জয়নাল আবেদীন, কমলগঞ্জ :: আজ সেই ১৪ জুন। ১৯৯৭ সালের মধ্যরাত ১টা ৪৫ মিনিটে মাগুরছড়া গ্যাসকূপে বিস্ফোরণের প্রচন্ড শব্দে কেঁপে ওঠে গোটা কমলগঞ্জ। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের মাগুরছড়ার দুর্ঘটনার ২২ বছর পরও দিনটির কথা মনে করে ভয়ে শিউরে উঠেন স্থানীয়রা। সেদিন মানুষর ভীত ছিল, কখন এসে আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করে ফেলবে তাদের। সেই ঘটনার দায়ি কর্তৃপক্ষ ক্ষয়ক্ষতির আংশিক পরিশোধ করলেও আজও কোন ক্ষতিপুরণ পায়নি বন বিভাগ।
জানা যায়, প্রায় ৫০০ ফুট উচ্চতায় লাফিয়ে উঠা আগুনের লেলিহান শিখায় লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল বিস্তীর্ণ এলাকা। আগুনের শিখায় গ্যাসফিল্ড সংলগ্ন লাউয়াছড়া রিজার্ভ ফরেস্ট, মাগুরছড়া খাসিয়াপুঞ্জি, জীববৈচিত্র্য, বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন, ফুলবাড়ী চা বাগান, সিলেট-ঢাকা ও সিলেট- চট্টগ্রাম রেলপথ এবং কমলগঞ্জ-শ্রীমঙ্গল সড়কে ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। দেশের ইতিহাসে ভয়াবহতম অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্থ হয় ঘন গভীর বন ও এর সাহচর্যে থাকা বিপুল সংখ্যক প্রাণিবেচিত্র্য। ক্ষতির মুখোমুখি হয় রেল ও সড়কপথ, পান জুম, বিদ্যুৎ লাইনসহ এই অঞ্চলের অসংখ্য স্থাপনা। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী মার্কিন গ্যাস উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান অক্সিডেন্টাল ক্ষয়ক্ষতির আংশিক পরিশোধ করলেও কোন ক্ষতিপূরণ পায়নি বন বিভাগ। ফিরে আসেনি প্রাকৃতিক বনের স্বাভাবিকতা।
পূর্ণ ক্ষতিপূরণ না দিয়েই ইউনিকলের কাছে হস্তান্তরের পর সর্বশেষ শেভরনের কাছে বিক্রি হয়েছে এই গ্যাসক্ষেত্র। শেভরন ২০০৮ সালে ওই বনে ত্রি-মাত্রিক ভূতাত্ত্বিক জরিপ কাজ সম্পন্ন করে। এতেও স্থানীয়ভাবে অনেকেই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। ২০১২ সনে শেভরন মৌলভীবাজার ১৪নং বøকের অধীনে নূরজাহান, ফুলবাড়ি এবং জাগছড়া চা বাগানের সবুজ বেষ্টনি কেটে কূপ খননের পর এসব কূপ থেকে চা বাগানের ভেতর দিয়ে ড্রেন খনন করে পাইপ লাইনের মাধ্যমে উত্তোলিত গ্যাস কালাছড়ার মাধ্যমে রশীদপুর গ্রীডে স্থানান্তর চলছে।
মাগুরছড়া ট্র্যাজেডির ২২তম বার্ষিকী উপলক্ষে আজ শুক্রবার (১৪ জুন) সকাল ১০টায় জীববৈচিত্র্য রক্ষা কমিটি ও পাহাড় রক্ষা উন্নয়ন সোসাইটি ও কমলগঞ্জ উন্নয়ন পরিষদ এর উদ্যোগে মাগুরছড়া গ্যাস বিস্ফোরণে ক্ষয়ক্ষতির তালিকা জনসম্মুখে প্রকাশ, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্রদান ও কমলগঞ্জের ঘরে ঘরে গ্যাস সংযোগের দাবিতে কমলগঞ্জ-শ্রীমঙ্গল সড়কের মাগুরছড়ায় পরিবেশবাদী সংগঠন প্রতিবাদ সমাবেশ ও মানববন্ধন কর্মসূচির আয়োজন করবে। এছাড়া বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে দিবসটি পালন করে থাকে।
পরিবেশ সংরক্ষণবাদীদের তথ্যমতে, ৬৩ প্রজাতির পশু-পাখির মৃত্যু হয়। সিলেটের সঙ্গে সারাদেশের রেলযোগাযোগ ১৬৩ দিন বন্ধ থাকে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছিল ১৫ হাজার কোটি টাকা। বিভিন্ন সংগঠন মাগুরছড়া দুর্ঘটনার যথাযথ ক্ষতিপূরণ আদায়ের দাবিতে আন্দোলন পরিচালনা করে এলেও দীর্ঘ ২২ বছরেও ক্ষতিগ্রস্থদের দাবিকৃত ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিষয়টি এখনো অমিমাংসিত রয়েছে। ক্ষতিপূরণ আদায় নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার কারণে আজো ক্ষতিগ্রস্তরা নিরবে চোখের জল ফেলছেন। এ নিয়ে মৌলভীবাজার তথা সিলেটের জনমনে ক্ষোভ রয়েছে।
গ্যাসকূপ বিস্ফোরণের পরিত্যক্ত এলাকার উত্তর টিলায় সবুজায়ন হলেও মূল ক‚পটি এখনো পুকুরের মতো ধারণ করে টিকে আছে। চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরী করা হয়েছে। টিলার ওপর সবুজ বনায়নের উদ্যোগ নিলেও মাঝে মধ্যে আগুনের পোড়া ডালপালাবিহীন কালো রঙের গাছগুলো অগ্নিকান্ড দুর্ঘটনায় সাক্ষী এখনো দাঁড়িয়ে আছে।
সূত্র হলো, সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভিতরে লাউয়াছড়া ফরেস্ট বিটের অভ্যন্তরে মাগুরছড়া এলাকায় ১৯৮৪-৮৬ ও ১৯৯৪ সালে সাইসলিক সার্ভেতে গ্যাস মজুদের সন্ধান পাওয়া যায়। এ প্রেক্ষিতে উৎপাদন ভাগাভাগির চুক্তিতে ১৯৯৫ সালের ১১ জানুয়ারী মার্কিন বহুজাতিক তেল ও গ্যাস উত্তোলনকারী কোম্পানী অক্সিডেন্টালের সাথে বাংলাদেশ সরকারের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং গ্যাস উত্তোলনের জন্য ৬৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে অনুমতি প্রদান করা হয়। দায়িত্ব গ্রহণের পর অক্সিডেন্টাল কোম্পানি মাগুরছড়ায় গ্যাস ফিল্ডের ড্রিলিং কাজের জন্য সাবলিজ প্রদান করেছিল ডিউটেক নামের জার্মান কোম্পানির কাছে। গ্যাস উত্তোলনে ১৪ নং ব্লকের মাগুরছড়াস্থ মৌলভীবাজার-১ গ্যাসকূপের খননকালে ৮৫০ মিটার গভীরে যেতেই ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন মধ্য রাতে এ দুর্ঘটনা ঘটে ভয়াবহ বিষ্ফোরণ।
দুর্ঘটনার পর তৎকালীন সরকারের খনিজ ও জ্বালানী মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাহফুজুল ইসলামকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তদন্ত কমিটি ১৯৯৭ সালের ৩০ জুলাই মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট পেশ করে। তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী অক্সিডেন্টালের দায়িত্বহীনতাকেই দায়ি করা হয়।
মৌলভীবাজার জেলার অন্তর্গত শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে সংরক্ষিত বনাঞ্চলে ১৯৯৭ সালের জুন মাসে স্থানটি রাতারাতি সর্বাধিক গুরুত্বপ‚র্ণ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদ শিরোনামে পরিণত হয়। এখনো প্রতি বছর ‘মাগুরছড়া দিবস’- ছাড়াও মাঝে মাঝে সংবাদ শিরোনামে মাগুরছড়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে জনগণের সামনে আবির্ভূত হয়।
মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জির মন্ত্রী জিডিসন প্রধান সুচিয়ান এর মতে এ ঘটনার মধ্যদিয়ে প্রাকৃতিক বনের যে কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা কেউ বুঝতে পারবে না। যারা এই বনে বসবাস করে তারা বুঝতে পারবে। বন বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, বনের ১৭৭ কোটি টাকার ক্ষতি নিরূপন করে দেয়া হলে এ পর্যন্ত কিছুই পাওয়া যায়নি। প্রাকৃতিক বনের ক্ষতি কোন সময়ে পুষিয়ে উঠার নয়।
বন্যপ্রাণি ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু মুসা মুহিত চৌধুরী বলেন, বনের ক্ষতি নিরূপন করে দেয়া হলে এ পর্যন্ত কিছুই পাওয়া যায়নি। প্রাকৃতিক বনের ক্ষতি কোন সময়ে পুষিয়ে উঠার নয়। মাগুরছড়া গ্যাসকূপ বিস্ফোরনে ক্ষতিপূরন প্রদানে কোন অগ্রগতি নেই। পূর্বে যে অবস্থায় ছিল এখনও সে অবস্থা।
এ ব্যাপারে মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মো. তোফায়েল ইসলাম জানান, ক্ষতিপূরণের কোন আবেদন অপেক্ষমান নেই। পূর্বে যেগুলো এসেছিল তাদেরকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হয়েছে। বর্তমানে ক্ষতিপূরণের জন্য কেউ আসেনি।