রবিবার, ১ জুন ২০২৫ খ্রীষ্টাব্দ | ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ



Sex Cams

                    চাইলে বিজ্ঞাপন দিতে পারেন

টার্গেট টাওয়ার হ্যামলেটস মেয়র নির্বাচন ২০২২: লুৎফুর-আব্বাস ঐক্যের হাওয়া
লন্ডন প্রতিবেদক

লন্ডন প্রতিবেদক



বিজ্ঞাপন

লুৎফুর রহমান ও হেলাল আববাস। একসময় দুজনই ছিলেন হরিহর আত্মা। এক টেবিলে খেয়েছেন, এক বিছানায় ঘুমিয়েছেন। একজন ছিলেন আরেকজনের আপনের চেয়েও আপন। আন্তরঙ্গ বন্ধু। লুৎফুর রহমান ছিলেন আইনজীবী। কমিউনিটিতে ততটা পরিচিত ছিলেন না। হেলাল আব্বাস ছিলেন লেবার রাজনীতির ঝানু খেলোয়াড়। ছিলেন কাউন্সিলার। একসময় টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের লিডারের পদ অলংকৃত করেন। একবার নয়, পরপর চারবার তিনি কাউন্সিল পরিচালনা করেন। হেলাল আব্বাস তখন টাওয়ার হ্যামলেটসের লেবার রাজনীতিতে অপ্রতিরোধ্য নেতা। নিজের রাজনীতির সাফল্যে একসময় বন্ধু লুৎফুর রহমানকেও সম্পৃক্ত করতে চাইলেন। তাঁকে লেবার পার্টিতে সদস্য করলেন। এরপর একসময় কাউন্সিলার নির্বাচিত হলেন লুৎফুর রহমান। এরপর টাওয়ার হ্যামলেটস লেবার গ্রুপের লীডার। এগিয়ে গেলেন লুৎফুর রহমান। ফলে খানিকটা পেছনে পড়ে গেলেন হেলাল আব্বাস। নেতৃত্ব নিয়ে শুরু হয়ে গেলো দুজনের মধ্যে মতবিরোধ। দূরত্ব বাড়তে থাকে দুজনের মধ্যে। দুরত্ব, আরো দূরত্ব। দু’জনে জড়িয়ে পড়েন দলাদলিতে। দুই জনের দুই বলয়। আববাস পুরনো খেলোয়াড়। লুৎফুর রহমানও কম কিসে। তিনিও তার দলবল করে নিলেন। জনসমর্থনও তার পক্ষে বেশ। দুইজনই সমান্তরাল গতিতে এগিয়ে চলেন।

২০১০ সাল। টাওয়ার হ্যামলেটসের রাজনীতিতে নতুন টার্নিং পয়েন্ট। জনগণের সরাসরি ভোটে মেয়র নির্বাচনের জন্য ইয়েস-নো রেফারেন্ডাম অনুষ্ঠিত হলো। ইয়েস বিজয়ী হলো। এরপর অনুষ্ঠিত হলো প্রথম নির্বাহী মেয়র নির্বাচন। লেবারের প্রার্থী হতে চাইলেন লুৎফুর ও আব্বাস দু’জনই। কিন্তু পারলেন না হেলাল আববাস। স্থানীয় লেবার পার্টির সদস্যদের ভোটে প্রার্থী নির্বাচিত হলেন কাউন্সিলার লুৎফুর রহমান। পূর্ব লন্ডনের ক্যাম্ব্রিজহীথ রোডস্থ লেবার পার্টি অফিসে অনুষ্ঠিত প্রার্থী নির্বাচনে লুৎফুর রহমানকে লেবার পার্টির মেয়র প্রার্থী ঘোষণা করলো লন্ডন রিজিওয়ানাল লেবার পার্টি। হেরে গেলেন হেলাল আববাস।

এবার লুৎফুরকে আটকাতে মরিয়া হয়ে ওঠলেন হেলাল আববাস। লুৎফুর রহমানের বিরুদ্ধে লেবার পার্টির কার্যনির্বাহী কমিটির কাছে একগাদা অভিযোগ দাখিল করলেন। ফলে লুৎফুর রহমানের প্রার্থীতা বাতিল করলো লেবার পার্টি। আদালতের শরনাপন্ন হলেন লুৎফুর। আদালত ফিরিয়ে দিলো তাঁর প্রার্থীতা। কিন্তু লেবার পার্টির নির্বাহী কমিটি বিশেষ ক্ষমতাবলে তাঁর প্রার্থীতা ফের বাতিল করে দিলো। এবার লেবারের অফিশিয়াল মেয়র প্রার্থী হয়ে গেলেন কাউন্সিলার হেলাল আববাস।

দমে গেলেন না লুৎফুর রহমান। সঙ্গীয় কাউন্সিলারদের নিয়ে গড়ে তুললেন একটি ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম। সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দিয়ে নির্বাচনে দাঁড়ালেন স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী হিসেবে। কমিউনিটির মানুষ তাঁকে স্বাগত জানালো। বাংলা প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া তাঁর প্রতি অন্যায়ের জবাব দিতে ক্যাম্পেইনে সহযোগিতা করলো। ২০১০ সালের ২১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি বিপুল ভোটের ব্যবধানে মেয়র নির্বাচিত হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করলেন। বিদায় নিলেন টাওয়ার হ্যামলেটস রাজনীতির তুখোড় খেলোয়াড় হেলাল আববাস।

এরপর কে ঠেকায় লুৎফুর রহমানের অগ্রযাত্রা। বীরদর্পে কাউন্সিলে নেতৃত্ব দিলেন চার বছর। কাউন্সিলের নির্বাহী মেয়র এবং প্রধান নির্বাহী দুটোরই দায়িত্ব পালন করলেন এক সাথে। কাউন্সিলের বাসিন্দাদের জন্য যুগান্তকারী সব পদক্ষেপ নিলেন। তাঁর বিভিন্ন পদক্ষেপ মূলধারার গণমাধ্যমেও প্রশংসিত হলো। তিনি এখন বাঙালি কমিউনিটিতে তুমুল জনপ্রিয় নেতা। গোটা দেশে তাঁকে নিয়ে আলোচনা সমালোচনা হয়। প্রতি সপ্তাহেই তাঁকে নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে সচিত্র খবর প্রকাশ করা হয়। তিনি এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।

সমালোচকদের তোয়াক্কা না করে এগিয়ে যান লুৎফুর রহমান। অনেকটা বেপরোয়াই বলা চলে। এতে ক্ষোভ বাড়তে থাকে বিরোধী শিবিরে। হেলাল আববাসের নেতৃত্বেই একটি দল দাঁড়িয়ে যায় তাঁর বিরুদ্ধে। কিন্তু কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে কাটিয়ে দেন চার বছরের মেয়রকাল। ঘনিয়ে আসে দ্বিতীয় মেয়রাল ইলেকশনের দিনক্ষণ। ওই নির্বাচনেও তিনি পার হয়ে যান। ২০১৪ সালের ২২ মে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে দ্বিতীয়বারের মতো মেয়র নির্বাচিত হন। শুরু করেন দ্বিতীয় মেয়াদের যাত্রা। টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে যুগান্তকারী অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। খরচ বাঁচাতে কাউন্সিলের টাউন হল স্থানান্তর করে হোয়াইটচ্যাপেল রোডস্থ পুরাতন রয়েল লন্ডন হাসপাতালে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আরো কিছু বড় বড় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। মিডিয়া ও কমিউনিটিতে বাহবা কুড়ান লুৎফুর রহমান। কিন্তু পেছনে রশি কাটতে থাকে বিরোধীপক্ষ।

নির্বাচনে ভোট জালিয়াতির অভিযোগ এনে মামলা হয় লুৎফুর রহমানের বিরুদ্ধে। একজন বাঙালি ও তিনজন শ্বেতাঙ্গ মিলে মামলা দায়ের করেন। বিচারের জন্য বৃটিশ সরকার গঠন করে বিশেষ নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল। মামলার বাদীদের তথ্য উপাত্ত প্রদানসহ যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সহযোগিতা করেন হেলাল আববাস ও তাঁর সঙ্গীরা। সেন্ট্রাল লন্ডনের রয়েল কোর্ট অব জাস্টিসে চলতে থাকে শুনানী। দীর্ঘ ছয় মাস শুনানী শেষে আসে বহু আলোচিত রায়ের দিন।

২৩ এপ্রিল ২০১৫। নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের রায়ে বিচারক রিচার্ড মাওরী মেয়র লুৎফুর রহমানকে মেয়র পদ থেকে বরখাস্ত করেন। পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করেন। তাঁর আইন ব্যবসার লাইসেন্সও বাতিল করার নির্দেশ দেন। মামলার আইনী খরচ মেটাতে তার বাড়ি নিলামে ওঠে। মান-সম্মান, সম্পদ হারান লুৎফুর রহমান। এ যাত্রায় বিজয়ী হন হেলাল আববাস গ্রুপ। উপ-নির্বাচনের দিকে (তৃতীয় মেয়রাল ইলেকশন) এগুতে থাকে কাউন্সিল। হেলাল আববাস মেয়র প্রার্থী হওয়ার জন্য প্রাণপন চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রার্থী হতে পারেন না। লেবার পার্টি তদানিন্তন জিএলএ মেম্বার জন বিগসকে প্রার্থী ঘোষণা করে। ২০১৫ সালের ১১ জুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। মেয়র নির্বাচিত হন জন বিগস। জন বিগস নির্বাচিত হওয়ার পর দৃশ্যপট পালটে যায়। তিনি ভুলে যান হেলাল আববাস ও তাঁর সঙ্গীদের। এখন জন বিগসই হন টাওয়ার হ্যামলেটসের একক ক্ষমতাবান ব্যক্তি। চলতে থাকে এভাবেই। করার কিছু নেই। এখন জন বিগসই সর্বেসর্বা। স্থানীয় লেবারের কেউই তার সমালোচনা করতে পারেন না। সমালোচকদের তিনি কঠোর হস্তে দমন করেন। এভাবেই চলতে থাকে।

আসে চতুর্থ মেয়রাল নির্বাচন। ওই নির্বাচনেও প্রার্থী হওয়ার চেষ্টা করেন হেলাল আববাস। কিন্তু পারেন না। ওই নির্বাচনেও জন বিগসই পুনরায় প্রার্থী হন। এদিকে লুৎফুর রহমান নির্বাচনে দাঁড়াতে না পারলেও প্রার্থী করেন তাঁর গ্রুপের সদস্য সাবেক ডেপুটি মেয়র কাউন্সিলার অহিদ আহমদকে। অন্যদিকে লুৎফুর রহমানের সাথে বনিবনা না হওয়ায় নিজেই টাওয়ার হ্যামলেটস পিপলস অ্যালায়েন্স নামে নতুন দল গঠন করে নির্বাচনে প্রার্থী হন লুৎফুর রহমানের কেবিনেটের একসময়ের হাউজিং লীড মেম্বার রাবিনা খান। দুই বাঙালি প্রার্থী হওয়ায় সহজ হয়ে যায় জন বিগসের বিজয়। ২০১৮ সালের ৩ মে অনুষ্ঠিত চতুর্থ মেয়রাল নির্বাচনেও তিনি নির্বাচিত হন।

এখন আম গেলো, সাথে ছালাও। কেউই নেই। লুৎফুর রহমান নেই, নেই হেলাল আববাসও। সকলই ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়লেন। অনেকটা “আমিও নাই, দিদিও নাই কেমন মজা হবে” কবিতার পক্তির মতো। তবে সময় গড়িয়ে যাওয়ার সাথে সাথে দু’পক্ষই নিজেদের ভুল বুঝতে শুরু করেছেন। কেন আমরা খাল কেটে কুমির আনলাম। নিজেদের মধ্যে মারামারি করে অন্যকে কেন সুযোগ দিলাম। ঐক্যবদ্ধ থাকলে আজ কেউ আমাদের নেতৃত্ব ছিনিয়ে নিতে পারতোনা-এই বোধ জাগ্রত হচ্ছে তাঁদের দুপক্ষের মধ্যেই।

বিশ্বস্ত সুত্রের বরাতে জানা গেছে, দুই পক্ষই নিজেদের ভুল বুঝতে পারছেন। অনুতপ্ত হচ্ছেন নিজেদের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে। তাই তারা এখন নিজেদের মধ্যকার ভুলবুঝাবুঝি ভুলে আবারও বন্ধু হতে চান। হতে চান সেই আগের হরিহর আত্মা। তারা মনে করেন, যদি তাঁরা এক হয়ে যেতে পারেন, তাহলে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের নেতৃত্ব থেকে কেউ তাদের সহজে সরাতে পারবে না।

আগামী ২০২২ সালের মেয়র নির্বাচনে লুৎফুর রহমান নির্বাচন করতে পারবেন। ততদিনে তাঁর বিরুদ্ধে দেয়া আদালতের নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা শেষ হয়ে যাবে। দুই বন্ধু, দুইপক্ষ একীভুত হয়ে গেলে লুৎফুর রহমানের বিজয় কেউ ঠেকাতে পারবে না । কারণ লুৎফুর রহমানকে দুর্নীতি, অনিয়ম ও ভোট জালিয়াতির অভিযোগে মেয়র পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিলো। অথচ বৃটিশ পুলিশ দেড় মিলিয়ন পাউন্ড ব্যয়ে দীর্ঘ এক বছর তদন্ত শেষে রিপোর্ট দিয়ে বলেছে, লুৎফুর রহমানের বিরুদ্ধে ফৌজদারী আইনে ব্যবস্থা গ্রহণের মতো কোনো প্রমাণ তাদের কাছে নেই। তাই লুৎফুর রহমানের বিরুদ্ধে আর কোনো তদন্ত করা হবে না। পুলিশের তদন্তে লুৎফুর রহমান যেহেতু ফৌজদারী অপরাধ থেকে নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন, তাই আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে আবারও মেয়র হওয়া উচিত বলে মনে করেন তাঁর রাজনৈতিক সহযোদ্ধারা। তাদের মতে, লুৎফুর রহমান ও বিলেতের বাংলাদেশী কমিউনিটির গায়ে যে মিথ্যা অভিযোগে দুর্নীতির কালিমা লেপন করা হয়েছে তাঁর জবাব দিতে তাঁকে আরেকবার মেয়র হওয়া উচিত। তাই টাওয়ার হ্যামলেটসবাসী এখন লুৎফুর-আববাস ঐক্য প্রক্রিয়ার শেষ দেখার অপেক্ষায়?

উল্লেখ্য, টাওয়ার হ্যামলেটসের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি এই ঐক্য প্রক্রিয়ার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন। পঞ্চম মেয়রাল ইলেকশনের দিনক্ষণ ঘনিয়ে এলে ঐক্যপ্রক্রিয়ার কুশিলবরা দৃশ্যমান হতে পারেন।