বৃহস্পতিবার, ৭ নভেম্বর ২০২৪ খ্রীষ্টাব্দ | ২৩ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ



Sex Cams

                    চাইলে বিজ্ঞাপন দিতে পারেন

জাদুকাটা নদী পেরিয়ে শিমুলের রাজ্যে



বিজ্ঞাপন

তপন কুমার দাস:
বৈষ্ণব কবি রাধারমণ দত্ত, মরমী কবি হাছন রাজা, দুরবীন শাহ ও বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের জেলা সুনামগঞ্জ। প্রকৃতির নানা ছোঁয়ায় ভরপুর এই জেলাটি যেসব জায়গার কারণে বিখ্যাত তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ‘শিমুল বাগান’। জেলার ভারত সীমান্তবর্তী উপজেলা তাহিরপুরে জাদুকাটা নদী তীরে এর অবস্থান। গত বছর এই বাগান ঘুরে এসেছি। তবে একা ছিলাম। একবারের দেখায় তৃপ্তি মেটেনি। তাই এবার বন্ধুদের নিয়ে যাবার জন্য মনস্থির করি।

শুধু মনস্থিরেই আর আটকে থাকিনি। যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিই। সহকর্মী সুলতান আহমদ খলিল, দেলোয়ার হোসাইন, এ. জে লাভলু, অনুজ ইফতে খায়রুল বাসার বাবলু, ইমদাদুল হক লাভলু ও বন্ধুবর মোহাম্মদ আলতাফ হোসেন এবং সুজন সিং এবারের ভ্রমণ সঙ্গী।

সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার শিমুল বাগান, বারেকের টিলা ও নিলাদ্রী (শহীদ সিরাজ) লেক আমাদের ভ্রমণের গন্তব্য। গল্পের শিরেনাম ‘আমরা’ হলেও যার আন্তরিকতা আর আথিতেয়তা সবার মনে মুগ্ধতা ছড়িয়েছে তিনি হলেন- বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রিয় দাদা সমীর বিশ্বাস। দাদাই আমাদের আনন্দময় ভ্রমণের সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন।

শিমুল বাগান যাব, তাই আমার সহযাত্রীদের তর যেন আর সইছিল না। প্রথমবার শিমুল বাগানে যাবে। তাই তাদের ভেতরে যেন অন্যরকম উত্তেজনা কাজ করছিল। রবিবার দিবাগত রাতে সবাই অনুজ বাবলুর বাসায় রাত্রীযাপন করি। সোমবার সকাল ৭টা। ঘুম-ঘুম চোখে আমরা বড়লেখা থেকে সুনামগঞ্জের উদ্দেশ্যে মাইক্রোবাসযোগে (নোহা) রওয়ানা দেই।

সুনামগঞ্জ সদরে যখন পৌঁছাই তখন দুপুর সাড়ে ১২টা। খবর পাই বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার পলাশ এলাকায় ব্রিজ ভাঙা। বিকল্প সড়ক দিয়ে উপজেলা সদরে যেতে হয়। এই খবরে সবার কপালে চিন্তার ভাজ। এদিকে সকালে না-খাওয়ায় অনেকের খিদায় পেট চো চো করছে। অপরিচত সড়ক। স্থানীয়দের দেওয়া তথ্যমতে সুনামগঞ্জ থেকে রওয়ানা করলাম। সদর থেকে ৩০ মিনিটের দূরত্ব। শত ব্যস্ততার মাঝেও দাদা কয়েক বার ফোনে খবর নেন। কতদূর পৌঁছলাম। অবশেষে অনেক ঝক্কি-ঝামেলার পর দুপুর ২টায় পৌঁছলাম বিশ্বম্ভরপুরে।

উপজেলায় পৌঁছে খাবার পর্ব শেষ করলাম আমরা। এর আগে আমাদের জন্য তাহিরপুরের শিমুল বাগানসহ প্রাকৃতিক স্থানগুলো দেখার সব ব্যবস্থা করে রাখেন দাদা। ৩টার দিকে তাহিরপুরের শিমুল বনের দিকে ছুটলাম আমরা। ৪টি মোটরসাইকেলে আমরা ৭জন। আগের দুই রাত কাজের চাপে সুজন সিং-এর ঘুম হয়নি। বিশ্রামের জন্য সাথে যায়নি।

ভাঙা রাস্তা, ধুলা মাড়িয়ে আমাদের মোটরসাইকেল সামনে চলছে। আগের রাতে ওই এলাকায় বৃষ্টি হয়েছিল। বৃষ্টিতে গাছগুলোর পত্র পল্লবে যেন প্রাণ ফিরেছে। পাতা থেকে ধুলো সরে সবুজ ফিরেছে। চারপাশের সৌন্দর্য দেখে মোটরসাইকেল থামিয়ে আমরা ছবি তুললাম।

আনুমানিক বিশ মিনিট মোটরসাইকেলে চলার পর পৌঁছলাম তাহিরপুরে। দেখা মিলল জাদুকাটা নদীর। ওখানকার মানুষের জীবন-জীবিকার একমাত্র উৎস এই নদী। বিজিবি ক্যাম্পের পাশ দিয়েই জাদুকাটা তীরে পৌঁছলাম। বারিক টিলা, শিমুল বাগান আর নিলাদ্রী (শহীদ সিরাজ লেক) যেতে হলে জাদুকাটা নদী পাড়ি দিতে হয়। ধুলা উড়িয়ে তখন ধু ধু বালুচরে চলছে মোটরসাইকেল। বালুর রাস্তায় ঝুঁকিতে যাত্রী নিয়ে নদী ঘাটে পৌঁছাচ্ছে মোটরসাইকেল। কেউ নৌকায় নদী পার হচ্ছেন। কেউ আবার নৌকা করে মোটরসাইকেলসহ পার হচ্ছেন।

দূর থেকে দেখা গেল অপরূপ জাদুকাটা নদীর তীরের লাল টকটকে শিমুল বন। যেন আগুন লেগেছে বনে। তবে পথ তখনও বেশ দূরের। মোটরসাইকেলে পাড়ি দিতে হবে জাদুকাটা নদী। নদীতে পানি কম, যতদূর চোখ যায় ধু ধু বালুচর। প্রখর রোদ। মোটরসাইকেল থেকে নেমে বালুচরের মধ্যে হাঁটছি। তখন সাড়ে ৩টা। জাদুকাটা নদী পার হয়ে পৌঁছালাম ওপাশের সবুজ বারিক টিলায়। ওপারে কুয়াশায় মোড়ানো মেঘালয় পাহাড়। সবুজ এ পাহাড়ের বুক চিড়ে চলা নীল নদীটি বর্ষায় প্রাণ ফিরে পায়। তখন জাদুকাটা নদীর অপরূপ দৃশ্য দেখতে পর্যটকেরা ভীড় করেন।

বারিক টিলা থেকে নিচের দৃশ্যটি আরো মুগ্ধকর। ধূসর ছোটবড় ঢেউ ওঠা বালুর প্রান্তর। সারি সারি নৌকা। নদীর টলটলে জল। শিল্পীর তুলির আঁচড়ে ক্যানভাসে ফুটে ওঠা ছবির মতোই। কেবল মুগ্ধতা বাড়ে।

টিলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে যে কেউ বিমোহিত হবে। ওখানে সবাই মিলে স্মৃতি ধরে রাখতে ছবি তুললাম। বারিক টিলা থেকে রওনা করে পৌঁছলাম শিমুল বাগানে। সারি সারি শিমুল গাছে আগুনের ছোঁয়া। আগুন যেন হাওয়ায় ভাসছে। টকটকে লাল শিমুল ফুলে ছেয়ে গেছে পুরো বাগান। ওখানে আগুনের শিমুল ফুল দেখে মনটাই জুড়িয়ে গেল! ডালে ডালে খুনসুটিতে ব্যস্ত পাখিরা। এসব দৃশ্য দেখে যাত্রাপথের সমস্ত ক্লান্তি নিমিষেই উধাও।

জাদুকাটা নদী তীর ঘেঁষে ভারতীয় সীমান্ত লাগোয়া টিলাভূমি। এর নাম লাউড়েরগড়। লাউড়েরগড়ের এই বিশাল শিমুল বাগানটি পর্যটকদের কাছে এখন নতুন আকর্ষণ। এই এলাকাজুড়ে টকটকে লাল শিমুল ফুল গাইছে বসন্তের জয়গান। প্রতিদিন শিমুলের রক্তরাঙা সৌন্দর্য দেখতে অসংখ্য পর্যটক দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে হাজির হন এখানে। এই দিনও এর ব্যতিক্রম ছিল না। একপাশে মরুপ্রায় জাদুকাটার বালুর চর পেরিয়ে বারিক টিলার নৈসর্গিক সৌন্দর্য। অন্যপাশে লাল ফুলের এই বাগান চোখ আটকে থাকে। ইচ্ছে করে আরো কিছুটা সময়, আরো কিছুটা ক্ষণ এখানে কাটুক। প্রকৃতি এখানে আপন সত্ত্বায় উদার।

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেল, ২০০২ সালে টাঙ্গুয়ার হাওর তীরবর্তী লাউড়েরগড় গ্রামে বাণিজ্যিক এই শিমুলের বাগান গড়ে তোলেন বাদাঘাট (উত্তর) ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন। তার পরিচর্যায় বেড়ে ওঠে দেশের সবচেয়ে বড় শিমুল বাগান। ২ হাজার ৪০০ শতক জমিতে এই শিমুল বাগান গড়ে তোলেন তিনি। ফাগুনের শুরুতেই হাজার দু’য়েক গাছে যখন একই সাথে ফুল ফোটে তখন অসাধারণ এক দৃশ্য পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। শিমুল বনের রক্তরাঙা সৌন্দর্যের দেখা মেলে বছরে এই একটি ঋতুতেই। মধু আহরণের টানে ছুটে আসে হরেক রকমের পাখপাখালি। বাগানমালিক জয়নাল আবেদীন প্রয়াত হয়েছেন। কিন্তু রয়ে গেছে তার বাগানটি। এখন তার বড় ছেলে সাবেক চেয়ারম্যান আফতাব উদ্দিনের তত্ত্বাবধানে শিমুল গাছের ফাঁকে ফাঁকে লাগানো হয়েছে লেবু গাছ, এতে বাগানের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুণ।

ওখানে বিকেল হয়েছে। শিমুল রাজ্যের মায়া ছেড়ে এবার ফেরার পালা। মোটরসাইকেল চালকরা নিয়ে গেলেন তাহিরপুরের আরেক পর্যটন স্পট ‘শহীদ সিরাজ লেকে’। যদিও এর পরিচিতি ‘নিলাদ্রী’ নামে। নিলাদ্রী (শহীদ সিরাজ) লেকে যাওয়ার রাস্তার অন্তত ২০০ গজ ওপারে ভারতের কাটাতারের বেড়া। দৃষ্টি নন্দন চুনা পাথরের বড় বড় পাহাড়। এর সৌন্দর্যে চোখ জুড়িয়ে যায়। চোখ জুড়ানো অসংখ্য দৃশ্যপটে ভরা এক পর্যটন স্থান।

আমরা পৌঁছলাম নিলাদ্রী লেকে। উপরে নীল আকাশ। আর আকাশের সব নীল যেন গিয়ে ঠেকেছে লেকের পানিতে। চোখের সামনে বিশাল পাহাড় আর পাশে সুবজে ভরা লেকের মাঠ। যেন প্রকৃতিপ্রেমী শিল্পীর হাতে পটে আঁকা এক ছবি। ততক্ষণে সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলেছে। অস্তগামী সূর্যের আলো পড়েছে লেকের জলরাশিতে। লেকের আকাশে তখন রক্তরঙের হোলিখেলা। অন্য এক আকাশ। সেই রং লেগেছে লেকের আশপাশে। এক নৈসর্গিক দৃশ্য। সবাই অনেক আনন্দের সাথে ছবি তোললাম। সন্ধ্যা নেমেছে। এবার ফিরতে হবে।

তাহিরপুরের বালিয়া ঘাট নতুন বাজার হয়ে বিশ্বম্ভরপুরের দিকে রওনা দিলাম। জাদুকাট নদী পৌঁছাবার আগেই সন্ধ্যা হয়ে গেল। নৌকায় আমরা নদী পাড়ি দিচ্ছি। এই সময় গলা ছেড়ে একজন বাউল স¤্রাট শাহ আব্দুল করিমের ‘কেন পীরিতি বাড়াইলারে বন্ধু ছেড়ে যাইবা যদি’ গান ধরলেন। গান শুনতে শুনতে নদী পাড়ি দিলাম। কতরকমের প্রেম জগতকে কাছের করেছে। প্রকৃতির অংশ বলেই কিনা মানুষ সেই প্রকৃতির কাছেই বারবার ছুটে যায়।

যেভাবে যাবেন
‘ঢাকা থেকে বাসে করে যান সুনামগঞ্জ। অথবা ট্রেনে যেতে চাইলে প্রথমে ট্রেনে করে সিলেট যেতে হবে সেখান থেকে বাস অথবা গাড়ি ভাড়া করে সুনামগঞ্জ শহরে। সুনামগঞ্জের আব্দুজ জহুর সেতুর গোড়া থেকে বাইক অথবা লেগুনায় সরাসরি লাউড়ের গড় চলে যেতে পারবেন। বাইকে জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ২০০ টাকা ও লেগুনায় ১৪০০ থেকে ১৫০০ টাকা রিজার্ভ। চাইলে প্রাইভেট গাড়ি নিয়েও চলে যেতে পারেন লাউড়ের গড়। তারপর বালু চর দিয়ে হেঁটে চলে যান শিমুলবন।’