সিলেটের উপশহরে ছাত্রলীগকর্মী জাহিদ খুনের পরপরই উপশহর ছেড়ে পালিয়েছে ছাত্রলীগকর্মী রাহাত। সঙ্গে তার মা, বাবা এবং ভাইও। ঘটনার পর থেকে রাহাতের খোঁজে পুলিশ অভিযান চালালেও পায়নি।
রাহাতের মূল বাড়ি হবিগঞ্জের মাধবপুর এলাকায়। প্রায় ১৫-১৬ বছর পরিবার-পরিজন নিয়ে রাহাত বসবাস করে নগরীর উপশহর এলাকায়। আগে বসবাস করতো কলোনিতে। এখন ই-ব্লকের ১ নম্বর রোডের একটি নির্মাণাধীন বাসার নিচতলায় তারা বসবাস করছিলো।
নিহত ছাত্রলীগকর্মী হোসাইন আল জাহিদের সঙ্গে রাহাতের শত্রুতা পুরনো। দুইজনই এক সময় উপশহর ছাত্রলীগের সুমন গ্রুপের কর্মী ছিল। তখন থেকে নানা ঘটনায় তাদের মধ্যে বিরোধ হয়। এই বিরোধের জের ধরে গত বছর জাহিদ ও সহপাঠীরা উপ-শহরের এক নম্বর রোডে রাহাতের উপর হামলা চালায়। তারা রাহাতকে ছুরিকাঘাত করে। এতে রাহাত গুরুতর আহত হয়েছিল। ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ শেষে সুস্থ হয় রাহাত। কিন্তু জাহিদের উপর তার ক্ষোভ কমেনি। সেটি জানতেন তাদের দলের সিনিয়র ভাইয়েরা। কিন্তু সমঝোতার উদ্যোগ নেননি। ঘটনার পর পুলিশ হাবিব নামের এক দোকানিকে ধরে নিয়ে আসে। তাকে শাহ্পরাণ থানায় নিয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
পুলিশ জানায়- খুনের ঘটনার আগে রাহাতের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের কিছুসংখ্যক কর্মী ওই এলাকায় অবস্থান করছিলো। আর ওই সময় এলাকা দিয়ে যাওয়ার পথে জাহিদের ওপর হামলা চালানো হয়। খুনের ঘটনার পর রাহাত ও তার সহযোগীদের গ্রেপ্তারে পুলিশের পক্ষ থেকে অভিযান চালানো হলেও তাদের পাওয়া যায়নি। পুলিশ প্রযুক্তির আশ্রয় নিয়ে খুনিদের গ্রেপ্তারে অনুসন্ধান চালিয়েছে।
পুলিশের এক সিনিয়র কর্মকর্তা জানিয়েছেন- খুনের ঘটনার পর থেকে রাহাতের মোবাইল ফোন বন্ধ রয়েছে। তবে তার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কারও কারও মোবাইল ফোন খোলা রয়েছে। রাহাতের সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ রয়েছে কী না সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
স্থানীয় এক নম্বর রোডের বাসিন্দা এবং ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন- রাহাতের পিতামাতা অনেক আগে থেকেই উপশহর এলাকায় বসবাস করেন। রাহাতের মা একসময় কাজের বুয়া হিসেবে বিভিন্ন বাসায় কাজ করেছেন। তার পিতা মাঝে-মধ্যে আসতেন। তার ভাই ওবায়দুল পেশায় রাজমিস্ত্রী। অভাব-অনটনের সংসার হলেও রাহাত উপ-শহরে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে বখে যায়। বিভিন্ন গ্রুপ ঘুরে সে আশ্রয় নেয় ছাত্রলীগের জাকারিয়া মাহমুদ গ্রুপের বলয়ে। বর্তমানে ওই বলয়ে তার অবস্থান থাকলেও প্রতিপক্ষ জাহিদের অবস্থান ছিল সুমন গ্রুপে। বৃহস্পতিবার স্থানীয় তিব্বিয়া কলেজের সামনে জাহিদের ওপর হামলার পরও এলাকায় ছিলো রাহাত। কিন্তু সন্ধ্যার একটু পর তার মাসহ তারা বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। এ সময় হাতে ব্যাগ ছিল। এরপর থেকে তারা আর ভাড়া বাসায় ফিরেনি। স্থানীয়দের কাছে তারা বলে যায় নিজ বাড়িতে যাচ্ছে। জরুরি কাজে যাচ্ছেন বলে প্রতিবেশীর কাছে জানিয়ে যান।
রাহাতের সহপাঠীরাও উপশহরে নেই। তারাও পালিয়ে গেছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, উপশহরে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে উঠতি বয়সী যারা জড়িত তারা অনেকেই কলোনির বাসিন্দা। উপ-শহরে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, জমিদখল সহ নানা ঘটনায় তাদেরকে রাজনৈতিক কর্মীরা ব্যবহার করে। এভাবেই একেক ঘটনায় জড়িত হয়ে অছাত্ররাই সম্পৃক্ত হয় ছাত্রলীগের রাজনীতিতে। এজন্য তাদের কারণেই আজ উপশহর রক্তাক্ত এলাকায় পরিণত হয়েছে বলে জানিয়েছেন তারা। কয়েক মাস আগে মিন্নত নামে এক ছাত্রলীগকর্মীর ওপরও একইভাবে হামলা চালিয়েছিল প্রতিপক্ষ গ্রুপের কর্মীরা। এ ঘটনায় মিন্নতের এক হাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হাত ক্ষতিগস্ত হলেও সুস্থ হয়ে ফিরে এসে মিন্নত আবারো ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত হয়েছে।
শাহ্পরাণ থানার ওসি আক্তার হোসেন জানিয়েছেন- ঘটনার পর পুলিশ স্থানীয় দোকানদার হাবিবকে আটক করে থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তার কাছ থেকে পুলিশ তথ্য পেয়ে কাজ শুরু করেছে। তিনি বলেন, উপশহর থেকে পালালেও খুনের ঘটনায় জড়িতদের পিছু ছাড়ছে না পুলিশ। তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
এদিকে সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সমাজসেবা বিষয়ক সম্পাদক জাকারিয়া মাহমুদ গ্রুপের কয়েকজন নেতা জানিয়েছেন, উপশহরে এখন ছাত্রলীগের সুমন গ্রুপ ছাড়া আর কারো অবস্থান নেই। জাকারিয়া মাহমুদ উপশহরে রাজনীতি করে না। যেখানে তার বলয় নেই সেখানে খুনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার কথা নয়। এখন সুমন গ্রুপের কর্মী হচ্ছে রাহাত সহ অন্যরা।
শাহ্পরাণ থানা পুলিশের সিনিয়র কর্মকর্তারা জানিয়েছেন- খুনের ঘটনার পরপরই তারা অনুসন্ধান চালিয়ে হামলাকারীদের তথ্য বের করার চেষ্টা করেন। এ সময় তারা রাহাত সহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করতে অভিযান চালান। কিন্তু কাউকেই পাওয়া যায়নি। এমনকি রাহাতসহ কয়েকজনের পরিবারের সদস্যরাও গা-ঢাকা দিয়েছে। তারা জানান- যারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত তারা অনেকেই উপশহরের স্থানীয় বাসিন্দা নয়। এ কারণে তাদের খুঁজে বের করা সম্ভব হচ্ছে না।
এদিকে ছাত্রলীগকর্মী খুনের ঘটনায় ৯ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেছেন জাহিদের বাবা আবুল কালাম। শাহপরান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আখতার হোসেন জানান, শনিবার বিকেলে এ মামলা দায়ের করা হয়। মামলায় ৯ জনের নাম উল্লেখ ছাড়াও অজ্ঞাতনামা আরও ১০/১৫জনকে আসামি করা হয়।
আরিফুল রহমান নামে এই মামলার এজাহারভূক্ত এক আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানান ওসি। তবে বাকি আসামিদের নাম জানাতে চাননি।
প্রসঙ্গত, গত বৃহস্পতিবার বিকেলে সিলেট নগরীর উপশহরে ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হন সীমান্তিক স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী হোসাইন আল জাহিদ। ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পরে তিনি মারা যান। জাহিদ নগরীর তেররতন সৈদানীবাগ ১৯/৩৭নং বাসার কামাল মিয়ার ছেলে।