সিলেটের ওসমানীনগরে গত ৪ নভেম্বর ঘাতকদের হাতে নির্মমভাবে খুন হন সুমি আক্তার তিশা। সেই তিশা এক পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী বলে দাবি করছে তার পরিবার। মাটি খুঁড়ে লাশ উদ্ধার এবং বেওয়ারিশ হিসেবে দাফনের পর তার পরিচয় সনাক্ত হয়।
জানা গেছে, তিশার বাড়ি লক্ষীপুর জেলার রামগঞ্জ থানার নয়নপুর গ্রামে। তার পিতার নাম আব্দুল মান্নান। তিশার ৪ ভাই ৪ বোন। ভাইয়েরা ৪ বোনের মধ্যে ছোট এবং তিশাও ৩ বোনের মধ্যে ছোট ছিলেন। ১ ভাই বড় বোন নাজমা বেগমের সাথে নারায়নগঞ্জে থাকেন এবং অন্য ৩ ভাই গ্রামের বাড়িতেই থাকেন। তিশা এসএসসি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। নারায়নগঞ্জ শহরে ভূইঘর এলাকায় বড় বোনের বাসায় থেকে একটি প্রাইভেট ক্লিনিকেও চাকরি করতেন তিনি। সেখানেই পুলিশ কর্মকর্তা শাহনেওয়াজ জয়ের সাথে তার পরিচয় হয় তিশার। পরিচয়ের সূত্র ধরে প্রেমের সম্পর্কে প্রায় ৭-৮ বছর পূর্বে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। কিন্তু বিবাহিত জয়ের প্রথম স্ত্রীর ২ ছেলে ও ১ মেয়ে থাকলেও তিশার কাছে তিনি সে কথা গোপন রাখেন। জয়ের বাড়ি নরসিংদী জেলায়। তিশার পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
তিশার বড় বোনের মেয়ে বৃষ্টি আক্তার মারজান জানান, ৩ নভেম্বর নানাকে দেখার জন্য তিশা নারায়নগঞ্জ থেকে গ্রামের বাড়িতে যান। ৪ নভেম্বর ভোরে তিনি সেখান থেকে বের হন। ওইদিন রাত থেকে তার ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরটি বন্ধ দেখায়। বিভিন্ন স্থানে আমরা তার সন্ধান করে খোঁজ পাইনি। কয়েকদিন পর এক পুলিশ আমাদের ফোন করে জানান- তাকে খুন করা হয়েছে।
তিশার বড় বোন নাজমা বেগম জানান- বিয়ে পর পুলিশ কর্মকর্তা জয় তিশাকে নিয়ে নারায়নগঞ্জ শহরে ভাড়া বাসায় থাকতেন। বেশ কয়েকটি বাসাও পরিবর্তন করেন তারা। জয় এবং তিশা ঢাকা শহরে এক খন্ড জমি ক্রয় করেন। জমি ক্রয় করার জন্য তিশা গ্রামের বাড়ি থেকে গরু বিক্রি করে ও কিস্তিতে ঋণ নিয়ে টাকা দেন। এছাড়া তিশা জয়ের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টেও টাকা জমা রাখতেন। জয় রাজারবাগ পুলিশ লাইনে ক্যাশিয়ারের দায়িত্বে থাকাবস্থায় অর্থ কেলেঙ্কারিতে ধরা পড়েন। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে মামলা হলে ডিবি অফিসে নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জয়ের সাথে তিশাকে নিয়েও জিজ্ঞাসাবাদ করে ডিবি পুলিশ। ডিবি পুলিশের কাছে জয় টাকা আত্মসাতের কথা স্বীকার করলেও তিশা তার স্ত্রী নয় বলে অস্বীকার করেন তিনি। এনিয়ে তাদের মধ্যে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হলে তিশার কাবিনের কাগজ ছিঁড়ে ফেলেন জয়। এরপর কিছুদিন পরে জয় তাদের দুজনের নামে ক্রয়করা জমি বিক্রি করে দেন। জমি বিক্রির টাকা এবং জয়ের একাউন্টে জমা রাখা তিশার টাকাসহ প্রায় ২৫ লক্ষ টাকা নিয়ে ২০১৭ সালে জয় লাপাত্তা হন। এরপর থেকে তার খোঁজ মেলেনি। এতে তিশা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। স্বামীর কারণেই আজ তার এমন পরিণতি হয়েছে।
যেভাবে হত্যা করা হয়:
ওসমানীনগরের তাজপুর বাজার এলাকায় একটি কলোনিতে দীর্ঘদিন ধরে বসবাসকারী নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার মৃত জুনাব আলীর পুত্র রিকশা গ্যারেজ ব্যবসায়ী সেলিম মিয়া তিশাকে ফোনের মাধ্যমে প্রলোভন দেখিয়ে ৪ নভেম্বর ওসমানীনগরে নিয়ে আসে। রাত ৮দিকে সেলিম তাকে উপজেলার দয়ামীর ইউনিয়নের খালপাড় গ্রামের দেহ ব্যবসায়ী আব্দুল বারিকের বাড়িতে নিয়ে যায়। রাতে সেলিম তিশাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে অনৈতিক কাজে লিপ্ত করার প্রস্তাব দেয়। তিশা তাতে রাজি হয়নি। এতে সেলিম ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে হত্যার পরিকল্পনা করে। রাতে বারিকের সহযোগিতায় শ্বাসরোধে তাকে হত্যা করে। অন্যান্যদের সহযোগিতায় রাতেই মাটি চাপা দিয়ে লাশ ঘুম করার চেষ্টা করেন। পরদিন দুপুরে দয়ামীর বাজারের কনাইশা (র.) মাজারের পশ্চিমে একটি খালি জায়গা থেকে মাটিচাপা দেয়া অবস্থায় এক অজ্ঞাত নারীর লাশের সন্ধান পায় পুলিশ।
লাশ উদ্ধার ও হত্যাকারীরা আটক: ৫ নভেম্বর সকালের দিকে সেলিম ও বারিক ওসমানীনগর থানায় ফোন করে জানায় দয়ামীর এলাকায় এক নারীকে হত্যা করে মাটি দিয়ে রাখা হয়েছে। পুলিশ তাদেরকে কৌশলে থানায় এনে তাদের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি নিয়ে মাটি খুঁড়ে লাশ উদ্ধার করে মর্গে প্রেরণ করেন। হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে সেলিম ও বারিকসহ ৮জনকে আটক করে পুলিশ। এই ঘটনায় আব্দুল বারিককে প্রধান আসামী করে ৬ নভেম্বর ওসমানীনগর থানার এসআই সাইফুল মোল্লা বাদি হয়ে থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
পরিচয় সনাক্ত:
এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশের আটককৃতরা আদালতে ন্যাক্কারজনক এই হত্যাকান্ডের দ্বায় স্বীকার করে লোমহর্ষক বর্ণনা দেয়। কিন্তু তারা খুনের শিকার হওয়া তিশার কোনো পরিচয় দিতে পারেনি। উদ্ধারের পরদিন লাশটি বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়। লাশ উদ্ধারের পর তিশার প্যান্টের পকেটে থাকা মেমোরী কার্ডে মোবাইল নম্বর পাওয়া যায়। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ওসমানীনগর থানার এস আই মুমিনুল ইসলাম ৯ নভেম্বর রাতে ওই নম্বরে কল দিলে তিশার বড় বোন নাজমা বেগমের সাথে যোগাযোগ করে তিশার ছবি পাঠালে বোন নাজমা বেগম তিশার পরিচয় সনাক্ত করেন। সনাক্তের পর ১০ নভেম্বর রাতে তিশার মা, বাবা, বোন, বোন জামাই এবং ১২ নভেম্বর রাতে পরিবারের ১১ সদস্য ওসমানীনগর থানায় যান। পুলিশের কাছ থেকে তারা পুরো ঘটনার বর্ণনা শুনেন। পুলিশের সহযোগিতায় ঘটনাস্থল দেখেন। তিশার কবর জিয়ারত করেন। কিন্তু আইনী জটিলতা থাকায় তারা লাশ ফেরত নেননি ।
স্বামীর খোঁজ ও ঘাতকদের শাস্তির দাবি:
ঘাতকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও ফাঁসি দাবি করে তিশার পরিবারের সদস্যরা বলেন, তিশার মত আর কারো বোন বা মেয়ে যেনো এভাবে নিষ্টুর বলিদানের শিকার না হয়। স্বামী জয়ই তিশার জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছিল। প্রতারণা করে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে তিশাকে বিয়ে করেছিল। তিশার টাকা-পয়সা নিয়ে সে কৌশলে লাপাত্তা হয়ে গেছে। পুলিশ কর্মকর্তা জয় একটা প্রতারক ও চরিত্রহীন লোক। বিদেশ পাঠানোর নামে বেশ কয়েক বছর পূর্বে প্রতারণার মাধ্যমে সিলেটের এক লোকের কাছ থেকে প্রায় ৮লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেয় সে। কিন্তু সে লাপাত্তা হওয়ায় তাকে না পেয়ে মধ্যস্থতাকারী এক লোকের নামে মামলা দিলে ওই লোক জেল খাটেন। তাকে খুঁজে বের করে আইনের আওতায় এনে কঠোর শান্তি নিশ্চিত না করলে তিশার আত্মা শান্তি পাবে না।
পুলিশের বক্তব্য:
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ওসমানীনগর থানার এস আই মুমিনুল ইসলাম বলেন- তিশার স্বামী পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন বা তিনি পুলিশ বিভাগে কর্মরত ছিলেন এমন কোনো তথ্য আমাদের জানা নেই। তার পরিবারের সদস্যরাও এ ব্যপারে আমাদের কোনো তথ্য দেননি। বিষয়টি কতটুকু সত্য তা আমার জানা নেই। এসংক্রান্ত প্রমাণাদি যদি তারা আমাদের হাতে দিতে পারে তাহলে বিষয়টি আমরা তদন্ত করে দেখব।