মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অভিযানের কারণে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার বাংলাদেশে পালিয়ে আসার এক বছর এ মাসে পূর্ণ হয়েছে। একই সঙ্গে এ মাসে কক্সবাজারে ভরা বর্ষা মৌসুম শুরু হয়েছে। সেখানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা বাস করছে। মিয়ানমারের সেনাদের ২০১৭ সালের অভিযানকে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনার জাতি নির্মূল অভিযানের উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। রাখাইনের সেনা অভিযানের বিষয়ে তিনি বলেছেন, সেখানে গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। সবচেয়ে সুপরিকল্পিত ও বড় মাত্রায় হলেও অভিযানটি সর্বপ্রথম অভিযান ছিল না।
এর আগে ২০১২ ও ২০১৬ সালের অভিযানে এক লাখেরও বেশি মানুষ দেশের অভ্যন্তরেই বাস্তুচ্যুত হয়। তারা খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা, আশ্রয়ের দিক দিয়ে কার্যত বসবাস করছে বন্দি শিবিরে। এসব স্থানে সীমিত সুযোগ রয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক এজেন্সিগুলোর। রোহিঙ্গারা দশকের পর দশক ধরে ধারাবাহিক বৈষম্যের শিকার। তাদের রাখা হয়েছে রাষ্ট্রহীন অবস্থায়। তাদের জাতিগত স্বীকৃতি নেই। পরিচিতি নেই। এই স্বীকৃতি দেয়া হলে তাদের থাকতো সমঅধিকার।
২০১৩ ও ২০১৭ সালে অভ্যন্তরীণ আশ্রয় শিবিরগুলো পরিদর্শন করেছি। সেখানে পরিস্থিতি ভয়াবহ এবং কোনো কারণ ছাড়াই মানুষ মারা যায়। কারণ, তাদের চলাফেরায় নৃশংস বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। তাদের টিকে থাকার জন্য যে সহায়তা প্রয়োজন তার রয়েছে ভীষণ সংকট।
মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর সে দেশের সেনাবাহিনী যে ভয়াবহ নির্যাতন চালিয়েছে সে বিষয়ে আমি অনেক বছর প্রচারণা চালিয়েছি। এ নৃশংসতা অং সান সুচির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে ও পরে চালানো হয়েছে। সেখানে সেনাবাহিনী অব্যাহতভাবে দায়মুক্তির সুবিধা পাচ্ছে।
মিয়ানমার গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তনকে কেন্দ্র করে যখন চারদিক থেকে সমর্থন আসছে তখন দ্রুততার সঙ্গে দেশটির ওপর থেকে বিভিন্ন অবরোধ তুলে নেয়া হয়। নাটকীয়ভাবে মিয়ানমার সরকারের ওপর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ‘লিভারেজ’ কমিয়ে দেয়। উল্লেখ্য, মিয়ানমার এখনো রয়েছে সেনাবাহিনীর কব্জায়।
গত মাসে আমি বাংলাদেশের কক্সবাজারে শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেছি। সেখানে পৌঁছেই এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল যে, মাত্র ৫ বর্গ মাইল এলাকায় বসবাস করছেন কয়েক লাখ মানুষ। তার, পুলিন ও বাঁশ দিয়ে একটির সঙ্গে একটি লাগানো অবস্থায় এসব আশ্রয় শিবির তৈরি করা হয়েছে। যতদূর চোখ যায় ততদূর শুধু এগুলোই দেখা যায়। কিছু কিছু এনজিও কক্সবাজারকে বাংলাদেশের চতুর্থ বৃহৎ শহর হিসেবে আখ্যায়িত করা শুরু করেছে।
ভারি বর্ষণের ফলে পাহাড়ি খাড়া পথগুলো অবিশ্বাস্য রকম পিচ্ছিল হয়ে পড়েছে এবং তাতে পা রাখা খুবই কঠিন। মাটি একেবারে ভেজা। বাঁশের তৈরি সাঁকো থেকে পা পিছলে মানুষ নিচে পড়ে যাওয়ার কথা শুনেছি আমি। শুনেছি এ কারণে অন্তঃসত্ত্বা নারীরা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে যেতে পারেন না। আমরা যখন হেঁটে যাচ্ছিলাম। তখন একটি নগ্ন শিশু পানি ও হলুদ কাদায় পড়ে যায়। তাকে তুলে আনে তার বন্ধুরা।
ভূমিধসের গুরুতর আশঙ্কার মুখে রয়েছে প্রায় ৩০ হাজার শরণার্থী। তাদের পুনর্বাসন জরুরি। এখন পর্যন্ত মাত্র ১৫ হাজার শরণার্থীকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। আগের দিনগুলোতে এই শরণার্থী শিবিরে যাওয়ার মূল পথটি চলাচলের জন্য অনুপযুক্ত ছিল ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ফলে শরণার্থীদের কাছে ত্রাণ সুবিধা পৌঁছাতে পারেনি এনজিওগুলো। এর ওপর আরো বৃষ্টি হলে তাতে পরিস্থিতির আরো অবনতি হবে। আর সামনেই আসছে ঘূর্ণিঝড়ের সময়।
আমার সঙ্গে যেসব মা কথা বলেছেন তারা জানিয়েছেন, মিয়ানমারে তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিচ্ছিল হামলাকারীরা। এ সময় তারা যখন পালাচ্ছিলেন তখন তাদের মেয়েদের তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে। তাদেরকে ধর্ষণ করা হয়েছে। হত্যা করা হয়েছে। তাদেরকে পরিবার থেকে আলাদা করা হয়েছে। একজন পিতা বেদনার সঙ্গে বলেছেন, কিভাবে তার ছেলেকে তার সামনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। আমি যখন সেখান থেকে সরে আসছিলাম তখন একজন বললেন, আমরা ন্যায়বিচার চাই।
এসব শরণার্থীর ফিরে যাওয়া নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। কিন্তু তাদের নিরাপত্তা ও নাগরিকত্বের অধিকারের নিশ্চয়তা ছাড়া এই পুনর্বাসন হতে পারে না। অন্যথা হলে, যেসব মানুষ তাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা চালিয়েছিল তাদের নিয়ন্ত্রণে কার্যত একটি বন্দিশিবিরে বসবাস করতে হবে নিন্দনীয়ভাবে।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের। সেনাবাহিনীকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে নেয়ার কথায় সমর্থন দিয়েছে কানাডা। একই সঙ্গে মিয়ানমারে যে হায়েনার মতো অপরাধ ঘটানো হয়েছে সে বিষয়ে প্রমাণ সংরক্ষণে পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানানো হয়েছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নতুন করে অবরোধ দেয়ার একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে পাস করেছে কানাডার পার্লামেন্ট।
কিন্তু এ ক্ষেত্রে বৃটেনকে আরো অনেক কিছু অবশ্যই করতে হবে। গত নভেম্বরে অধিকতর পদক্ষেপ বা অ্যাকশন নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তেরেসা মে। তিনি বলেছেন, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ, বিশেষ করে সেনাবাহিনী যে মানবিক সংকট সৃষ্টি করেছে এ জন্য তাদেরকে অবশ্যই পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব নিতে হবে।
তিনি আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে একত্রিত করতে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রাখবে বৃটেন। এরমধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে চালানো অমানবিকতা ও ভয়াবহতা বন্ধে সম্ভাব্য সব কিছু করা হবে।
কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো আমাদের সরকার দৃঢ়তার সঙ্গে মানবিক সহায়তা দিয়ে গেলেও, মিয়ানমার সরকার, সেনাবাহিনীর প্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের ওপর বাস্তবে কোনো চাপ দেয়ার মতো অবস্থায় আসেনি।
তেরেসা মে যদি এটা বুঝিয়ে থাকেন মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে পাঠানোকে সমর্থন করবে বৃটেন, তাহলে বিশ্বকে অবশ্যই ভুলে গেলে চলবে না বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা কি দুর্দশার শিকার। জাতিসংঘ তাদের জন্য যে তহবিলের আহ্বান জানিয়েছে তার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ পূরণ হয়েছে। রোহিঙ্গাদের জীবন নিরাপদ করে গড়ে তুলতে একটি পথ অবশ্যই জরুরি ভিত্তিতে বের করে আনতে হবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে।
(বৃটেনের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বৃটিশ এমপি রুশনারা আলির লেখার অনুবাদ)
মানবজমিন থেকে নেওয়া