মৌলভীবাজার-২ আসনে ধানের শীষ প্রতীক কখনও জয়ী হতে পারেনি। এমনকি কখনও তৃতীয় থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে আসতে পারেনি বিএনপির কোনও প্রার্থী। বরং ১৯৯১ এবং ২০০১ সালে এ আসনে দুইবার জামানত হারায় বিএনপি।
এবার এই আসনে ধানের শীষের প্রতীক নিয়ে লড়লেন ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী ডাকসুর সাবেক ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ। জয়ী হয়ে এক নতুন ইতিহাস গড়লেন তিনি।
মৌলভীবাজার-২ আসনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে মোট ৯৩টি কেন্দ্রের মধ্যে সুলতানের ধানের শীষ নিয়ে পেয়েছেন ৭৯ হাজার ৭৪২ ভোট, নৌকা নিয়ে শাহীন পেয়েছেন ৭৭ হাজার ১৭০ ভোট।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রতিবাদে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে অস্ত্র হাতে প্রতিরোধ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ। এ কারণে জীবনের বড় একটা সময় তাকে কাটাতে হয়েছে ভারতের মেঘালয়ের পাহাড়ে আত্মগোপনে।
১৯৮৯ সালে ডাকসু’র ভিপি পদে তার বিজয় ছিল ’৭৫ পরবর্তী আওয়ামী লীগের প্রথম আনুষ্ঠানিক কোনও জয়। তার নেতৃত্বে ‘৭৫-এর পর প্রথম বঙ্গবন্ধুর ছবি স্থান পায় ডাকসু ভবনে।
এবারের নির্বাচনী মাঠে হামলা-মামলায় শতশত কর্মী গ্রেফতারের পরও মনোবলে ভাঙন ধরেনি সুলতানের। যে আসনে কখনও জয়ী হতে পারেনি ধানের শীষ সে আসনে ধানের শীষ নিয়ে শেষ হাসি হাসলেন সুলতান মনসুর।
মৌলভীবাজার-২ আসনে প্রতি নির্বাচনে চমক থাকে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। দলীয় প্রতীকের চেয়ে এখানে সবসময় এগিয়ে থাকে প্রার্থীর জনপ্রিয়তা।
৯৯৬ সালে সুলতান মনসুর নৌকা প্রতীক নিয়ে এখান থেকে এমপি হয়েছিলেন, যা ছিল নৌকার সর্বশেষ জয়। এরপর কখনও জয় পায়নি নৌকা। কখনও জিতেনি ধানের শীষ।
১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিতর্কিত একদলীয় নির্বাচনে ধানের শীষের জয় দেখানো হলেও নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী তা স্বীকৃতি পায়নি। কখনও জয় না পাওয়া এ আসনে সুলতান মনসুরের ওপর ভর করে এবার ধানের শীষ চমক দেখিয়েছেন এমনটি বলছেন স্থানীয় ভোটাররা। কারণ, সুলতান মনসুরের ব্যক্তিগত ইমেজের ওপর ভর করে এখানের মানুষ ধানের শীষে ভোট দিয়েছেন।
২০০৮ তে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পাননি সুলতান। সে নির্বাচনে সুলতানবিহীন নৌকা পেয়েছিল মাত্র ২ হাজার ভোট।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা যায়, ১৯৭৯ সালে প্রথম নির্বাচনে আসে বিএনপি। সে নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে অংশগ্রহণ করে সৈয়দ আকমল
হোসেন তৃতীয় স্থান অর্জন করেন। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করেনি। ১৯৯১ সালে এ আসনে বিএনপির প্রার্থী আতাউর
রহমান নির্বাচনে আসলেও মাত্র পাঁচ হাজার ভোট পেয়ে জামানত হারান।
১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিতর্কিত একদলীয় নির্বাচনে ধানের শীষের জয় দেখানো হলেও নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী তা স্বীকৃত নয়। ১৯৯৬ সালে সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে এ আসনে বিএনপি থেকে ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচনে আসেন মকসুদ শাহীন। কিন্তু এবারও তৃতীয় হন তিনি। ২০০১ সালের নির্বাচনে এ আসনে চারদলীয় জোট থেকে ড. শফিকুর রহমান নিবার্চন করে জামানত হারান। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি থেকে ধানের শীষে নির্বাচন করেন এনএম আবেদ রাজা।
সেবারও ধানের শীষ তৃতীয় অবস্থান থেকে উন্নতি করতে পারেনি। ফলে এ আসনে কোনোদিন জয়ের মুখ দেখেনি ধানের শীষ। সর্বশেষ ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি বিএনপি।
স্থানীয় ভোটারররা বলছেন, সুলতান মনসুর ক্লিন ইমেজের জাতীয় নেতা। অতীতে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করলেও প্রতিপক্ষকে হয়রানি করেননি মনসুর। এলাকার স্বার্থে সবাইকে নিয়ে কাজ করেছেন। তার কাছে কোনো কাজের জন্য এলাকার মানুষ গেলে দলীয় পরিচয় না খুঁজে তা করে দিয়েছেন। তাই এ আসনে একাদশ নির্বাচনে সুলতান মনসুরকে আমরা ভোট দিয়েছি। কারণ এখানে সবার প্রিয় নেতা সুলতান মনসুর।
২০০৮ সালে মৌলভীবাজার-২ আসনে বিএনপির পরাজিত প্রার্থী কেন্দ্রীয় বিএনপির সদস্য আবেদ রাজা বলেন, সুলতান মনসুরের কারণে সাধারণ মানুষের মাঝে যে গণজোয়ার সৃষ্টি করা সম্ভব হয়েছিল তার কারণে এত কারচুপির পরেও সুলতানকে আটকানো যায়নি।
কুলাউড়ার রাতগাও ইউনিয়নের আব্দুল জলিল বলেন, সুলতান মনসুর এমপি থাকা অবস্থায় কুলাউড়ায় যে উন্নয়ন করেছেন তা কেউ কখনো করতে
পারেননি, যার কারণে সাধারণ মানুষ সুলতানকেই ভোট দিয়ে জয়ী করেছে।
এ আসনে প্রায় ৫২ হাজার ভোট ছিল চা শ্রমিক এবং নৃগোষ্ঠীসহ সংখ্যালঘুদের। চা শ্রমীকরা সব সময় জাতীর জনকের কারণে নৌকায় ভোট দিয়ে থাকেন কিন্তু এ বছর তারা সুলতান মনসুরকে ভোট দিয়েছেন তাদের কথা হচ্ছে “সুলতান সাবের চেহারা মুজিবের সঙ্গে মিলে যায়, তার উপর মুজিবের আদর্শ আছে, গায়েও মুজিব কোট আছে। সেই ভাবনায় অনেক ভোট জমা হয়েছে সুলতানের বক্সে।
আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত থাকা অবস্থায় সংখ্যালঘুদের ভোট বার বার নৌকা প্রতীকে পেয়েছেন সুলতান মনসুর, যার বিশাল একটি অংশ এবার মনসুর পেয়েছেন অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্বের কারণে।
কুলাউড়ার কাদিপুর ইউনিয়নের সৌরভ ভট্টাচার্য বলেন, আমার জীবনের প্রথম ভোট দিয়েছিলাম নৌকা মার্কায়। কিন্তু এখানে প্রতীক বড় বিষয় নয়; ব্যক্তি আমাদের কাছে বড়। তাই অসাম্প্রদায়িক নেতা হিসেবে সুলতানকেই ভোট দিয়েছি।
কুলাউড়া উপজেলার অনেক আওয়ামী লীগের নেতা দিনে নৌকার পাশে থাকলেও রাতে ছিলেন ধানের সাথে।
এ বিষয়ে সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ বলেন, আমি জনগণের ওপর আস্থাশীল ছিলাম। আমার বিশ্বাস, সব দলের লোক আমাকে ভোট দিয়েছে কারণ, আমি কেমন মানুষ এ এলাকার প্রতিটি মানুষ জানে। এত কারচুপি না হলে ভোটের ব্যবধান ৭০-৮০ হাজার হত।
তিনি বলেন, মুজিব কোর্ট গায়ে দিয়ে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু বলেই এমপি হয়েছি, আজীবন তাই থাকব।