তফসীল ঘোষণার পর থেকেই সিলেটে বড় দুই জোটের প্রার্থীরা বেশ সাবলীলভাবেই প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে আসছিলেন। যদিও সিলেটজুড়ে বিএনপি জোটের প্রার্থী ও নেতারা সবসময়ই অভিযোগ করে আসছিলেন- তাদের প্রচার-প্রচারণায় বাধা দেয়া হচ্ছে। তবে দৃশ্যত ভোটের মাঠ ছিল শান্ত। বিগত বছরগুলোতেও নির্বাচনী সহিংসতার আঁচ লাগেনি সিলেটে। এতদিন শান্ত ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ বজায় থাকলেও হঠাৎ করেই উত্তাপ বাড়ছে সিলেটে ভোটের মাঠে। আর এতে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের পাশাপাশি উদ্বিগ্ন সাধারণ ভোটাররাও।
প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও নির্বাচনী কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর, ককটেল নিক্ষেপ ও পোষ্টার ছিড়ে ফেলার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এসব ঘটনার জন্য নির্বাচনী প্রতিপক্ষকে দায়ী করছেন প্রধান দুই জোটের প্রার্থী ও নেতাকর্মীরা। কোথাও কোথাও এমন অভিযোগের ভিত্তিতে মামলাও করা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে- দলীয় প্রার্থীদের নির্বাচনী কার্যালয়ে, প্রচার মাইকে হামলা, প্রচার কাজে ব্যবহৃত গাড়ি ভাঙচুর হচ্ছে। তবুও কর্মীদের সহিংস হতে নিষেধ করছেন নেতারা। বিএনপির প্রার্থীরা নির্বিঘ্নে প্রচারণা চালাচ্ছেন। কোথাও কাউকে বাধা দেয়া হচ্ছে না।
আর বিএনপির অভিযোগ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা নিজেরা হামলা-ভাঙচুরের ঘটনা ঘটিয়ে পুলিশ দিয়ে তাদের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের গ্রেপ্তার ও হয়রানি করছে। এছাড়া বিভিন্নস্থানে পুলিশ নেতাকর্মী ও সমর্থকদের ‘গায়েবী মামলা’ দিয়ে গ্রেপ্তার করছে। বাসা-বাড়িতে থাকতে দিচ্ছে না। ৩০ তারিখ পর্যন্ত এলাকা ছাড়া থাকার হুমকি দেয়া হচ্ছে।
এতদিন নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে সিলেটের সাধারণ জনগণ বেশ আশ্বস্ত ছিলো। তবে শেষ মুহূর্তে আর সেটা বজায় থাকবে বলে মনে হচ্ছে না। নগরীর বাসিন্দা শহিদ মিয়া বলেন, ‘এখন আর আগের দিন নেই। যে পরিস্থিতি দেখছি, তাতে ভোট দেয়ার সাহস নেই। চা বিক্রেতা নুর উদ্দিন বলেন, ভোট কী হবে? না আমাদের ভোট অন্য কেউ দিয়ে দেবে। শুনতেছি ভোটের দিন বড় ধরনের ঝামেলা হবে। আমরা গরীব মানুষ ভোট দেয়ার কোন দরকার নেই।’
মূলত সিলেটে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে গত মঙ্গলবার (১৮ ডিসেম্বর) মধ্যরাতে। মহাজোট প্রার্থী ড. একে মোমেনের প্রচার গাড়ি ও নির্বাচনী কার্যালয় ভাঙচুরের অভিযোগে সিলেটের জালালাবাদ ও বিমানবন্দর থানায় দুইটি অভিযোগ দায়ের হয়। আর অভিযোগ পেয়ে পুলিশ মাঠে নামে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের ধরপাকড়ে। রোববার (২৩ ডিসেম্বর) থেকে এর মাত্রা আরো বাড়ে। শনিবার (২২ ডিসেম্বর) দিবাগত রাতে সিলেট নগরীর শাহপরান এলাকায় ড. মোমেনের একটি নির্বাচনী কার্যালয়ে ভাঙচুর ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। রোববার রাতে নগরীর চৌকিদেখি এলাকায় মোমেনের একটি কার্যালয়ের বাইরে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। একইদিন রাত ৮টার দিকে হাওলাদারপাড়ায় মোমেনের একটি প্রচারণা মাইক ভাঙচুর করা হয় বলে অভিযোগ করেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী ড. একে আব্দুল মোমেন। ঘটনার পরপরই তিনটি মামলা করা হয় নগরীর বিভিন্ন থানায়। এসব ঘটনায় আসামী হয়েছেন বিএনপির প্রায় দুই শতাধিক নেতাকর্মী। এরমধ্যে গত তিনদিনে ৩০ জনের উপর নেতাকর্মীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে বলে জানায় বিএনপি। সোমবার জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে গ্রেপ্তার হওয়া ১৮ নেতাকর্মীর তালিকা সাংবাদিকদের দেন বিএনপির প্রার্থী খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির।
সংবাদ সম্মেলনে খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির বলেন, নির্বাচনের আগে একটি গোষ্ঠী হামলা, মামলা, ধরপাকড় চালিয়ে সিলেটের পবিত্র মাটিকে অপবিত্র করার চেষ্টা করছে। যারা এই মাটিকে অপবিত্র করার চেষ্টা করছে, তাদের পরিণাম শুভ হবে না। তিনি পুলিশ প্রশাসনকে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনের অনুরোধ জানান।
অপরদিকে, মহাজোট প্রার্থী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বিএনপির এসব অভিযোগ আমলেই আনতে চান না। তাঁর অভিযোগের তীর প্রতিপক্ষের দিকেই। পোস্টার ছেঁড়া, নির্বাচনী কার্যালয় ভাঙচুরসহ বেশ কয়েকটি অভিযোগ এনেছেন তিনি।
সর্বশেষ মঙ্গলবার (২৫ ডিসেম্বর) বড়দিনের উৎসবে হাজির হন সিলেট-১ আসনে নৌকার প্রার্থী ড. একে আব্দুল মোমেন ও ধানের শীষের প্রার্থী খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির। দেখা হতেই দুই প্রতিদ্বন্দ্বী নিজেদের মধ্যে করমর্দন করেন। হাসিমুখে আলাপচারিতাও হয়। তবে শেষ পর্যন্ত এই হাসিখুশি আলাপচারিতা ‘মেকি সম্প্রীতি’-তে রুপ নেয়। খন্দকার মুক্তাদির বলেন, ক্যামেরার সামনে ছবি তোলাকে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি বলতে পারেন। তবে এই সৌহার্দ্য অত্যন্ত মেকি। এতে আন্তরিকতা নেই। গত তিনরাতে এসএমপির পাঁচ থানায় পাঁচটি মামলা হয়েছে। আমার শতশত নেতাকর্মী আসামি।
আর আওয়ামী লীগের প্রার্থী ড. মোমেন বলেন, আপনারা জানেন, পুরো সিলেট বিভাগে আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বীরাও নির্বিঘ্নে প্রচারণা চালাচ্ছেন। আমাদের দ্বারা কোথাও কেউ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে না। কিন্তু তাদের মজ্জাগত অভ্যাস নালিশ করা। তাদের নেত্রীও এটা করেন। গত সিটি নির্বাচনেও এটি করেছিলেন। তবু তখন তারা জয় পান। এছাড়া সিলেট জেলার অন্যান্য আসনগুলোরও একই চিত্র।
বাস্তবে ভোটের মাঠের এই অবস্থার সাথে খুব একটা পরিচিত নয় সিলেটবাসী। সিলেটে ভোট আনন্দের, উৎসবের। ৩০ তারিখ পর্যন্ত সেই আবহ বিরাজ করবে এমনটাই সাধারণের প্রত্যাশা।