শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ খ্রীষ্টাব্দ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ



Sex Cams

                    চাইলে বিজ্ঞাপন দিতে পারেন

আমাদের নিচু স্বভাব, তাদের তাণ্ডব এবং নিষ্ঠুর পৃথিবী থেকে এক নবজাতকের বিদায়



বিজ্ঞাপন

মাহমুদ এইচ খান:
সংকটাপন্ন এক নবজাতক রোগীকে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছেন তাঁর স্বজনরা। রাস্তায় তিনিটি জায়গায় ধর্মঘট পালনকারী পরিবহণ শ্রমিকরা তাদের আটক করে ঘন্টাধিক সময় নষ্ট করে আবার ছেড়ে দেয়। সর্বশেষ তাদের যেখানে আটকানো হয় সেখানে সংকটাপন্ন শিশুটিকে বাঁচাতে অ্যাম্বুলেন্সটি ছেড়ে দিতে ধর্মঘট পালনকারী কথিত জনগণের সেবকদের হাত পা ধরে মিনতি করে চালক ও স্বজনরা। কিন্তু যাদের মাথায় খুন চেপে থাকে সে চালকরা কি আর বুঝে দরদ? চালকে মারধর করে আন্দোলনকারীরা। ততক্ষণে চিকিৎসার অভাবে মাত্র সাত দিনের নবজাতক নোংরা খেলায় তাদের বিজয়ী করে নিষ্ঠুর পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে যায়।

এমনই ছিলো পরিবহণ আইনের সংশোধ দাবি করে শ্রমিকরা ধর্মঘটের প্রথমদিনের চিত্র। তাদের সর্বোচ্চ অমানবিকতার দৃষ্টান্ত রেখেছে তারা মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলা চান্দগ্রাম এলাকায় উপরে বর্ণিত শিশুকে হত্যা করে। এছাড়া সারাদেশে মুমূর্ষু রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স আটকে রাখা, যাত্রীদের গায়ে মবিল মাখানো, গাড়ি ও চালকদের গায়ে মবিল লেপ্টে দেয়া, তারা স্কুলছাত্রীর গায়ে কালো মনের আছড় দিতেও ভুল করেনি। এমনই ছিলো দিনের কথিত শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির বাস্তবতা! আইনের সংশোধন তবে এভাবে করতে হয়? এভাবেই করলে কি যায় আসে? দেশের মানুষ তো তাদের কাছে আজীবন জিম্মি!

তাদের এই কাণ্ড দেখে আমার সেদিনের বাচ্চাগুলোর কথা মনে পড়ছে। যারা রাস্তায় নেমে নিরাপদ সড়কের দাবি করেছিলো। তারা অ্যাম্বুলেন্সের জন্য আলাদা লেন করে দিয়েছিলো। যাতে রোগীরা ভোগান্তিতে না পড়ে। আর শ্রমিকরা অ্যাম্বুলেন্স আটকে রোগীদের প্রাণ কেড়ে নিলো। এটাই হয়তো এই ক্ষেত্রে এসে শিক্ষা আর অশিক্ষার পার্থক্য বুঝিয়ে দেয় জাতিকে। শুধু সেদিনের ছেলেমেয়েগুলোর সাথে এসে তাদের অভিভাবকরা রাজনীতি করে শিশুমন ও নোংরা রাজনীতির পার্থক্যও জাতিকে বুঝিয়েছিলো। শ্রমিকদের লম্বা কাতার এতোটা বর্বর হতে পারে তা আমি চিন্তা করতে পারিনি। তাদের এহেন আচরণ বলে দিচ্ছে তারা কতটা মারমুখী ও অমানবিক। তাদের কাছে মানুষের জীবন কেড়ে নেয়া দৈনন্দিন অভ্যাস। এটাই বলে দেয় তাদের জন্য যে আইন হয়েছে তাই যথাপোযুক্ত।

তাদের এমন বর্বর অমানবিকতা প্রমাণ করে এদের খুনে নেশা প্রকট। তাদের কাছে মানুষের জীনের কোন মূল্য নেই। সুতরাং কঠোর আইনে তাদের শাস্তি হওয়া চাই। রাস্তায় চলতে গিয়ে একজন চালকের হাতে মানুষ তাদের জীবন তুলে দিবে আর সেই চালক তা নিয়ে যেমনতর খেলানেলা করবে তা কোনো ভাবে মানা যায় না। আমাদের দেশে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে চালকদের দোষে প্রতি বছরে সহস্রাধিক মানুষ প্রাণ হারায়। ঘুম থেকে জেগে সড়কে প্রাণ হানির খবর পড়েননি এমন একটি দিনের কথা মনে করতে পারবেন? আমি তো মনে করতে পারিনা।

এতোসব ঘটনার দায় এড়িয়ে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে সদ্য পাস হওয়া আইনকে তারা কেন উপেক্ষা করে? তারা কি তবে মানুষ হত্যা করে পার পেয়ে যেতে চায়? এমন ধৃষ্টতা তো এদেশে কেউ দেখায়নি। অপরাধ করে শাস্তি না পাওয়ার জন্য মাঠে নেমে নৈরাজ্য তো কমই দেখেছি আমরা। তাদের খুঁটিরজোর কোথায়? তাদের খুঁটিরজোর রাষ্ট্রযন্ত্র। সরকারের প্রতিনিধিদের পরোক্ষ মদতে তারা এমনটা করছে। সরকারের মন্ত্রী যদি মৃত্যু নিয়ে হাসাহাসি করতে পারেন তাহলে তারা মুখ মলিন করে হলেও রাস্তায় নেমে ‘এই আইন মানিনা’ স্লোগান দিতে পারবে না কেন? বিআরটিএ যদি অযোগ্য চালককে পরীক্ষা না করে ঘুষের বিনিময়ে লাইসেন্স দিতে পারে তবে সে ব্যক্তি দেশের আইন মানতে শিখবে কিভাবে? ট্রাফিক পুলিশ যদি টোকেন বাণিজ্যের মাধ্যমে লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি মাসোয়ারা পেয়ে ছেড়ে দিতে পারে তবে তারা মানুষ মারতে পরোয়া করবে কিভাবে?

এদেশের চালকদের মধ্যে নূন্যতম আক্ষরিক জ্ঞান নেই তার সংখ্যা অর্ধেকের বেশি। সে কিভাবে ট্রাফিক সাইন মেনে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে? এদেশের অনুপযোগী বয়সে যে ছেলের মাথায় রোজগারের চিন্তায় রাস্তায় নামিয়ে দেয়া হয় সে ছেলে গাড়ি চালক হয়ে মানুষের জীবনের মূল্য উপলব্ধি করবে কিভাবে? প্রশিক্ষণ ছাড়া গাড়ির হেল্পারি করে যে ছেলে দূরদূর স্বভাবের মধ্যে একজন উস্তাদের কাছে গাড়ি চালানো শিখবে সে কি করে ভদ্রতা জানবে? হেল্পার বলে শিক্ষিত যাত্রীদের অবর্ণনীয় গালমন্দ ও খাটো করে কথা বলা শুনে সে কি করে মানবিক হবে? প্রশ্নগুলোর উত্তর আমি খুঁজে পাই না। আপনি তার কাছে আবার প্রাণের নিরাপত্তা চাইতে আসছেন? সর্প হইয়া ধ্বংসন আর ওঝা হইয়া ঝাড়তে আসার মতো আচরণ তো আমাদেরই।

এদেশের চালকরা সমাজের অনেক বিষয়ে অজ্ঞতা রাখেন। তাদের দিয়ে শ্রমিক সংগঠন গড়ে সে সংগঠনে নেতা হবেন শ্রমিক নন এমন কেউ। তিনি হবেন রাজনৈতিক দলের এজেন্ট। তিনি সব বুঝে শ্রমিকদের অজ্ঞতায় ডুবিয়ে রাখবেন। তাদের মাসোয়ারা নিয়ে সম্পত্তি গড়বেন। নিজের স্বার্থে তাদের ভুল বুঝিয়ে রাস্তায় নামাবেন। সেখানেও ব্যবসা করবেন। তাহলে এই চালকরা সঠিক বোধ পাবে কোথায়? তারা তো অজ্ঞ মানুষ। বর্বরতা করতেই পারে। তাদের মাঝে এই রাষ্ট্র ও তার সংশ্লিষ্ট দপ্তর সঠিক শিক্ষি দিতে ব্যর্থ হওয়ার দায় এড়াতে পারে না। দায় এড়াতে পারেন না শ্রমিক নেতারা। তারা কি জানতেন না অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস, আইনশৃঙ্খলা-বাহিনীর গাড়ি হরতাল, অবরোধ, ধর্মঘটের আওতাধীন নয়! সবই জেনেবুঝে কেন তবে তারা মানুষের জানমাল নিয়ে নোংরামি করলেন?

তাদের ইন্ধন ও স্বার্থপরায়ণ মানসিকতার জন্য শ্রমিকরা আজ বেপরোয়া। আর এই শ্রমিক নেতাদেরও সরকার কিছু করার নেই। কারণ ভোটের আগে টাকার বস্তা দিয়ে তাদের থেকেই ভোট কিনতে হয় রাজনীতিবিদদের। তাদের দাবি মানতে সরকার অনেক্ষেত্রে বাধ্য, নতুবা যেমনটা দেখছেন তার থেকে দেশ মুক্ত হবে না। এই কর্মসূচিতে যে সরকার দলীয় সমর্থন নেই তাও কেউ প্রমাণ করতে পারেন না। আমাদের পরিবহন মন্ত্রী আজও হাসিমুখে বলেছেন শ্রমিকদের ধর্মঘটের খবর তিনি জানেন না। এটা সরকারে ব্যর্থতা নাকি শাহজান খানের নিজের অজ্ঞতা তা আমার বুঝে আসেনা। এরা মন্ত্রী হয় কিভাবে সে প্রশ্নের উত্তর হলো আজকের শ্রমিকদের তাণ্ডবলীলা।

শ্রমিক নেতারা চালকদের উস্কে দিয়ে রাস্তায় নামিয়েছেন এটা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি। তাদের স্বার্থ এখানে অনেক ভাবে আছে। আমি তা নিয়ে বলবো না এখন। তবে এর দায় তারা এড়াতে পারেন না। সেটা যেকোন সাধারণ মানুষও চিন্তা করলে বুঝতে পারে। বিগত বছগুলোতে আমরা যেভাবে সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলের তাণ্ডবলীলা দেখে ঘৃণা ঝেড়েছি শ্রমিকদের আচরণ তা ছাড়িয়ে গেছে। রাজনৈতিক এসব ঘটনায় দলের প্রধানদের আসামি করে মামলা হলে এসব ঘটনায় শ্রমিক নেতারা আসামি হতে হবে। এবং তাদের বিচার অবশ্যই দেখতে চাইবো। কারণ সাধারণ চালকরা আইনের কিছুই ভালো করে বুঝতে পারেনি এখনও। আমাদের আইনমন্ত্রীও এমনটা দাবি করেছেন।

একটি আইনের সংশোধন দাবি তারা করিতেই পারে। কিন্তু তা দিয়ে তারা নিজেদের বাহাদুরি প্রদর্শন তো নিশ্চয় মানুষের কাম্য ছিলোনা। জনগণ এখনও তাদের ড্রাইভার সাহেব বলে সম্বোধন করেন তা তারা ভুলে গেলেন কিভাবে? আমাদের রাজনীতিবিদরা যদি অনেক কিছু স্বার্থের জন্য ভুলে যেতে পারে, তাহলে সামান্য টাকা বেশি রোজগারের জন্য রাস্তা পার হতে গাড়ি নিয়ে উড়াল দেয়ার মানসিকতা ও মানুষ হত্যার পর তার দায় এড়াতে তারা রাস্তায় সামান্য তাণ্ডব করতে পারে না? পারে বলেই পারছে। হয়তো এটা আমাদের নিচু স্বভাবের বিরুদ্ধে তাদের বড় প্রতিবাদ। এটা ঘুষের বিনিময়ে অন্যায়কে জায়েজ করার প্রতিযোগিতার ভয়াবহতার প্রমাণ!

লেখক: সাংবাদিক ও সমাজকর্মী
mahmud.press@gmail.com


মতামত বিভাগে প্রকাশিত লেখা লেখকের একান্ত নিজস্ব। লেখার বিষয়বস্তুর যথার্থতা নিয়ে শাহবাজপুর.কম আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।