ফয়সল মাহমুদ, স্পেন থেকে লন্ডন ফিরে:
ভাগ্য বদলানোর আশায় অবৈধভাবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রবেশের চেষ্টাকালে প্রাণ হারাচ্ছে বাংলাদেশীরা। আফ্রিকা ও আরবের বিভিন্ন দেশ থেকে স্পিডবোটে করে ভূমধ্যসাগর কিংবা আটলানন্টিক মহাসাগর হয়ে তুরস্ক কিংবা গ্রিসে পৌঁছতে পথিমধ্যেই সলিল সমাধি হচ্ছে অনুপ্রবেশকারীদের। আবার আফ্রিকার দেশ মরোতানিয়া রুটে সাহারা মরূভূমি হয়ে পর্তুগাল ঢোকার চেষ্টাকালে সাহারা মরুভূমির দূর্গম পথ পাড়ি দিতে গিয়ে অনাহারে অনেকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এরমধ্যে অনেকে অবৈধভাবে প্রবেশের চেষ্টাকালে আইনশৃংখলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে বন্ধিজীবন কাটাচ্ছেন। আবার দালালের খপ্পরে পড়ে অনেকে জিম্মি জীবনযাপনও করছেন। মুক্তির জন্য দেশ থেকে ভিটে মাটি বিক্রি করে টাকা পয়সা দিয়েও মিলছেনা তাদের মুক্তি। বর্তমানে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টায় লিবিয়ার কারাগারে ২৮০জন বাংলাদেশি নাগরিক বন্দি রয়েছেন। লিবিয়াস্থ বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শেখ সেকান্দর আলী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে বিষয়টি জানিয়েছেন।
ইউরোপের অন্যতম প্রবেশদ্বার স্পেন সফরকালে বিভিন্ন দালালের মাধ্যমে স্পেনে যারা এসেছেন তাদের সাথে আলাপকালে জানা যায়, বর্তমানে মানবপাচারকারী দালালচক্র ইউরোপের ঢোকার জন্য যুদ্ধ বিধস্ত লিবিয়াকে নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করছে। দালালদের মাধ্যমে আসা বেশির ভাগ বাংলাদেশী চেষ্টা করেন লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে তুরস্ক হয়ে ইউরোপের দেশ গ্রিস কিংবা ইতালিতে অনুপ্রবেশের। লিবিয়া থেকে দালাল মাধ্যমে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে অনেকেই প্রাণ হারাচ্ছেন। লিবিয়া থেকে দালালরা স্পিড বোডে তুরস্ক কিংবা গ্রিসে মানবপাচারের চেষ্টা করে থাকে।
লিবিয়া হয়ে গ্রিসে আসা আফজাল জানান, রাতের আধারে দালালেরা একটি স্পিডবোটে করে ২০জন যাত্রী ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে গ্রিসে অনুপ্রবেশ করায়। অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে ভূমধ্যসাগরের মধ্যে স্পিডবোটটি গ্রিসের দিকে ছুটতে থাকে। গভীর রাত সাগরের উত্তাল গর্জন আর বর্ডার গার্ডদের চোখ রাঙানি সব মিলিয়ে ৩ ঘন্টার নৌপথটি আমার কাছে একটি বিভীষিকাময় রাত ছিল। স্পিডবোটটি যখন মধ্যসাগরে অবস্থান করছিল তখন ঝড়ের কবলে পড়ে। প্রচন্ড ঝড়ে অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই স্পিডবোটটি বারবার সাগরের পানির মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে আবার কখনোও সাগরের উত্তাল ঢেউয়ে আছড়ে পড়ছে প্রায় ২০ থেকে ৩০ ফুট উপরে। আমরা সবাই কালেমা পড়ে মৃত্যুর প্রহর গুণছিলাম। এর কিছুক্ষণ পর ঝড় থামলে আমাদের স্পিডবোটটি গন্তব্য হারিয়ে বর্ডার গার্ডের হাতে ধরা পড়ে। আমিসহ সবাই লিবিয়ার কারাগারে ৫ মাস বন্দি থাকি।
দালালদের মাধ্যমে স্পেনে আসা সিলেটের ইমরান জানান, তিনি যে স্পিডবোট দিয়ে লিবিয়া থেকে তুরস্ক এসেছিলেন সেই স্পিড বোটের ১৯ যাত্রীর মধ্যে ২জন স্পিডবোটেই মারা যান। তাদের বাড়ি সিলেটের গোলাপগঞ্জ ও কানাইঘাটে। তিনি বলেন, ভূমধ্যসাগরে লিবিয়া থেকে যখন স্পিড বোটটি যাত্রা শুরু করে তখন রাতের মধ্যেই তুরস্ক পৌঁছানোর চেষ্টা থাকে। তাই প্রচণ্ড স্পিডে, বোটটি চলতে থাকে। কিন্তু আমাদের স্পিডবোটটি তুরস্কের কাছাকাছি আসতেই আইনশৃংখলা বাহিনীর চোখে ধরা পড়ে এবং তারা গতিরোধ করে। ফলে প্রায় ৪ ঘন্টা সময় ধরে প্রচণ্ড গতিতে চলতে থাকা স্পিডবোটটির যাত্রীদের মধ্যে বমি শুরু হয়। বমি করতে করতে এরমধ্যে দুজনের অবস্থা বেগতিক হলে তাদের বোটেই মৃত্যু হয়। সবচেয়ে কষ্টদায়ক ছিল দুই বাংলাদেশির লাশ দালাল কর্তৃক ভূমধ্যসাগরে ভাসিয়ে দেয়ার দৃশ্য। আমরা এর প্রতিবাদ করলে দালালরা জানায় বেশি চেঁচামেচি করলে সবাই গ্রেফতার হয়ে জেল কাটতে হবে। তাই আর কেউ প্রতিবাদ করেনি।
ইউরোপে ঢোকার আরেক পথ হলো আলজেরিয়া থেকে মরোতানিয়া হয়ে সাহারা মরুভুমি পর মরক্কো হয়ে পর্তুগাল। এই রুটের সবচেয়ে ভয়ানক প্রান্তর হলো সাহারা মরভূমি। এই সাহারা মরুভুমি পায়ে হেঁটে পাড়ি দিতে হয়। সাহারা মরুভুমি পায়ে হেঁটে পাড়ি দিতে প্রায় এক সপ্তাহ খানেক সময় লেগে যায়। এক সপ্তাহ পায়ে হাঁটার পথে পানাহারের জন্য দু’বোতল তরল পানি ছাড়া আর কিছু বহন কর দালালচক্র নিরাপদ মনে করেনা। দালালরা যাত্রীদের তাড়াতাড়ি পথ পাড়ি দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করে। সাহারা মরুভুমিতে যখন যাত্রীরা পথ পাড়ি দিতে রওয়ানা হন তখন তাদের অনুসরন করতে থাকে অন্য দালাল সদস্যরা। আইনশৃংখলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে চলতে থাকে দূর্গম পথ পাড়ি দেওয়ার প্রয়াস। অনেক সময় এই পথ এক সপ্তাহতে শেষ হয় আবার পথে ঝামেলা হলে বিলম্ব হয়। যাত্রাপথে পানি শেষ হলে শুরু হয় যাত্রীদের আর্তনাদ। প্রচণ্ড গরম আর তৃষ্ণার্থ প্রাণ খাদ্যের জন্য হাহাকার করতে করতে শেষ নিংশ্বাস ত্যাগ করে। আর যারা সাহারা মরুভুমি পাড়ি দিতে পারেন তারা মরক্কোতে পৌঁছান। সেখানে শুরু হয় দিন গণনা, কবে ঢুকতে পারবেন পর্তুগাল কিংবা স্পেনে।
এদিকে দালালদের মাধ্যমে যারা ইউরোপে ঢুকতে পেরেছেন তাদের মাথা গোজার জন্য জীবন যুদ্ধে নামতে হয়। প্রথমে তাদের বাসস্থানের জন্য পরিচিত জনদের কাছে ধর্ণা দিতে হয়। বাসস্থানের পর কাজের জন্য মিথ্যে চেষ্টা করতে হচ্ছে। ইউরোপের যেকোন দেশে যেমন স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি কিংবা পর্তুগালে কাজের পারমিট ছাড়া কাজ পাওয়া সম্ভব নয়। যারা অ্যাসাইলাম কিংবা হিউম্যান রাইটসে থাকার জন্য আবেদন করেন তাদের আবেদন বিবেচনা কিংবা আমলে নিতে প্রায় ৮ মাস সময় লেগে যায়। কোনো কোনো দেশে কোনো ক্ষেত্রে আরো বেশি সময় লাগে। আবেদন গ্রহণের আগ পর্যন্ত প্রত্যেকে মানবেতর জীবনযাপন করে থাকেন। আবেদন গ্রহণ হলে কিছু ভাতা পেয়ে থাকেন। যা দিয়ে তারা হাত খরচ চালাতে পারেন। কিন্তু কাজের পারমিট পাওয়ায় আগ পর্যন্ত তাদের অনেককে রাস্তায় ফুল, ঘড়ি বিক্রি কিংবা লিপলেট বিতরন করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। তবে যখন তারা ইউরোপের কোনো একটি দেশে বৈধভাবে বসবাসের কাগজপত্র পেয়ে যান তখন তাদের জন্য সমস্ত ইউরোপ (ইংল্যান্ড ছাড়া) উন্মুক্ত হয়ে যায় ।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া হয়ে ইউরোপ পর্যন্ত দালালদের একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে। তারা বিশেষ করে প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেট অঞ্চলে বেশি সক্রিয়। তারা প্রতারনার মাধ্যমে মানবপাচারের সাথে জড়িত। তাদের প্রতারণার শিকার হয়ে অনেকে ইউরোপে পাড়ি দিতে গিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন। আবার কেউ কেউ আইনশৃখংলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে কারাগারে বন্দি জীবনযাপন করছেন।
দালালদের দ্বারা প্রতারিত হয়ে দীর্ঘ পাঁচ মাসে স্পেনে আসা সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার সুমন জানান, দাললারা আমার সাথে চুক্তি করে ১ মাসের মধ্যে ৮ লাখ টাকায় স্পেনে পৌঁছানোর। তারা বলে লিবিয়া হয়ে খাল পাড়ি দিয়ে তুরস্ক হয়ে আমাকে স্পেনে পৌঁছে দিবে। সেই জন্য মধ্যস্থতাকারীর কাছে অগ্রীম ৮ লাখ টাকা জমা রাখা হয়। লিবিয়া আসার পর দালালরা সেই ৮ লাখ টাকা মধ্যস্থতাকারীর কাছ থেকে তুলে নেয়। পরে আমাকে জিম্মি করে তারা আমার পরিবারের কাছে আরো ৪ লাখ টাকা দাবী করে। পরিবার বাধ্য হয়ে দালালদের হাতে আরো ৪ লাখ টাকা তুলে দেয়। এর পরেও দালালরা আমাকে লিবিয়ায় প্রায় ৪ মাস অনাহারে অর্ধাহারে রাখে। আমি দালালদের কাছে আমাকে স্পেন পৌঁছানোর তাগিদ দিলে তারা আমার সাথে নানা টালবাহানা শুরু করে। পরে তারা চার দফা চেষ্টার পর স্পিডবোটে তুলে ভূমধ্যসাগর নৌ পথে পাড়ি দিয়ে তুরস্কে পৌঁছায়। অথচ তারা আমাকে বলেছিল লিবিয়া থেকে একটি খাল পাড়ি দিয়ে তুরস্ক ঢোকে সেখান থেকে তারা আমাকে স্পেনে পৌঁছে দিবে। তিনি জানান, দালালরা যাকে খাল বলে তা আসলে একটি সাগর। আর সাগরকে খাল মনে করে পাড়ি দিয়ে গিয়ে অনেকেই প্রাণ হারাচ্ছেন।
বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানিকারক ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০১৫ সাল থেকে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ রয়েছে লিবিয়ায়। কিন্তু বর্তমানে লিবিয়া হয়ে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টাকালে আটক হয়ে ২৮০ জন বাংলাদেশি নাগরিক লিবিয়ার কারাগারে বন্দি রয়েছেন। তারা চলতি বছরের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সুদান, মিশর, আলজেরিয়া, মরোতানিয়া, মরক্কো থেকে লিবিয়ায় সাগর পথ পাড়ি দেওয়ার সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়েছেন। আটককৃত কারো কাছে লিবিয়ার ভিসা ছিলো না।
সার্বিক বিষয়ে স্পেনে অবৈধ অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা একটি সংগঠনের সভাপতি ফজলে এলাহি বলেন, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অবৈধভাবে ঢোকার জন্য দালালরা স্পেনকে বেছে নেয়। ফলে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকালে অনেকে আটক হয়ে বন্দি জীবন কাটাচ্ছেন। আমি বলবো দালালদের মিথ্যে আশ্বাসে অবৈধ পথে না এসে সেনজেন ভিসা নিয়ে আসার চেষ্টা করুন। আশার কথা আগামীতে স্পেনে এগ্রিকালচার ভিসা (কৃষি ভিসা) চালু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সাগর পথে আসতে গিয়ে আপনারা আপনার মায়ের বুক খালি করবেন না।