জীবিকার টানে সারাদিন মাঠে গরু চড়ানো এক রাখাল বালক আবদুল করিম।
আপন মনেই গান বাঁধতেন তিনি, ভাটির গান, মাটি ও মানুষের গান।
সেইসব গান ছড়াতে থাকে একের পর এক, মানুষের কানে, হৃদয়ে।
ছড়াতে ছড়াতে একদিন পৌঁছে যায় ভাসানি, সোহরাওয়ার্দী এমনকী শেখ মুজিবুর রহমানের কাছেও।
সেইসব নিয়ে গল্পও আছে অনেক।
করিমের গান শুনে একদিন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তাকে উপহারস্বরুপ একশ পচাশি টাকা দিয়েছিলেন।
শেখ মুজিব একদিন ১১ টাকা দিয়ে বলেছিলেন, তোমার মতো শিল্পীকে উপযুক্ত মর্যাদা দেয়া হবে।
সত্যিই উপযুক্ত মর্যাদা পেয়েছিলেন করিম, আপন সৃষ্টির বলে রাখাল বালক থেকে হয়েছিলেন- বাউলসম্রাট।
ভাটি অঞ্চলের পুরুষ শাহ আবদুল করিম।
জন্ম, ধলআশ্রম গ্রামে।
এটির অবস্থান বাংলাদেশের পূর্বকোনে, সিলেটে অবস্থিত সুনামগঞ্জের দিরাই থানায়।
তার বাবা ইব্রাহীম আলী ছিলেন একজন দিনমজুর।
ঠিকমতো তিনবেলা চুলা জ্বলতো না মা নাইওরজান বিবির রান্না ঘরে।
পরিবারের একমাত্র ছেলে হওয়ায় তাই প্রচুর চাপ ছিলো করিমের উপর।
অল্প ক’দিন যেতে পেরেছেন বিদ্যালয়ে।
কাজে নামতে হয়েছে তাকে অভাব আর ক্ষুধাকষ্টে।
তবুও, সব কষ্ট আস্তে ধীরে উৎরে যাওয়ার সফরে হাঁটছিলেন আবদুল করিম।
এই বিস্তৃত সফরে একমাত্র অনুপ্রেরণা ছিলো তার দ্বিতীয় স্ত্রী আফতাবুন্নেসা।
আবদুল করিম তাকে আদর করে ডাকতেন ‘সরলা’ বলে।
এমনই ভালোবাসতেন যে, সরলা’র মৃত্যুর পর তার কবর দেওয়া হয় নিজের ঘরের উল্টো দিকের ভিটায়।
যেন তাকে কাছেই রাখা যায়, যেন তার কাছেই থাকা যায়।
তার গান শোনায় ভাটি অঞ্চলের মানুষের জীবনের সুখ-দুঃখ, আশা-হতাশা, প্রেম-ভালোবাসার গল্প।
তার গান কথা বলে সকল অন্যায়, অবিচার, কুসংস্কার আর সাম্প্রদায়িকতার বিরূদ্ধে।
এই গানই তাকে জন্মগ্রাম ছাড়তে বাধ্য করেছিলো ধর্মীয় বিধি নিষেধের বলে।
ফলে, ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি জন্ম নেয়া এই মহান মানুষটি, ১৯৫৭ সাল থেকে জন্মগ্রামের পাশের গ্রাম উজানধল-এ স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
তবুও থামেননি প্রায় দেড় সহস্রাধিক গানের জন্মদাতা এই বাউল সম্রাট।
থেমেছেন.. জীবনের একদম শেষ প্রান্তে এসে।
বার্ধক্য তাকে জেঁকে ধরেছিলো।
দীর্ঘদিন অসুস্থও ছিলেন শাহ আবদুল করিম।
তারপর, ২০০৯ সালের এক মেঘলা দিনে, ওপারে চলে যান আবদুল করিম।
তার শেষ নিঃশ্বাসের ব্যাথাতুর স্বাক্ষী, সিলেটের নুরজাহান পলি ক্লিনিকের আইসিইউ।
এত মায়া, এত প্রেম, এত প্রয়োজন; সব কিছু ছেড়ে চলেই যেতে হলো তাকে।
আজ সেই ১২ সেপ্টেম্বর।
বাউল সম্রাটের চলে যাওয়ার দিন।
তিনি নেই, এই এক অপূরণীয় শূণ্যতা; এই বাংলার মাটি ও মানুষের জন্য।