদ্বন্দ্বি লেবার পার্টি আর লেবার লিডার জেরমী করবিনকে রাজনৈতিকভাবে তাচ্ছিল্য করে আরেকটি নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ ছুড়েঁ। কার্যত থেরেসা এটি করেছিলেন জনগণের আস্থা অর্জনের মধ্য দিয়ে পুর্বসুরী আয়রন লেডী মার্গারেট থ্যাচারের মতো শক্তিমান নেতা হিসেবে নিজের অভ্যুদয়ের সপ্ন নিয়ে। আর সুযোগটি নিতে কাল বিলম্ব করেন নি বরিস। এরপর থেকে থেরেসার সরকারকে অস্থিতিশীল করতে সরকারে থেকে পরে সরকার ছেড়ে যা যা করার সবই বরিস করেছেন।
গত দুই দশকে বরিসের মতো নেতৃত্ব হাতে পাবার জন্য ঘন ঘন অবস্থান আর আগের বক্তব্য পাল্টে মরিয়া কসরৎ করতে আর কোন সমপর্যায়ের নেতাকে মধ্যে দেখেনি ব্রিটেন। বাহ্যত পলিটিক্যাল এন্টারটেইনার রাজনীতির ময়দানে সময় সময়ে কৌতুকের আনন্দ দিলেও সময় বুঝে কৌশলের ক্যারিশমা দেখাতে সিদ্বহস্ত এ সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ। মনে রাখা সমীচিন, ব্রিটেনের জীবিত রাজনীতিবিদদের মধ্যে বরিসই সেই ব্যাক্তি তার জনপ্রিয়তার পারদ ওঠা নামা দুটোই করে। আর ব্রিটেনের রাজনীতির যে অদৃশ্যমান শক্তিটি লেবার পার্টি লিডার জেরেমি করবিনকে অপছন্দ করে, সে শক্তিটির পছন্দের প্রিয়পাত্র হলেন বরিস।
এর মধ্যেই গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম দফায় বরিস এগিয়ে গেলেন প্রধানমন্ত্রীত্বের দৌড়ে। অবশ্য এ নির্বাচনী লড়াইয়ে পরাজিত প্রার্থীরা এখন সমন্বিতভাবে বরিসের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হবার কথা ভাবছেন। সেটি তারা করতে পারেন কতটা সেটিই এখন দেখবার বিষয়।
সদ্য সমাপ্ত ইইউ নির্বাচনে কনজারভেটিভ, লেবার, লিবডেম, গ্রীন পার্টির মতো মুলধারার রাজনৈতিক দলকে পেছনে ফেলে চমক দেখিয়েছে প্রবল ডানপন্থী ও প্রবল বিতর্কিত নাইজেল ফারাজের ছয় সপ্তাহ বয়সী দল ব্রেক্সিট পার্টি।
ইউরোপের অন্য দেশগুলোতেও জনপ্রিয় লোকরঞ্জনবাদী, অভিবাসন বিদ্বেষী যে প্রবল ডানপন্থী ধারার উত্থান ঘটেছে। তার ধারাবাহিকতায় গত ইইউ নির্বাচনের ফলাফল ব্রিটেনকে নতুন একটি বার্তা দিয়েছে। আর সেটি হল, ব্রিটেনের বৃহত্তম ডানপন্থী দল ক্ষমতাশীন কনজারভেটিভ পার্টি ক্ষমতায় থেকেও জনগনের প্রত্যাশা পুরন করতে পারছে না। ব্রিটিশ জনগন ঝুকঁছেন আরো উগ্র ডানধারায়। লেবার পার্টিও পারছে না। করবিনের নেতৃত্ব নিজ দলেই প্রশ্নের সম্মুক্ষীন হচ্ছে। এর নেপথ্যেও খেলা চলছে। আর তারই সুযোগে আচমকাই উত্থান হচ্ছে প্রবল ডানপন্থী বর্নবাদীদের সমর্থকদের। যার নজীর ব্রিটেনের রাজনীতিতে আগে কখনো দেখা যায় নি। আর সেই সময়টিতে বরিসের চোখ এখন, তার নেক্সট স্টপ টেন ডাউনিং ষ্ট্রিটে।
ব্রিটেনের মুলধারার গনমাধ্যম অবশ্য এসব খবরে ব্যাস্ত নয়। দেশের ট্যাবলওয়েডগুলির ব্যাস্ততা বরিসের আগামী বিয়ে, ডিভোর্স নিয়ে।
বরিসকে তার সাবেক স্ত্রী কিছুদিন আগে ঘর থেকে বের করে দিয়েছেন, তার সর্বশেষ প্রেমকাহিনী ধরা পড়ার অপরাধে! নতুন প্রেমে ভেঙ্গে যায় তাই স্ত্রী মেরিনা উইলারের সাথে ২৫ বছরের সংসার। বহু প্রেম-সম্পর্কে সিক্ত বরিসের ব্যাক্তিজীবন ব্রিটেনের ট্যাবলয়েড পত্রিকাগুলোর বর্ণনার মতোই বর্নিল।
বরিস প্রধানমন্ত্রী হলে তার ২৩ বছরে ছোট বান্ধবী কেরি স্যামন্ডস ই কী হবেন প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী তা নিয়েও সরব ব্রিটিশ মিডিয়া। কারন আগামী কয়েক সপ্তাহে বরিসের ব্যাক্তিগত জীবনের ডির্ভোস প্রক্রিয়া শেষ হবার কথা তার আগের স্ত্রীর সাথে। এরপর তিনি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হয়ে ঘটাবেন তার এখনকার প্রতিশ্রুত, ইউরোপ থেকে ব্রিটেনের ডিভোর্স। তবে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসে বরিস ক্লারাকে বিয়ে করলে জন্ম দেবেন নতুন এক ইতিহাসের।
গত ২৫০ বছরে ব্রিটেনের ইতিহাসে বরিসই হবেন সেই প্রধানমন্ত্রী; যিনি প্রধানমন্ত্রী অবস্থায় বিয়ের পিড়িঁতে বসবেন। তবে ৩১ অক্টোবর নিধারিত দিনে ব্রেক্সিট কার্যকর না হলে ব্রিটেনের জন্য বড় অনিশ্চয়তা অপেক্ষায় থাকবে।
পুনশ্চঃ ভারতের সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে মোদি সবচেয়ে শক্তিমান নেতা হিসেবে ভোটারদের সামনে নিজেকে উপস্থাপন করতে পেরেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পও তাই।
এড মিলিব্যান্ডের স্কুলবন্ধু টার্কিশ ডিপ্লোম্যাট পিতার পুত্র ক্যারিয়ার জার্নালিষ্ট বরিসও তাই। প্রধানমন্ত্রীত্বের দৌড়ে থাকা ১১ জনের মধ্যে লন্ডনের বরিস বাইকের এ জনকই ছিলেন সবচেয়ে পরিচিত। আলোচিত এবং সমালোচিতও। আর এখনকার বিশ্বরাজনীতিতে সমালোচিতদেরই জয়জয়কার। ব্রিটেনের জনগণ সবসময় শক্তিশালী সরকার চান। চান ব্রেক্সিট ইস্যুটি সম্পন্ন হোক।
কিন্তু আমি অনুভব করি, ব্রিটেনে এখন ব্রেক্সিটই একমাত্র সংকট নয় কিন্তু। ৮০০ বছর ধরে দেশটি লিখিত সংবিধান ছাড়া চলছে। কিন্তু, এখনকার বাস্তবতা, নাগরিক অধিকার বা প্রতিরক্ষায় জনগণের জবাবদিহিতার প্রশ্নে লিখিত সংবিধানের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য হয়ে পড়ছে।
এখানে অনেকগুলো সামাজিক, ভূ-রাজনৈতিক এবং মনস্তাত্বিক ইস্যু অ-নিস্পন্ন। সে লিখিত সংবিধানের যাত্রায় ব্রিটেন কি বরিসের হাতেই নিরাপদ, তা সময়ই বলে দেবে।
লেখক: সাংবাদিক, লন্ডন।