রিপন দে, মৌলভীবাজার:
১৯৭৫-এর পট পরিবর্তনের কঠিন সময়ের পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সর্বপ্রথম যে জয় আসে তা সাবেক ডাকসুর ভিপি ও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সুলতান মোহাম্মদ মনসুরের আহমদের হাত ধরে। ১৯৮৯ সালে ডাকসু’র ভিপি পদে তার বিজয় ছিল ’৭৫ পরবর্তী আওয়ামী লীগের প্রথম আনুষ্ঠানিক কোনো জয়। সেই জয়ের মাধ্যমে তার নেতৃত্বে ’৭৫-এর পর প্রথম বঙ্গবন্ধুর ছবি স্থান পায় ডাকসু ভবনে।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার পর অনেকেই মনে করেছিলেন আওয়ামী লীগের রাজনীতি এখানেই শেষ। তাই অনেক নেতাই সে সময় ভিন্ন পথ ধরেছিলেন। কিন্তু সুলতান মোহাম্মদ মনসুর বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রতিবাদে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে প্রতিরোধ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। এ কারণে জীবনের বড় একটা সময় কাটাতে হয়ছে ভারতের মেঘালয়ের পাহাড়ে আত্মগোপনে।
’৭৫-এর পর প্রথম ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে ডাকসুর ভিপি হয়ে তিনি পাদপ্রদীপে এসেছিলেন। ১৯৬৮ সাল থেকে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে অবিচল থেকে যে রাজনীতি শুরু করেছিলেন তা আজও করে যাচ্ছেন। বর্তমানে সরকারবিরোধী ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিলেও লাখো সরকারবিরোধী কর্মীর সামনে আঙুল উঁচিয়ে বলে যাচ্ছেন ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’। বারবার বলে যাচ্ছেন, ‘আজন্ম বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে নিয়েই চলবেন’।
সৎ, পরিচ্ছন্ন ও সুনীতির ব্যক্তি সুলতান মনসুর মেধাবী, আদর্শবান ও পরীক্ষিত ছাত্রনেতা হিসেবে আশির দশকে সারা বাংলাদেশ কাঁপিয়েছিলেন। নেতৃত্বগুণে শেখ হাসিনার কাছের মানুষ হতেও তার সময় লাগেনি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আস্থাভাজন হয়ে দলের সাংগঠনিক সম্পাদক হয়েছিলেন। এর প্রমাণও দিয়েছিলেন সে সময়। দায়িত্ব গ্রহণ করে ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আন্দোলনে তার সক্রিয় রাজনীতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
কিন্তু নেত্রীয় আস্থাভাজন হয়েও ১/১১-এর পর সংস্কারপন্থী হিসেবে তাকে আখ্যায়িত করা হয়। সে সময় সংস্কারপন্থী হিসেবে আখ্যায়িত তোফায়েল আহমেদ, আবদুর রাজ্জাক, আমির হোসেন আমু, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তসহ অনেকেই দলে ফিরে আসেন। কিন্তু ফিরে আসতে পারেননি ‘৭৫ পরবর্তী পরিস্থিতিতে অস্ত্রহাতে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধের ডাক দিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া এবং আশির দশকের কঠিন সময়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের রাজনীতিকে সক্রিয় ও সুসংগঠিত করার কারিগর সুলতান মনসুর।
আওয়ামী লীগ থেকে ছিটকে পড়ে দীর্ঘদিন বঞ্চনা ও অবহেলায় থাকা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী সুলতান মোহাম্মদ মনসুর বর্তমানে সক্রিয় সরকারবিরোধী রাজনৈতিক জোট ঐক্যফ্রন্টে। জনপ্রিয় এই সাবেক ছাত্রনেতাকে নিয়ে সাধারণের মনে অনেক কৌতুহল আছে। কেন সুলতান মুনসুর আজ বিরোধী শিবিরে?
সুলতান মনসুর বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগ ছেড়ে আসিনি বরং আওয়ামী লীগ আমাকে ছেড়েছে। আমার পদ কেড়ে নেয়া হয়েছে, রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে দেয়া হয়েছে।’
তিনি অভিযোগ করেন, ‘আমার রাজনৈতিক জীবন বন্দী করে রাখা হয়েছিল। ৭৫-পরবর্তী রাজনীতিতে আমার সক্রিয় ভূমিকা, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে আমার অবস্থান, দল ও তৃণমূলে জনপ্রিয়তা, আমার সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে রাজনীতিতে সুদূরপ্রসারী এক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছি আমি।’
‘২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে সিলেট বিভাগের ১৯টি আসনের মধ্যে একমাত্র মৌলভীবাজার-২ আসনের তৃণমূল নেতাকর্মীরা একক প্রার্থী হিসেবে আমার নাম প্রস্তাব করেছিল। বাকি প্রতিটি আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী একাধিক প্রার্থী ছিলেন কিন্তু রহস্যজনক কারণে আমাকে মনোনয়ন বঞ্চিত করা হয়। কেন দেয়া হয়নি তা আমি জানি না। সে সময় আমি নেত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চাইলে প্রথম এক সপ্তাহ আমাকে দেখা করতে দেয়া হয়নি। সাতদিন চেষ্টার পর নেত্রীর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হয়।’
“তখন আমি দলের নেত্রী শেখ হাসিনাকে বললাম, ‘আপা, প্রস্তাবে আমার নাম তো একা এসেছিল; অন্য কারও নাম আসে নাই। কেন আমাকে মনোনয়ন দেয়া হয় নাই?’ তখন তিনি আমাকে বললেন, ‘একবার এমপি না হয়ে দেখ কেমন লাগে!’ আমি জানি না তিনি কেন এমন উত্তর দিয়েছিলেন। কিন্তু এমপি হওয়া তো কোনো চাকরি না যে আমি চাকরি করব। রাজনীতি একটি আদর্শ, আমি বঙ্গবন্ধুকে নেতা মেনেই তার আদর্শে জনসেবার জন্য রাজনীতিতে এসেছিলাম।”
সুলতান মনসুর বলেন, ‘১৯৬৮ সাল থেকে বঙ্গবন্ধু-তাজউদ্দিনের আওয়ামী লীগের রাজনীতি শুরু করি। আমাকে দল থেকে যে দীর্ঘসময় দূরে রাখা হয় তখনও চিন্তার জায়গা থেকে সবসময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছিলাম। আমি আজন্ম সেই আদর্শে রাজনীতি করে যাব। কোনো হুমকি বা কোনো বাধা-বিপত্তি বা কোনো লোভ-লালসা আমাকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে পারবে না।’
‘ষড়যন্ত্র করে আমাকে যখন রাজনীতি থেকে দূরে রাখা হলো তখন আমার সামনে দুটি পথ খোলা ছিল। একটি হলো, রাজনীতি ছেড়ে দেয়া; আর অন্যটি, রাজনীতিতে সক্রিয় থাকা। কিন্তু রাজনীতি না করে মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে থাকা আমার জন্য সম্ভব ছিল না। এ কারণে দ্বিতীয়টি বেছে নিয়েছি। ৭৫-এ যখন অনেকে লোভে বা কেউ ভয়ে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি থেকে দূরে সরে যান, ওই সময় আমি সুলতান রাজপথে ছিলাম। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করেছি , প্রতিরোধ আন্দোলনে যোগ দিয়েছি। সেই প্রতিবাদের কারণে দীর্ঘ কয়েক বছর পাহাড়ে কাটিয়েছি। এরপর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ সারাদেশব্যাপী ছাত্রলীগকে সংঘটিত করেছি। আমার রাজনীতির জীবন কেটেছে রাজপথের উত্তাল পিচঢালা পথে, সরকারবিরোধী আন্দোলনে।’
‘মাত্র পাঁচ বছর, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সরকারি দলে ছিলাম। তখন সারাদেশ ঘুরে দলকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে গড়ে তুলতে তৎপর থেকেছি। ছাত্রজীবন থেকে শুরু করা সেই রাজনীতি ছেড়ে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই দীর্ঘ অপেক্ষার পর আমি ফের সক্রিয় রাজনীতি শুরু করি।’
তিনি বলেন, ‘আদর্শের রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলাম সবসময়। মৃত্যুকে পরোয়া না করে স্বাধীনতাবিরোধী এবং তাদের দোসরদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সারাজীবন রাজপথে লড়াই করে মুজিব আদর্শের জানান দিয়েছি। পদ নাও থাকতে পারে, কিন্তু আওয়ামী লীগের সুলতান মনসুর হিসেবেই আমি রাজনীতিতে সক্রিয় থাকব। আমার অন্তরে মুজিব আদর্শ, মুখে জয় বাংলা স্লোগান এবং গায়ে মুজিব কোট পরেই আজীবন রাজনীতি করে যাব। রাজনীতি কোনো চাকরি বা ব্যবসা নয়। রাজনীতি হচ্ছে ঈমানের অঙ্গ, জনসেবা ও দেশের মানুষের জন্য, জনকল্যাণের জন্য কাজ করে যাওয়াই আমার রাজনীতির লক্ষ্য। জনসেবা করতে হলে এমপি হলেই করতে পারব, নয়তো পারব না- এমন কোনো কথা নেই।’
‘তবে আগামীতে যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয় আমি মুজিব কোর্ট গায়ে দিয়ে এবং জয় বাংলা বলেই নির্বাচন করব। তখন দেখা যাবে যারা আমাকে অন্যায়ভাবে মনোনয়ন দেয়নি তারা সঠিক ছিল, নাকি আমি সঠিক ছিলাম!’
ডাকসুর সাবেক ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আরও বলেন, “১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে স্বপরিবারে হত্যার প্রতিবাদে সিলেট থেকে প্রথম সশস্ত্র প্রতিবাদ মিছিল করেছিলাম আমি। সারাদেশে কারফিউ আর সেনা তৎপরতার মুখে যখন টুঁ-শব্দটি করার উপায় ছিল না, তখন ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে কাপিয়েছি। সেই সময়ে দেশব্যাপী ১০৪ জন শহীদ হয়েছিলেন। আমিও মারা যেতে পারতাম, কিন্তু মৃত্যুকে পরোয়া না করে সারাদেশ ও বিশ্ববাসীকে জানান দিয়েছিলাম যে, বঙ্গবন্ধুর বাংলার সব সন্তান বেঈমান হয়ে যায়নি। সেদিন জীবনবাজি রেখে যে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়, তাতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বঙ্গবন্ধুর মান উজ্জ্বল হয়।’
‘বিশ্ববাসীর টনক নড়ে যে, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে দেশের ভেতরে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ হচ্ছে। সেই প্রতিরোধের কারণে শাসকদের চক্ষুশূলে পরিণত হয়ে জীবন বাঁচাতে এবং আদর্শের প্রতি অবিচল থেকে দীর্ঘ চারটি বছর না খেয়ে, না ঘুমিয়ে, নির্ঘুম অনেক রাত কাটিয়েছি ভারতের মেঘালয়ের গারো পাহাড়ের পাদদেশে ঘন বনাঞ্চল ঘেরা দুর্গম পাহাড়ি এলাকায়।’
‘সেই আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে ধারণ করেও দলে থাকতে পারিনি। গভীর ষড়যন্ত্রের মুখে পতিত হয়েছি। কিন্তু যারা বঙ্গবন্ধুর বিরোধী ছিল, বঙ্গবন্ধুর সমালোচনা করে চামড়া খুলে নিতে চেয়েছিল, তারা এখনও ঠিকই দলে আছে। এই আওয়ামী লীগ আর সেই আওয়ামী লীগ নেই। এটা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের আওয়ামী লীগ নয়।’
আসছে নির্বাচনে প্রার্থী হবেন কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটি নির্ভর করে নির্বাচনের পরিবেশের ওপর। আমি সুলতান কোনো পাতানো বা ভোটারবিহীন প্রহসনের নির্বাচনে প্রার্থী হব না, সেটা নিশ্চিত। তবে স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে প্রার্থী হব। জনসেবা ও জনকল্যাণের জন্য রাজনীতি করি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি সারাজীবন করে যাব। বঙ্গবন্ধুর আজীবনের সংগ্রাম ছিল মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকারের জন্য। সেই অধিকারের জন্য কাজ করে যাব।’
১/১১-এর সময় নিজের ভূমিকা প্রসঙ্গে সুলতান মনসুর বলেন, ‘তখন মরহুম রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান ও সৈয়দ আশরাফের নেতৃত্বে যে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছিল আমি সেই মূলধারায় ছিলাম। বরং তখন যারা ঘোষণা দিয়ে সংস্কার চেয়েছিল তারা এখন ঠিকই দলে আছেন।’
‘গণতন্ত্র ও মুক্তির সংগ্রামের চেতনায় একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে জাতীয় ঐক্যের পতাকাতলে সমবেত হয়ে প্রতিটি বাঙালি জেগে উঠবে। জনগণের অধিকার জনগণকে ফিরিয়ে দিতে হবে’- এমন প্রত্যাশা রাখেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের এই সৈনিক।