হাসান মো. শামীম, অতিথি প্রতিবেদক:
তিনশ ষাট আঊলিয়ার পুণ্যভূমি সিলেট। সিলেট বিভাগে আছে ১৯টি নির্বাচনী আসন। এর মধ্যে সবচেয়ে মর্যাদার আসন হচ্ছে সিলেট-এক। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে এখন পর্যন্ত এ আসনে যে দল পাশ করেছে তারাই পরবর্তীতে সরকার গঠন করেছে।
প্রতিটি রাজনৈতিক দলের আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু হয় এখান থেকে। হযরত শাহজালালের মাজার জিয়ারতের মাধ্যমেই সুচিত হয় নির্বাচনী কার্যক্রম। সারাদেশের মধ্যে সিলেটের এই আসনটির প্রতি তাই মানুষের থাকে আলাদা চোখ। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এবার এ আসনে মনোনয়নের ক্ষেত্রে দেখিয়েছে চমক। সিলেট এক আসনের টানা দুইবারের সংসদ সদস্য অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতকে না দিয়ে এবার প্রার্থী করা হয়েছে তার সহোদর জাতিসংঘের সাবেক স্থায়ী রাষ্ট্রদুত ড. একে আবদুল মোমেনকে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে খোদ মাল মুহিতের অবদান সবচেয়ে বেশি। তিনি নিজেই এই আসনের জন্য তাঁর ছোটভাই মোমেনকে দেখতে চেয়েছিলেন। নানা বিতর্ক আর সমালোচনাকে এক পাশে রেখে মোমেনের জন্য তিনি লড়াই করেছেন শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত। ফলে মোমেনের মনোনয়ন প্রাপ্তির মাধ্যমে অবসান হলো আবুল মাল আব্দুল মুহিতের ৭০ দশকের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের। অবসরে যাচ্ছি যাব বলে দীর্ঘদিন থেকে সুর তুলে অবশেষে অবসর গ্রহন করলেন সফল এই রাজনীতিবিদ।
গত রোববার দলীয় মনোনয়ন চিঠি হাতে পাওয়ার পরই ঢাকায় বড় ভাই অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের কাছে ছুটে যান ড. মোমেন। এ সময় তিনি তার তাঁর দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার চিঠি আবুল মাল আবদুল মুহিতের হাতে তুলে দেন। মুহিত নির্বাচনের জন্য ড. মোমেনকে আশিবার্দ করেন। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার জন্য দলীয় মনোনয়ন ফরম কিনেছিলেন ড. একে মোমেন। তখন এই মনোনয়ন ফরমের ৩০ হাজার টাকা মোমেনকে দিয়েছিলেন সিলেট-১ আসনের বর্তমান সাংসদ আবুল মাল আব্দুল মুহিত। তখন পরিবারের সকল সদস্যের সাথে আনুষ্ঠানিক ভাবে ফরমের টাকা মোমেনকে তুলে দিয়ে ছোট ভাইয়ের প্রতি মুহিতের সমর্থনের স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। মোমেনের সাথে অর্থমন্ত্রী নিজেও নির্বাচনে অংশগ্রহনের জন্য ফরম কিনেছিলেন। এক পরিবার থেকে দু’জনেরই মনোনয়ন ফরম কেনার ব্যাপারে এক প্রশ্নের জবাবে মুহিত জানান, কোনো কারণে মোমেন নৌকার টিকিট না পেলে তিনিই হবেন এই আসনের প্রার্থী। তবে তা আর হয়নি। শেষ পর্যন্ত মুহিতের ইচ্ছাতেই মোমেনকে করা হয়েছে সিলেট এক আসনে নৌকার কান্ডারি। ফলে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জিতলেও আর সংসদে দেখা যাবে না দুইবারের সফল অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতকে। বলা চলে রাজনীতি থেকে এক প্রকার অবসরেই চলে গেলেন তিনি।
বিভিন্ন সময়ে নিজের অবসরের কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তবে কোন বারই নিজের দেওয়া কথা রাখতে পারেননি তিনি। সোজা সাপ্টা কথা বলার জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন মুহিত। তাঁর বিভিন্ন সময়ে বলা বক্তব্য-শব্দ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চর্চা হয়েছে ব্যাপক। উপস্থিত বক্তব্যে হাস্যরস এ ভিন্ন কিছু বলার জন্য সুধী সমাজেও আলোচিত ছিলেন মুহিত। তবে নিজের কথার কারণেই সবচেয়ে-বেশি সমালোচিত হয়েছেন মুহিত। গত ২০ নভেম্বর মঙ্গলবার রাজধানীতে হওয়া এক অনুষ্ঠানে অবসর বিষয়ক এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন ‘আমাদের দেশে মুশকিল যেটা হয়, কেউ পদত্যাগ করতে চান না। অবসরে যাওয়ার রীতিটা আমি চালু করতে চাই। সব পেশার মতো রাজনীতিকদেরও অবসরে যাওয়ার দরকার আছে।’ মুহিতের অবসরের বিষয়টি নিয়ে দেশে আছে বিভিন্ন আলোচনা সমালোচনা। নানা সময়ে বিভিন্ন রাজনীতিবিদ তাকে স্বেচ্ছা অবসরের আহবান জানান। তবে নিজে থেকেই এই ডিসেম্বরে অবসরে যাওয়ার ঘোষণা দেন মুহিত।
প্রায় সাত দশকের এ কর্মজীবনের ইতি টেনে অবসরে কি করতে চান মুহিত। কিভাবেই বা তিনি তার অবসরের সময় কাটাতে চান। গত শনিবার রাজধানীর জাতীয় যাদুঘরে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘অবসরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি’। দুটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন উপলক্ষে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বইপ্রেমী মুহিত। অবসরের পর কীভাবে সময় কাটাবেন সেটিও বলে রেখেছেন খোলামেলা মনের মুহিত। তিনি জানিয়েছেন, বই পড়ে অবসর সময় কাটাবেন। অনুষ্ঠানে মুহিত বলেন,‘ যে বই দু’টির মোড়ক উম্মোচন হতে যাচ্ছে এ বইগুলো লেখক আমাকে অনেক আগেই দিয়েছেন। কিন্তু আমি বলবো না এটার অনেক কিছুই পড়েছি। না,পড়তে পারিনি। কারণ বর্তমানে আমি একটু ব্যস্ত আছি, একটা লম্বা কর্মজীবন থেকে অবসরে যাওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছি। অবসরে এ ধরণের বইগুলো আমার সময় কাটানোর মাধ্যম হতে পারে।’
অর্থনীতিবিদ, কূটনীতিক, ভাষা-সৈনিক, লেখক ও মুক্তিযোদ্ধা নানা বিশেষণে বিশেষিত আবুল মাল আবদুল মুহিত । ১৯৩৪ সালে সিলেটের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা আবু আহমদ আব্দুল হাফিজ ছিলেন এডভোকেট । তাঁর মা সৈয়দ শাহার বানু চৌধুরীও রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। তাদের দ্বিতীয় পুত্র মুহিত ছাত্রজীবন থেকেই অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। তিনি ১৯৫১ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে আইএ পরীক্ষায় প্রথম স্থান, ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে বিএ (অনার্স) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম এবং ১৯৫৫ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে এমএ পাশ করেন। চাকুরিরত অবস্থায় তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নসহ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমপিএ ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস-এ (সিএসপি) যোগদানের পর জনাব মুহিত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, কেন্দ্রীয় পাকিস্তান এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশে সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে তিনি পরিকল্পনা সচিব এবং ১৯৭৭ সালে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বহিঃসম্পদ বিভাগে সচিব পদে নিযুক্ত হন।
মুহিত পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনের চীফ ও উপ-সচিব থাকাকালে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যের ওপর ১৯৬৬ সালে একটি প্রতিবেদন প্রণয়ন করেন এবং পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে এটিই ছিল এই বিষয়ে প্রথম প্রতিবেদন। ওয়াশিংটন দূতাবাসের তিনি প্রথম কূটনীতিবিদ, যিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ১৯৭১-এর জুন মাসে পাকিস্তানের পক্ষ পরিত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য প্রদর্শন করেন।
১৯৮১ সালে চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে তিনি অর্থনীতি ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ হিসেবে ফোর্ড ফাউণ্ডেশন ও ইফাদে কাজ শুরু করেন। এরশাদ সরকারের আমলে ১৯৮২-৮৩ সালে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মাল মুহিত। তিনি বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেন। ১৯৮৪ ও ১৯৮৫ সালে মুহিত প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং ফেলো ছিলেন। একজন লেখক হিসেবেও মুহিতের রয়েছে অসামান্য প্রতিভা। প্রশাসনিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গ্রন্থ ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর ২১টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনে তিনি একজন পথিকৃত এবং বাপার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। মুহিতের স্ত্রী সৈয়দ সাবিয়া মুহিত একজন ডিজাইনার। তাঁদের তিন সন্তানের মধ্যে প্রথম কন্যা সামিনা মুহিত ব্যাংকার ও আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞ, বড় ছেলে সাহেদ মুহিত বাস্তুকলাবিদ এবং কনিষ্ঠ পুত্র সামির মুহিত শিক্ষকতা করেন।
২০০৯ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী নিযুক্ত হন মাল মুহিত। এর আগে ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে প্রথমবারের মত নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেন। যদিও সে নির্বাচনে প্রয়াত সাইফুর রহমানের কাছে হেরে গিয়েছিলেন তিনি।